পঞ্চাশ বছর আগের সেই জন্মদিনে
আহাদ আদনান
🕐 ১১:০০ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ০১, ২০২১
স্বাধীন বাংলাদেশে জাতি তার জনকের জন্মশতবর্ষ পালন করছে। বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় জন্মদিন পেয়েছিলেন পঞ্চান্নটি। টুঙ্গিপাড়ায় সেই ছোট গ্রামে হয়ত জন্মদিন পালন বলে কিছু ছিলও না। সৌরজগতের গ্রহ-নক্ষত্রের জটিল ঘুরপাকের হিসাব করে আমরা ৩৬৫ দিনে এক বছরের ধারণা লালন করি। সেই হিসাবেই প্রতিবছর একটি বিশেষ দিন জন্মদিন হিসেবে ফিরে ফিরে আসে। বেঁচে থাকতে বঙ্গবন্ধু তার অজান্তে কিংবা সচেতনভাবে যে কয়টি জন্মদিন পেয়েছিলেন, অনেকের মতেই আলাদা তাৎপর্য নিয়ে এসেছিল পঞ্চাশ বছর আগের একটি জন্মদিন। একাত্তরের সতেরই মার্চ। একটি জাতির, দেশের বর্তমান, ভবিষ্যৎ পাল্টে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছিল সেই মার্চের প্রতিটি দিনে। কেমন ছিল সেই জন্মদিন, আজও জানতে ইচ্ছে করে আমাদের। সেই সতেরই মার্চের কথা বলার আগে পুরো মাসটির কথাই বলে নেওয়া ভালো। আজ আমরা সবাই জানি, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অর্জন করেছিল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। অর্থাৎ ক্ষমতায় আসার কথা দলটির। অথচ সরকার গঠনে আহবান জানানোর পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া হঠকারিতার পথ ধরলেন। তিনি ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু এই সিদ্ধান্তকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ আখ্যা দেন। এর প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায়, আর ৩ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহবান করেন। শুরু হয় ‘অসহযোগ আন্দোলন’।
এই আন্দোলনের প্রারম্ভে ২ মার্চ ছাত্র সংগঠনগুলো ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। প্রতিক্রিয়ায় সরকার সামরিক আইন জারি এবং সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করে। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘স্বাধীনতার ইশতেহার’ ঘোষণা করে। ৫ মার্চ লীগ কর্মীরা লাঠি হাতে বিক্ষোভ মিছিল করে। নিহতদের স্মরণে গায়েবানা জানাজাও পড়া হয় সেই দিন। ৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ পুনরায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেন। এর পর আসে সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানের সেই জগৎবিখ্যাত ভাষণের পর থেকে অসহযোগ আন্দোলন নতুন গতি লাভ করে। ছাত্রলীগ ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এর মধ্যেই চলতে থাকে ধারাবাহিক কর্মপরিকল্পনা এবং নির্দেশনা। ১৬ মার্চ ঢাকায় ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনা শুরু হয়। আর বৈঠকের বাইরে চলতে থাকে অসহযোগ আন্দোলন। আলচনার দ্বিতীয় আর অসহযোগ আন্দোলনের ষোড়শ দিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫১তম জন্মদিন। তার জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ জন্মদিবস।
সেদিন সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা শুভেচ্ছা জানাতে ভিড় করেন ধানমন্ডির বাসার সামনে। ছিলেন দেশি বিদেশি সাংবাদিক। দুপুরে এক ঘরোয়া আলোচনায় এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় ও পবিত্র কামনা কী’? বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি’। সবাই যখন জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করতে গেলেন, জাতির জনক বুকভরা ব্যথা নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না। জন্মদিনে মোমের বাতিও জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা (বিদেশি সাংবাদিক) আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কী আর মৃত্যুদিনই কী? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু’। জন্মদিনের পাশাপাশি সাংবাদিকদের মূল আগ্রহ ছিল আলোচনার অগ্রগতি বিষয়ে। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধুর উত্তর ছিল এরকম। ‘প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা চলছে’। ‘আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নাই। আরও আলোচনা হতে পারে, তবে বৈঠকের সময় এখনও ঠিক হয় নাই। আজও হতে পারে, আগামীকালও হতে পারে’। ‘আলোচনা ফলপ্রসূ হচ্ছে, না নিরর্থক হচ্ছে, আমি জানি না। শুধু এটুকু বলতে পারি, হচ্ছে’। ‘আলোচনার সময় আমার দাবির (৪ দফা) কথা অবশ্যই বলেছি’। ‘আমি কি আন্দোলন প্রত্যাহার করেছি? আমাদের আন্দোলন চলছে। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এটা অব্যাহত থাকবে’।
রাজনৈতিক সংকট নিরসনে প্রেসিডেন্ট কোনো ফর্মুলা পেশ করেছে কিনা, এর উত্তরে বলেন, ‘আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়’। সেদিনের বৈঠকের সময় সংক্ষিপ্ততার দিকে ইঙ্গিত করলে বঙ্গবন্ধু নীরব হাসি দেন। বিদেশি সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, ‘আমরা কি এই হাসি থেকে কিছু অনুমান করতে পারি’? বঙ্গবন্ধুর সেই বিখ্যাত উত্তর ছিল, ‘তোমার মুখেও তো হাসির রেখা। I can smile even in hell. আমি জাহান্নামে বসেও হাসতে পারি’।
অনেকেই ভাবছিলেন, বঙ্গবন্ধু কি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন? ‘হতাশ বা নিরুৎসাহিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের আন্দোলন চলছে। জনগণ যেকোনো ত্যাগের বিনিময়ে অধিকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ। ত্যাগের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ গণশক্তির বিজয়কে কেউই প্রতিরোধ করতে পারে না’। ‘আমার বিদেশি সাহায্যের দরকার নাই এবং দূতাবাসগুলোর সঙ্গে কোনো যোগাযোগও হয় নাই’। সেই দিনটিতে শান্তিপূর্ণ সভা-শোভাযাত্রা, সরকারি এবং আধা-সরকারি অফিস বর্জন অব্যাহত ছিল। আন্দোলনে শহীদের উদ্দেশ্যে শোক পালন করা হয়। সরকারি হঠকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঢাকার রাজপথ কুচকাওয়াজরত ছাত্র এবং স্বেচ্ছাসেবকদের পদভারে ছিল প্রকম্পিত। পাকিস্তানি এক নায়কের দল তখনও বুঝে উঠতে পারেনি, এই ভূখণ্ড কেমন করে তাদের প্রতি অত্যাচার, নির্যাতন, অবিচারকে প্রতিটা দিন কি বিপুল ক্ষোভ, আন্দোলন আর গর্জনে রূপান্তরিত করছিল। তাদের পর্বতের মতো স্থির এবং অবিচল নেতা কেমন করে তাদের সংগঠিত করছিলেন। এই ভূখণ্ড আর পরাধীন থাকছে না, এটিই ছিল একমাত্র ভবিতব্য।
জাতির জনকের এনে দেওয়া সেই ভূখণ্ডে আমরা যখন মুজিব জন্মশতবর্ষ উদযাপন করব, তখন প্রতিটি মুহূর্তে তার অনুপস্থিতি আমাদের পোড়াবে? আমাদের যন্ত্রণা দেবে একটি নির্মম সত্য। পরাধীন দেশে নয়, জেলে নয়, বরং প্রিয় ভূখণ্ডে, নিজের বাসায় বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, এই বাংলারই কিছু নরপিশাচের হাতে।
আহাদ আদনান : সাহিত্যিক
[email protected]