ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ফুল ব্যবসায় ধস : ক্ষতিগ্রস্ত চাষি ও ব্যবসায়ী

আব্দুল হাই রঞ্জু
🕐 ১২:৫৯ অপরাহ্ণ, মার্চ ০৩, ২০২১

ফুল ব্যবসায় ধস : ক্ষতিগ্রস্ত চাষি ও ব্যবসায়ী

ফুলের গন্ধ, সৌরভকে কে না ভালোবাসে! ফুলকে ভালোবাসে না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফুলের সৌরভ মানুষের মনপ্রাণকে পুলকিত করে, উজ্জীবিত করে। যে কারণে ‘ফুলের ফসল’ কবিতায় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ফুলের কদরকে সুন্দরভাবে তুলে এনে বলেছেন, ‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা খাদ্য কিনিয়ো ক্ষুধার লাগি, দুটি যদি জোটে অর্ধেকে তার ফুল কিনে নিয়ো, হে অনুরাগী!’ কত চমৎকারভাবে কবি ফুলকে নিয়ে তার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। কোথায় নেই ফুলের কদর? মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে সেই ছোট বেলায় ফুল খুঁজে ফিরতাম ফুলপ্রেমী মানুষের বাগানে। তখন ফুল পাওয়া ছিল বড়ই দুষ্কর। কদাচিৎ বাড়িতে ফুলের বাগানে ফুল মিললেও সহজেই কেউ তা ছিঁড়তেও দিতেন না। বাধ্য হয়ে শহীদ বেদিতে দেবদারুর পাতার তোড়ায় দু-একটি ফুল গুঁজে আমরা শ্রদ্ধা জানেয়েছি। এসব ঘটনা খুবই পুরনো দিনের নয়, কম বেশি সবার অভিজ্ঞতায় এসব পরিপূর্ণ আছে। 

সত্যিই আজ সে দিনের পরিবর্তন এসেছে। ফুল হয়ে ওঠেছে মানুষের রুটি-রুজির প্রতীক। একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু নয়, পহেলা ফাল্গুন, বিয়ের গাড়ি, বক্তৃতার মঞ্চ কোথায় নেই ফুলের কদর? ফুল এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় গোটা দেশেই। যদিও ১৯৮৩ সালে যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার পানিমারা গ্রামের ফুল অনুরাগী উদ্যোগী কৃষক শের আলী মাত্র তেরাশি শতাংশ জমিতে ফুল চাষ শুরু করেন। যা এখন দেশের প্রায় ২৪টি জেলায় ৩৫০০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। ফুল উৎপাদনে জড়িত আছেন প্রায় ১৫ হাজার কৃষক এবং ফুল উৎপাদন ও বিপণন ব্যবসায় সরাসরি নিয়োজিত আছেন প্রায় দেড় লাখ মানুষ। ফুলের বহুবিধ ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুলের উৎপাদন গত এক যুগে অনেক বেড়েছে। খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ২৬০০ হেক্টর, ঢাকা বিভাগে ৬৯০ হেক্টর, চট্টগ্রাম বিভাগে ১২১ হেক্টর ও রংপুর বিভাগে ৪২ হেক্টর জমিতে এখন ফুলের চাষ হচ্ছে। এ ছাড়াও রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগেও এখন ফুলের চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে।

ফলে ফুলের চাষাবাদ বৃদ্ধির কারণে ফুলের ব্যবসাও জমে ওঠেছে। এক সময় রাজধানীর শাহাবাগে ছোট ছোট খুপড়িতে দু’চারটি ফুলের দোকান আমরা দেখেছি। দেখতে দেখতে সে শাহাবাগ এখন ফুল বাণিজ্যের রাজধানী হয়ে ওঠেছে। ভোর হতেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ফুলের গাড়ি থেকে ফুল কেনা বেচা হচ্ছে। ভাবাও যায় না, কীভাবে খুব স্বল্প সময়ে ফুল বাণিজ্যের এ প্রসার ঘটেছে। এখন শুধু শাহাবাগেই নয়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ফুলের রমরমা ব্যবসা হচ্ছে। সেখানে হঠাৎ যেন ছন্দপতন করে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। রমরমা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। ফুলশূন্য হয়ে পড়ে শাহাবাগসহ অন্যান্য বিপণন কেন্দ্রগুলো। একমাত্র বৈশ্বিক করোনার ছোবলে একে একে বন্ধ হতে থাকে মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য, রুটি-রুজি, এমনকি স্বাভাবিক জীবন চলাচলও। সেখানে ফুলের বাণিজ্য থাকবে কীভাবে? ধীরে ধীরে সে পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ফুলের ব্যবসাও ছন্দে ফিরতে শুরু করে। স্বপ্ন দেখতে থাকেন ফুল চাষি ও ফুল ব্যবসায়ীরা। সবার মধ্যে প্রাণ চাঞ্চলতা ফিরে এসেছিল হয়তো এ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি, ভ্যালেন্টাইস ডেতে ফুলের ব্যবসা জমে ওঠবে। কিন্তু ফুল ব্যবসায়ী ও ফুলচাষিদের সে হাসি নিমিষেই ম্লান হয়ে গেছে। এ বছর আর তেমন ব্যবসা জমেনি। ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ীদের। ফুল ব্যবসায়ীদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্য মতে, স্বাভাবিক সময়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে গোটা দেশে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার ফুলের বাণিজ্য হয়। তবে এ বছর করোনা পরিস্থিতির কারণে ফুল বিক্রি কম হবে বলে তাদেরও ধারণা ছিল। অবশ্য সেভাবে বিনিয়োগও করেছিলেন। তাদের ধারণা ছিল, ন্যূনতম ১০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে। কিন্তু সেখানে আড়াই কোটি টাকারও ফুল বিক্রি হয়নি। ফলে বিপুল পরিমাণ ফুল অবিক্রীত থাকায় সেসব পচে যাচ্ছে। কেবল রাজধানীতেই প্রায় ট্রাকে ট্রাকে ফুল ফেলে দিতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, অন্যান্য বারের ন্যায় সভা, সমাবেশ, সেমিনার না হওয়ায় ফুল বিক্রি কম হয়েছে। আবার সামনে স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা নববর্ষেও এবার ফুলের বিক্রি কম হবে বলে ফুল ব্যবসায়ীদের ধারণা।

অর্থাৎ এ বছর করোনা মহামারীর কারণে ফুল বাণিজ্যেও মহামারী হয়েছে। ফুলচাষি ও ফুল ব্যবসায়ীরা সর্বশান্ত হয়ে গেছেন। করোনাকালে ফুল চাষতো বন্ধ ছিল না। অথচ ফুল বিক্রির জায়গা সীমিত হয়ে পড়ায় ফুল চাষিদের যেমন পানির দামে ফুল বিক্রি করতে হয়েছে, আবার ফুল ব্যবসায়ীরা সে ফুল কিনে বিক্রি করতে না পেরে লোকসানের মুখে পড়েছে। ঢাকা ফুল ব্যবসায়ী কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি শ্রী বাবুল প্রসাদ এ প্রসঙ্গে বলেন- একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কেবল গদখালি থেকে রাজধানীর আগারগাঁও ফুল বাজারে ৩ ট্রাক এবং শাহাবাগ ফুল বাজারে ১২ ট্রাক ফুল এসেছিল। এর মধ্যে প্রায় ৯ ট্রাকের মতো ফুল অবিক্রীত থাকায় পচে নষ্ট হয়ে গেছে। কম দামে ফুল বিক্রি করলেও কোনো ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যায়নি মর্মে ব্যবসায়ীরা জানান। অথচ এই ফুল চাষ করে ও ফুলের ব্যবসা করে দেশের অর্থনীতিতে বড় মাপের অবদান রাখা সম্ভব। শুধু উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাবে ফুল শিল্পের উত্থান যেমন সেভাবে ঘটছে না, তেমনি এ শিল্পের বিকাশে প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি হচ্ছে।

মূলত ফুল শিল্পের বিকাশে সুযোগ ও সম্ভাবনার সুযোগ থাকলেও তা নানা কারণে চ্যানেঞ্জের সম্মুখীন। যেমন ফুল উৎপাদনে প্রযুক্তির ওপর ফুল চাষিদের উপযুক্ত জ্ঞানের অভাব, অতিরিক্ত মুলধন ব্যয়, বাংলাদেশে ফুলের বীজের অভাব ও চারার অপ্রাপ্যতা এবং এ ব্যাপারে ভারত থেকে আমদানি নির্ভরতা, গ্রিন হাউস নির্মাণের প্রয়োজনীয় দ্রবাদির অপ্রাপ্যতা, ফুল চাষের জন্য বিশেষ কম্পাউন্ড সারের অভাব, ঢাকাসহ বড় বড় শহরে স্থায়ী পাইকারি বাজারের অভাব, কৃষক পর্যায় থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যায় পর্যন্ত ফুলের একটা অংশ বিনষ্ট হওয়ার মতো নানাবিধ সমস্যার কারণে ফুল শিল্পের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ, সরকারকে উন্নত প্রযুক্তির চাষাবাদ পদ্ধতিতে সহায়তা, ফুলের বীজ আমদানি ও চারা প্রাপ্যতায় সরাসরি সহযোগিতা বাড়ানো একান্তভাবে জরুরি। এমনকি দেশে কোনো জাতীয় ফুলনীতি নেই। একটি জাতীয় ফুলনীতি প্রণয়ন করে ফুল উৎপাদনে চাষি পর্যায়ে নানাবিধ সহায়তা, বিপণন ও সংরক্ষণে সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ফুল শিল্পকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। এমনকি ফুল স্থানীয় চাহিদা পূরণ করার পর বিদেশে রপ্তানির পরিমাণ বাড়ানোও সম্ভব। বিশেষ করে ফুল সংরক্ষণের উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে ফুল পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির সংরক্ষণাগার স্থাপন করলে ফুল চাষি ও ব্যবসায়ীরা ফুল সংরক্ষণ করে সে ফুল ধীরে ধীরে বিক্রি করতে পারবেন। ফলে ফুল শিল্পের সহিত জড়িত চাষি ও ব্যবসায়ীরা লাভবান হতে পারবেন। এ জন্য সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা যেমন দিতে হবে, তেমনি ফুল শিল্পের বিকাশে সরকারিভাবে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করে এ শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে হবে। কারণ যখন একটি জাতির কাছে ফুলের কদর বাড়বে, তখন ভাবতে হবে, মানুষের মনের উজ্জীবতা বৃদ্ধি পেয়েছে, এমনকি মানুষ ফুলপ্রেমী হওয়া মানে মানুষের মন-মানসিকতারও উন্নতি ঘটেছে। সমাজ ও দেশ সমৃদ্ধ হচ্ছে। অর্থাৎ ফুল চাষ ও ফুল বাণিজ্যের সমৃদ্ধি মূলত একটি দেশের সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবেই বিবেচিত হবে।

বাস্তব এ অবস্থা বিবেচনায় নিতে দেশের কৃষিবিদরা সুপারিশ করেছেন, বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ফুল শিল্পের আরও অধিকতর বিকাশের লক্ষ্যে-বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফুল নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা, ফুল উৎপাদন প্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, ফুলের বীজ ও চারা আমদানির ওপর শুল্ক মওকুফ, ঢাকাসহ বড় বড় শহরে ফুলের স্থায়ী পাইকারি বাজার স্থাপন, পরিবহনকালে ফুল খাতে নষ্ট না হয় এ জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থা চালু, যশোরে ফুল সংরক্ষণের জন্য বিশেষায়িত হিমাগার স্থাপন, দক্ষিণাঞ্চলের ফুল উৎপাদনকারী এলাকাগুলোতে বাজারের অবকাঠামো উন্নয়ন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন সকল তফসিলি ব্যাংক ও সকল ঋণদান সংস্থা কর্তৃক সহজ শর্তে ঋণের সুবিধার পাশাপাশি সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ফুল সেক্টরে মহিলা উদ্যোক্তাদের অধিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এমনকি কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি জাতীয় ফুলনীতি প্রণয়ন করতে হবে। অর্থাৎ ফুল যে বাংলাদেশে একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে কারণে বিশ্বমানের ফুলের বীজ ও চারা আমদানি প্রণয়ন করতে হবে। ফুলের চাষ বৃদ্ধি করতে হবে। ইতিমধ্যেই বিদেশি ফুল যেমন জারবেরা, গ্লাডিওলাসের মতো বিদেশি ফুলের চাষ হচ্ছে।

এমনকি অধিকতর আবাদও হচ্ছে দেশে। যে কারণে এখন আর মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড থেকে ফুল আমদানি করতে হচ্ছে না। বরং বাংলাদেশ থেকে স্বল্প পরিসরে ফুল রপ্তানি শুরু হয়েছে। সম্ভাবনায় জায়গাটি হচ্ছে, বিদেশি ফুল চাষ প্রসারে শীর্ষ বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। মেটাল এগ্রো লিমিটেড এগিয়ে এসেছে। জাপান থেকে সরাসরি বীজ এনে তা কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া শুরু করেছে তারা।
বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল শীতপ্রবণ এলাকা। এখানে শীতকালীন ফুল চাষ করা সম্ভব। মেটাল এগ্রো লিমিটেড বিশ্বের বিখ্যাত বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ট্যাকি সিড কোম্পানি থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের বীজ আমদানি করে চাষি পর্যায়ে বিপণন করছে। এমনকি তারা প্রাথমিকভাবে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার নগর চেংঠী এলাকার কাওয়াপুকুর গ্রামে নিজেরা খামার করে বিদেশি ফুল উৎপাদন করে সাফল্য পেয়েছে। যা থেকে এখন বিভিন্ন খামারি ও নার্সারী মালিকরা বিদেশি ফুল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আশা করা হচ্ছে, দেশি-বিদেশি ফুল চাষ করে ফুল শিল্প দেশের অর্থনীতিতে বড় মাপের অবদান রাখতে সক্ষম হবে। ফলে সরকার ফুল শিল্পের বিকাশে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন, এটাই সকলের প্রত্যাশা।

আব্দুল হাই রঞ্জু : সাবেক ছাত্রনেতা

 
Electronic Paper