মাগো তোমার কোলে তোমার বোলে
রুমানা নাওয়ার
🕐 ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২১
যারা বলে বাংলা নিকৃষ্ট জনের ভাষা, বাংলাদেশ নিকৃষ্ট মানুষের দেশ- ধিক্কার তাদের। ধিক্কার তাদের পূর্বজনমের মানুষদের। কারণ তারা ব্যর্থ হয়েছে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের বংশধরদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে যে বাংলা আমার প্রাণের ভাষা, আমার মায়ের ভাষা। এ ভাষাতেই আমার বিশ্ব দোলে। এ ভাষায় আলো জেলে আমার বেড়ে ওঠা। আমার স্নান গান সবই এ ভাষায়। এ ভাষাতেই আমার জন্ম-মৃত্যু, ভালোবাসা। মাকে মা ডাকার যে অপরিমেয় সুখ তা শুধু আমার বাংলা ভাষায় খুঁজে পাই।
পৃথিবীর তাবৎ ভাষাভাষীর কাছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব অত্যধিক। কারণ ভাষার জন্য যুদ্ধ জীবন দান আর কেউ করেছে কিনা জানা নেই। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয় সাড়ম্বরে। তবুও যারা দ্বিমত পোষণ করে তাদের শতমুখে ধিক্কার। বুকভরে শ্বাস টেনে যে বর্ণমালারা আমার মুখে মুখে ফেরে তাদের কাছে আমার আজন্মের ঋণ। আমার দুখিনী বর্ণমালা। অ আ ক খ আমার প্রাণের রুপালি সোনালি বর্ণমালারা। জন্মের পর প্রতিটি শিশুর মুখে বুলি ফোটা প্রথম ডাক মা। তারপর আস্তে আস্তে এ ডাকার চেনা-জানার পরিধি বাড়তে থাকলে শিশুর ভাষার ব্যবহারও বাড়তে থাকে।
বাড়তে থাকে ভাষার ব্যবহার অ আ ক খ স্বর আর ব্যঞ্জনের বিপুল সমারোহে সমৃদ্ধ হয় তার মন মনন। তার পৃথিবী আলোকিত হয় এ বর্ণমালার মাধ্যমে। মাকে মা ডাকার মাধ্যমে চেনা ভাষা বিপুল বিস্ময়কর রূপে তার কাছে প্রতিদিন নতুন নতুন রূপে ধরা দেয়। চারপাশের এত এত চেনাজানা মুখ থেকে নিঃসৃত মুখের ভাষাটাও তার মানসিক বিকাশে সহায়তা করে। তার জানার ক্ষেত্রটাকে সমৃদ্ধ করে।
মাকে মা ডাকার যে অধিকার তা আমরা পেয়েছি এ রক্তঝরা ফাগুন মাসে। পলাশের কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে আগুনলাগা মৌসুমে আমাদের কিছু দামাল ছেলের দল বুকের তাজা রক্ত ঢেলে মায়ের মুখের ভাষাকে মায়ের কাছেই ফেরত দিয়েছে। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন আমাদের ভাষার অধিকার আদায়ে আন্দোলন। যার সম্মুখসারিতে ছিল সর্বস্তরের জনগণ। ছাত্ররাই মূলত নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই স্বাধিকার আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়েছিল। যা পরবর্তীকালে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
এই যে এত সুন্দর এত সুফলা ভাষা আমাদের তা নিয়ে সংশয় থাকার কথা নয় কারও। বাংলা ভাষাকে নিম্নবর্গের মানুষের ভাষা বলতেও কতিপয় তথাকথিত ভদ্রমানুষ কার্পণ্য করেন না। তারা এও বলে বেড়ান, পাকিস্তান থাকলে ভালো হতো। উর্দুই হতো রাষ্ট্রীয় ভাষা। তাহলে আর এ অভাগা ভাষাভাষীর কাছ ঘেঁষতে হতো না। বাংলাদেশে বসবাসকারী বাংলায় কথা বলা এ কুষ্মা-দের জন্য সত্যিই তখন আফসোস হয়, করুণা হয়।
বুকভরে শ্বাস নেওয়ার যে বিশুদ্ধ বাতাস আমার বাংলা মায়ের মাঠে প্রান্তরে, বন বনানীতে। তা পৃথিবীর আর কোথাও কি আছে? যে সুধামাখা প্রকৃতি আমার বাংলা মায়ের তা আর কোথাও পাব না। বাংলাদেশ বাংলা ভাষা আমার সবচেয়ে বড় অহংকার। বুক ফুলিয়ে বলতে পারি- আমরা বাঙালি। আমাদের আছে হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য। বাংলা ভাষা আমাদের গর্ব। এ এমন এক গর্ব বুক ফুলিয়ে যাওয়ার মতো। যেখানেই যাই যেভাবেই থাকি এ ভাষার উচ্চারণে আমরা সমৃদ্ধ হই। শরীর মনে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে যায়। পৃথিবীর আর অন্য কোনো ভাষায় এমন হয় কিনা আমার জানা নেই। কত শত কবি সাহিত্যিক এ ভাষায় ধারণ করেছেন কালজয়ী কবিতা গল্প উপন্যাস। বাংলাকে বুকে মুখে ধারণ করে আমরা উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে আছি বিশ্ব দরবারে। কবির ভাষায় বললে বলতে হয়-
মোদের গরব মোদের আশা
আ মরি বাংলা ভাষা
তোমার বোলে তোমার কোলে
কতই শান্তি ভালোবাসা।
এ শান্তি আমার আপনার সকলের বাংলা ভাষাভাষী আপামর জনসাধারণের। আমাদের দেশের প্রকৃতি উদার বিশাল। শস্যফলা মাঠের পর মাঠ। বারোমাসে ছয় ঋতুর বৈচিত্র্যে রঙিন এ দেশের আকাশ বাতাস বন বনানী। সৌন্দর্যে চোখজুড়ানো চারিদিক। গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত অপূর্ব রূপের পসরা সাজায় প্রকৃতিতে। প্রকৃতি ও বারোমাস উদার হস্ত। দেওয়াতেই তার আনন্দ। লুটেরার দল তাই তো সব কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করে রেখেছিল এ জাতিকে। অধিকার আদায়ে বরাবরই সোচ্চার এ জাতি। আন্দোলন, দাবিদাওয়া যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা স্বাধিকার ছিনিয়ে এনেছে বরাবরই। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা এ জাতি হার মানেনি কোনো সময়ে। ঘোর অমানিশায় এনেছে সোনালি আলোর প্রভাত। সে প্রভাতের সোনালি সূর্যালোকে আমার বাংলাদেশ হাসছে চিরকাল লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে।
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি...।
রুমানা নাওয়ার : সাহিত্যিক, চট্টগ্রাম