ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মোটরসাইকেল নাকি মৃত্যুর সাইকেল!

মুহাম্মদ রমিজ উদ্দিন
🕐 ১১:৩০ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২১

মোটরসাইকেল নাকি মৃত্যুর সাইকেল!

আমার এক বন্ধুর মা তার ছেলের পাশাপাশি আমাকেও উপদেশ দিয়ে বলতেন ‘অপুত, মওতা সাইকেলত ন-উইট্ট।’ (হে পুত্র, মৃত্যুর সাইকেলে চড়িও না।) তিনি মোটরসাইকেলকে নাম দিয়েছেন মওতা সাইকেল তথা মৃত্যুর সাইকেল। আসলেই তো মোটরসাইকেল এখন মৃত্যুর সাইকেলে রূপ নিয়েছে।

চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারির প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয় সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫% মোটরসাইকেল। সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দেশের জন্য অতি সাধারণ এবং স্বাভাবিক ঘটনা ও মৃত্যুর সহজ মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ দেশের একটা ব্যাপার সবার মতন আমাকেও অবাক করে দেয়। আর তা হলো- চালকের অবহেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে পড়বে কিছু তরতাজা প্রাণ, সড়ক রঞ্জিত হবে কিছু নিরহ মানুষের নির্ভেজাল রক্তে তারপর সেই দুর্ঘটনা নিয়ে কিছুদিন মাতামাতি হবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে হায়-হুতাশ চলবে, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হবে, টেলিভিশনে টক শো হবে; এমনকি সংসদে আইনও পাস হবে কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার সেই আগের মতো। অনিয়ম ও দুর্নীতির চাপায় পিষ্ট হয় ধুমধাম করে পাশ হওয়া সেই আইন।

এদেশের আইন এবং নদীর ওপারের ঘাস দুটিকে আমার কাছে অভিন্ন মনে হয়। দূর থেকে তাকালেই এ দুটি চকচক করে। কাছে গেলে মনে হয় যেন সেই পুরনো মরীচিকা। সড়ক আইন কেমন হওয়া উচিত এবং কীভাবে প্রয়োগ করতে হয় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল ২০১৮ সালের শিক্ষার্থীদের সড়ক আন্দোলন। স্কুল শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে শিখিয়েছিল কীভাবে আইন মানতে হয় এবং কীভাবে প্রয়োগ করতে হয়। এদেশে আইন আছে কিন্তু একদিকে যেমন আইন মানার মানসিকতা দৌড়ের ওপর থাকা পাবলিকের নেই অন্যদিকে আইনের যথাযথ প্রয়োগও নেই। ঘুষ ও দুর্নীতির নিচে চাপা পড়ে এ দেশের আইন।

সড়ক দুর্ঘটনার বড় একটা অংশ মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল যানবাহন যেমন বেশি তাদের অনিয়মও বেশি। মোটরসাইকেল চালকরাই অতি বেপরোয়া হয়ে থাকে। প্রথম আলোর সেই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বরাত দিয়ে বলা হয়, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩১ লাখের বেশি, যা মোট যানবাহনের ৬৮ শতাংশ। শুধু ঢাকাতেই নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ৮ লাখের মতো। এর বাইরে একটি বড় অংশের মোটরসাইকেল অনিবন্ধিত। বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় ৫ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়।

মোটর বাইকারদের বড় একটা অংশ তরুণ। এসব তরুণদের মধ্যে একটা আবেগ থাকে। থাকে এক ধরনের পাগলামো স্বভাব। দূরন্ত গতিতে মোটরসাইকেল চালানোর একটা নগ্ন প্রতিযোগিতা করার মানসিকতা তাদের বেশির ভাগই লালন করে। যেটা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করি। কিছু তরুণ বাইকার আছে তাদের ইমোশন এবং মোটর বাইকের গতি দুটির একটাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, ফলে অকালে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হয় তাদের।
কয়েকদিন আগের কথা। আমি টেম্পো গাড়ির পিছনে বসে আছি। দুরন্ত গতিতে ছুটে আসছে একটি মোটরসাইকেল। চালক একজন দামাল ছেলে। বাতাসের গতিতে ছুটছে তার মোটরবাইক। তার মাথায় যেমন হেলমেট নেই, তেমনি মুখে মাস্কও নেই। ব্যস্ততম নগরীর যানবাহনে ঠাসা সড়কে তাকে এমনভাবে বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালাতে দেখে আমি অবাক হইনি, অবাক হয়েছি চলন্ত অবস্থায় তাকে এক হাতে মুখে মাস্ক লাগাতে দেখে। হ্যাঁ, ছেলেটা একহাতে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল আর অন্যহাতে মুখে মাস্ক লাগাতে চেষ্টা করছিল। না, কোনোমতেই মুখে মাস্ক লাগাতে পারছিল না। তারপর স্টিয়ারিং ছেড়ে দিয়ে চলন্ত অবস্থায় দুহাতে মাস্ক লাগাচ্ছিল; ঠিক তখনি স্টিয়ারিং ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয় সে। দ্রুত মাস্ক ছেড়ে দিয়ে স্টিয়ারিং ধরল। মাস্ক উড়ে গেল বটে তবে ভারি দুর্ঘটনা ঘটেনি। এই যে অসতর্কতা, অসচেতনতা; এমন অসচেতনতা ও অসতর্কতাই মৃত্যু ডেকে আনে।

যেকোনো যানবাহনের মতো মোটরসাইকেল চালকরাও বেশি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চলন্ত গাড়িতে মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণে। গাড়ি চালানো অবস্থায় চালক মোবাইল ফোনে কথা বলার এ দৃশ্য অন্য কোনো দেশে দেখা যায় কিনা আমার জানা নেই তবে আমাদের দেশে এ দৃশ্য স্বাভাবিকতায় রূপ নিয়েছে।

বছর দুয়েক আগে দৈনিক আজাদীতে এমন এক করুণ মৃত্যুর খবর পড়েছিলাম। ক্লাস টু ও থ্রি পড়ুয়া দুই ভাইবোনকে মোটরসাইকেলে বসিয়ে সকালবেলা স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছিল বড় ভাই। মোটরসাইকেল চালক সেই ভাইটা পড়ত ক্লাস এইটে। বয়স কত হবে তার? তেরো কিংবা চৌদ্দ। হ্যাঁ, এমন কিশোর ছেলেকে মোটরসাইকেল ধরিয়ে দেয়নি কেবল, বরং দুটি শিশুকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও চাপিয়ে দিয়েছিল তার পরিবার। পিছনে শিশুদের বসিয়ে মহাসড়ক দিয়ে যাতায়াতকালে ছেলেটি একহাতে ফোনে কথা বলছিল। কথা বলে এলোমেলো চালাতে গিয়ে ঘটে দুর্ঘটনা রাস্তায় ঝরে গেল তিন তিনটে প্রাণ।
নগরীতে রাত-বিরাতে চলতে গিয়ে কিছু ফ্যামিলি সার্ভিস দেখতে পাই। একটি মোটরসাইকেলে স্বামী, স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে একসঙ্গে চেপে বসে শপিংমল কিংবা কমিউনিটি সেন্টারে যাতায়াত করে। ফ্যামিলির সব সদস্য বহনকারী এমন মোটরসাইকেলের নাম দিয়েছি ফ্যামিলি সার্ভিস।

কিছুদিন আগেও দেখলাম কনকনে শীতের রাতে নিরাপত্তার কোনো সরঞ্জাম ছাড়াই একটি মোটরসাইকেলে চেপে বসেছে পাঁচজন। বাবা মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। বাবার সামনে বড় ছেলে, মাঝখানে মেয়ে পিছনে মা এবং মায়ের কোলে ছোট্ট শিশু। এ ফ্যামিলি সার্ভিসে কেবল বাবার মাথায় হেলমেট। তার মানে বাবা বাঁচতে পারলেই হবে। বৃক্ষ বাঁচলে ফলের কীসের অভাব হয়তো এমন মনোভাব!

এসব দেখে ভাবতে যাই, এরা কি টাকা নাকি সময়কে গুরুত্ব দিতে গিয়ে এমন হুমকির মুখে পা বাড়ায়? এদের কাছে জীবন বুঝি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আরেকটি কারণ হলো হেলমেট। যদিও শহরাঞ্চলে হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক করতে সক্ষম হয়েছে কিন্তু গ্রামাঞ্চলে বাইকাররা এখনো হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক মনে করছে না।

বিশেষ করে রাইড শেয়ারিং করা চালকরা তাদের যাত্রীদের যথাযথ হেলমেট দেয় না। প্রথম আলোর করা সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, বুয়েটের এআরআই ২০২০ সালে রাইড শেয়ারিংয়ের ৪৫০ মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীর ওপর একটি জরিপ করে। এতে উঠে আসে, ৫০ শতাংশ আরোহী চালকের চালানো নিয়ে অনিরাপত্তায় ভোগেন। একই সংস্থার করা আরেক জরিপে এসেছে, চালকের ৩০ শতাংশ অতি নিম্নমানের হেলমেট পরেন। মাত্র ২ শতাংশের ক্ষেত্রে আরোহীদের ‘ফুলফেস’ হেলমেট দেওয়া হয়।

মোটরসাইকেল এমন এক যানবাহন, যেটা সতর্কতার সঙ্গে নিয়ম মেনে চালাতে পারলে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। আর অনিয়ম, অসচেতনতা ও অসতর্কভাবে চালালে দ্রুত কবরে পৌঁছে দেবে। তাই মোটর বাইকার বিশেষ করে তরুণ বাইকারদের উচিত হবে নিয়ম মেনে সতর্কতা ও সচেতনতার সঙ্গে মোটরসাইকেল চালানো। নিজে বাঁচুন এবং অন্যকে বাঁচান।

মুহাম্মদ রমিজ উদ্দিন : গল্পকার; শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 
Electronic Paper