রক্তে অর্জিত বাংলা ভাষা
এস আর শানু খান
🕐 ১২:১৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ০৪, ২০২১
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। রাজপথে তাজা রক্ত ঢেলে অর্জিত এক ভাষার নাম বাংলা ভাষা। ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি আমরা। ভাষার জন্য রক্ত দেওয়া জাতি হিসেবে বিশ্বভা-ারে আমরা এক অনন্য কীর্তি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, রক্তে অর্জিত এই ভাষার প্রতি আমাদের দরদ নিতান্তই প্রশ্নবিদ্ধ। অঞ্চলের ভিন্নতায় আমাদের কথ্যভাষার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও লেখা ও বইয়ের ভাষা এক ও অভিন্ন। স্বাধীনতার এত বছর পরেও বাংলা ভাষার প্রতি অনীহা রয়েই গেছে আজ অবধি। যার বাস্তব প্রমাণ এখন আমাদের শিক্ষক সমাজের মধ্যে লক্ষ করা যায়। নিজেকে চৌকস হিসেবে উপস্থাপন করতে গিয়ে জেনে না জেনে নানা রকম পাঁচমিশালি বিদেশি ভাষাকে টেনে এনে বাংলা ভাষাকে গুলিয়ে ফেলি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় লক্ষ করলে দেখা যায়, বাংলা ক্লাস নিতে এসেও নিজের অজান্তে শিক্ষক শিখিয়ে যান ইংরেজি ভাষা। আগে থেকে না জানলে বোঝার কোনো উপায়ই থাকে না এটা বাংলা নাকি ইংরেজি ক্লাস!
সরকারি অফিস আদালতে বাংলাভাষার যথেষ্ট প্রয়োগ থাকলেও আমরা হেলাফেলায় নিজেদের ইচ্ছা স্বাধীনতায় বাংলা ভাষাকে নানাভাবে হেনস্তা করে চলছি। দেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল থেকে শুরু করে, রেডিও চ্যানেলগুলোর নামও আজ বেশিরভাগ ইংরেজিভিত্তিক। শুধু তাই নয়Ñ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এমনকি বাংলার মাটিতে, বাংলা হাওয়া বাতাসে দাঁড়িয়ে তোলা নিজের স্বপ্নের বাড়িটির নাম দিয়ে রাখি ইংরেজিতে। দোকানের ব্যানার, প্যানা, বিলবোর্ড থেকে শুরু করে ভিজিটিং কার্ড এমনকি ইদানীং নি¤œবিত্ত-উচ্চবিত্ত বলে কথা নেই, সব শ্রেণির মানুষের বিয়ের কার্ডেও আজ নানান বিদেশি ভাষার বিচরণ চোখে পড়ে। বাংলা ভাষার প্রয়োগের কথা বললে অনেকেই বলে থাকেন কিছু কিছু কথা বোঝাতে নাকি কিছু ইংরেজি ছাড়া সম্ভব হয়ে উঠে না। অথচ যুগে যুগে হাজারও মনীষী হাজারো বিদেশি লেখক-সাহিত্যিক স্বীকার করে গেছেন, মনের ভাব সঠিক এবং নিখুঁতভাবে প্রকাশ করতে বাংলা ভাষার বিকল্প নাই। তাহলে আমরা কেন সেটা করতে ব্যর্থ হচ্ছি। আসলে আমরা আমাদের ভাষার ইতিহাস সঠিকভাবে এখনও জেনে উঠতে পারিনি অনেকেই।
বাংলা আমার মায়ের ভাষা বলতে বলতে বাংলা ভাষার প্রতি চিন্তা-চেতনা এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে সন্তানের অনেক খামখেয়ালিপনায় যেমন মা সহজে কষ্ট পান না ঠিক তেমনিভাবে আমরা বাংলা ভাষার সঙ্গে এমন খামখেয়ালিপনা শুরু করেছি। এবং এই খামখেয়ালিপনার জন্য বাংলা ভাষা হারাচ্ছে গুরুত্ব। বাংলা শব্দভা-ারের অনেক মধুর শব্দ বিদেশি নানান শব্দের মিছিলে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা অভিধানে। আমরা একটা ইংরেজি শব্দের অর্থ খুঁজতে প্রয়োজনে কয়েকটা ইংরেজি ডিকশনারি ঘাঁটতে কিছু মনে না করলেও একটা বাংলা শব্দের মানে জানতে একটা বাংলা অভিধান ধরতেও রাজি নয় খোঁজা তো পরের কথা। আমাদের দেশের অনেক বাংলা শিক্ষকের বাংলা অভিধানই নাই। আমার এক পরিচিত লেখক। বেশ কয়েক বছর একসঙ্গে জাতীয় পত্রিকায় লিখছি। তার অনেক লেখা পত্রিকায় ছাপা হয় প্রতিনিয়ত। একদিন কৌতূহলের বশে জানতে চাইলাম, বাংলা জানার জন্য কোন অভিধানটা ভালো হবে।
তিনি জানালেন, অভিধান সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই! পরে জানতে চাইলাম, আপনি কোনটা দেখেন? বললেন, এত বছর লেখালেখি করছি এখন পর্যন্ত বাংলা অভিধানের প্রয়োজন পড়েনি। আশা করি আর প্রয়োজনও পড়বে না। বিষয়টা আমার অদ্ভুত লাগল। এটা কেমন কথা। একজন লেখকের কেন বাংলা অভিধানের প্রতি এতটা অনীহা। এরকম অনেক লেখক রয়েছেন যারা নিজেদের অনুর্বর মস্তিষ্ক নিঃসৃত বিজ্ঞতা দিয়ে ভাষার বারোটা বাজাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। ভাষার সম্মান রক্ষার্থে অবশ্যই ভাষাবিজ্ঞানের উপর বিশেষ জোর দিতে হবে। চর্চা বাড়াতে হবে।
এস আর শানু খান : ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সরকারি এম এম কলেজ, যশোর