ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বহুমাত্রিক প্রতিভায় প্রোজ্জ্বল চেমন আরা

এনাম রাজু
🕐 ১০:২৭ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২১

বহুমাত্রিক প্রতিভায় প্রোজ্জ্বল চেমন আরা

দিনটা ছিল বুধবার। কবি ও প্রকাশক এনাম রেজার ফোন-কলে ঘুম ভাঙে। তিনি বললেন, দ্রুত বনানীতে চলে আয়। কোনো কথা না বাড়িয়ে বললাম, ঠিক আছে। এবার জিজ্ঞেস করলেন, কতক্ষণ লাগতে পারে? এই তো ত্রিশ মিনিট। সকালে রাস্তায় যানজট থাকে না। দ্রুত আসতে পারব। বনানীতে দুজনেই নাস্তা করব। এই বলে ফোনটা রেখে তাড়াতাড়ি বের হলাম। রাস্তা ফাঁকা। কিশোরী সূর্যের আগমনী বার্তা দিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি। হালকা শীত পড়ছে, গাড়ির জানালা দিয়ে ঢোকা বাতাসে ঠাণ্ডা লাগছে। হালকা বাতাসে চুলগুলো উড়ছে ঠিকই কিন্তু শীতের পোশাক না থাকায় ঠাণ্ডাকে বেশ উপভোগ করছি।

বাসস্ট্যান্ডে আগে থেকেই ছিলেন এনাম ভাই। কী এমন জরুরি কাজ যে এত সকালে ডাকলেন? গত দু’বছরে এই প্রথম ছয়টার মধ্যে ঘুম ভাঙল। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, তাই নাকি! চল কথা না বলে। পাঁচ মিনিটের মতো হেঁটেই পৌঁছে গেলাম বাংলাসাহিত্যের অমর কথাশিল্পী শাহেদ আলীর বাসায়। প্রথমে আঁচ করতে না পারলেও তিনি রুমে ঢোকার আগেই বলে দিলেন- ভাষাসৈনিক, কবি ও গল্পকার চেমন আরা আপার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। এটা তার বাড়ি। এসেছি তোকে পরিচয় করিয়ে দিতে। শুনেই মনটা খুশিতে নেচে উঠল। বাসায় ঢুকেই গৃহকর্মীকে এনাম ভাই বললেন, আপাকে বলেন, আমি এসেছি।
বলার ভঙ্গি দেখে মনে হলো, আগেও এসেছেন অনেকবার।
অল্প সময়ের মধ্যে চেমন আরা এলেন। খুব হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষ। দেখে মনে হলো বয়স সত্তরের কাছাকাছি। এনাম ভাই কানে কানে বললেন, বয়স কিন্তু বিরাশি। দেখে কি মনে হয়? মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম, না। সেদিন একঘণ্টা গল্প হলো, নানান বিষয়ে গল্প শেষে ফোন নম্বর নিলাম। দিলাম আমার নম্বরও। তারপর থেকে নিয়মিত যাতায়াত। বর্তমানের তরুণ সাহিত্যকর্মীরা যে পড়াশোনা কম করে সেই বিষয়ে তার হতাশার অন্ত নেই। আক্ষেপ করে বলেন, দোষ তো আমাদের, তাই তোমরা তরুণরা আজ বইবিমুখ। খুব স্বল্প ভাষায় সাহিত্যের সকল অঙ্গনের প্রায়ই ধারণা দিতেন আমাকে। অধ্যাপক চেমন আরা ১৯৩৪ সালের ৫ মে তারিখে চট্টগ্রামের সম্ভ্রান্ত ‘চাটগাঁ মৌলভীবাড়ি’তে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা এএসএম মোফাখখার, মাতা দোরদানা খাতুন।

শিক্ষা
মায়ের কাছে প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। ১৯৪১ সালে চট্টগ্রাম শহরের গুলএজার বেগম স্কুলে ভর্তি হন। কয়েক বছর পর পিতার কর্মস্থল কলকাতায় চলে যান ও আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম গার্লস হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকায় চলে আসেন ও সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন নাজিম উদ্দিন রোডস্থ মুসলিম গার্লস হাইস্কুলে। ১৯৪৯ সালে তিনি কামরুন্নেসা উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ১৯৫১ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা ইডেন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ অনার্স শ্রেণিতে। তিনি সে সময়ে তিন সন্তানের জননী। ১৯৫৬ সালে বাংলায় বিএ অনার্স ও পরের বছর এমএ পাস করেন।

কর্মজীবন ও শিক্ষকতা
এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের পূর্বে নারায়ণগঞ্জের নবীগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেন এবং ১৯৫৯ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৯ সালে চট্টগ্রামের শিক্ষাবিদ বাদশা মিয়া চৌধুরীর চেষ্টায় প্রথম মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সেখানে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনার দায়িত্বে পায়। ১৯৬১ সালে সরকারি ঢাকা কলেজে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালের মাঝামাঝি বদলি হয়ে ইডেন সরকারি মহিলা কলেজে আসেন। ১৯৬৯ সালে বদরুন্নেসা সরকারি গার্লস কলেজে বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন। পরে ১৯৭০ সালে তিনি আবার ইডেন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮২-৮৬ পর্যন্ত চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

ভাষা আন্দোলন ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদান
১৯৪৭ সালে চেমন আরা সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী থাকা অবস্থায় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটলে তিনি তাতে অংশগ্রহণ করেন। দশম শ্রেণিতে পড়াকালে ১৯৫০ সালে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম তাত্ত্বিক সংগঠক ও সাহিত্যিক অধ্যাপক শাহেদ আলীর সঙ্গে চেমন আরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৪-৫৫ সালে গঠিত ‘ছাত্রী পরিষদ’-এর সভাপতি নিযুক্ত হন।

সাহিত্যচর্চা
অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালে চেমন আরার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সৈনিকে। এরপর সাপ্তাহিক সৈনিক, চট্টগ্রামের সাপ্তাহিক কোহিনুর, কলকাতা থেকে আবদুল আজিজ আল আমান সম্পাদিত কাফেলাসহ সকল পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। কোহিনুর পত্রিকায় তিনি ‘নাসরিন’ ছদ্মনামে লিখতেন। এ পর্যন্ত তার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑ হৃদয় নামের সরোবরে (গল্পগ্রন্থ); ঘরে ফেরা; ওমরা হজ্বের স্মৃতি; কান্না হাসির এই মেলায়; স্বাগত ভাবনা; নিরুদ্দেশের অভিযাত্রী; সত্তরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। শিশুতোষ গ্রন্থÑ বাবুর ফুলের বাগান; সিলমির প্রথম পাঠ; তানিয়ার যতো কথা। সম্পাদনা করেন- অনন্য জীবনসাধক (এ এস এম মোফাখ্খার) ইয়াদগারে বখতিয়ার; সহজ মিলাদ পাঠ; সুচরিতা (মহিলাদের ঘরোয়া মাসিক পত্রিকা) ও শাহেদ আলী স্মারকগ্রন্থ।

স্বীকৃতি ও সম্মাননা
অধ্যক্ষ চেমন আরা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদান, শিক্ষকতা, সাহিত্য-সেবা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চা এবং অবহেলিত নারী ও শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে অবদানের জন্য কয়েকটি সম্মাননা ও স্বীকৃতি লাভ করেন।

২০০৪ সালে মহিলা সাংবাদিক ফোরাম পুরস্কার; ২০০৪ সালে ফুলের মেলা জাতীয় শিশু সংগঠন পুরস্কার; ২০০৬ সালে কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার; ২০০৭ সালে চিলড্র্রেন অ্যান্ড উইমেন ভিশন ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক; ২০০৮ সালে নবীন কণ্ঠ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পুরস্কার; ২০০৮ সালে জালালাবাদ ফাউন্ডেশন কর্তৃক হাসন রাজা সম্মাননা। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী মানুষটি এখন ছিয়াশি বছর বয়সে অবস্থান করছেন। তিনি গত একমাস অসুস্থ ছিলেন; গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন। এখন আগের তুলনায় সুস্থ। তার দীর্ঘ জীবন প্রত্যাশা করি। সেই সঙ্গে সুস্থতা কামনা করি, সকলের কাছে তার সুস্থতার জন্য দোয়া প্রার্থনা করি।

ভাষার মাসে আমরা বাংলা ভাষাকে নিয়ে যতটা না চর্চা করি তার চেয়ে বেশি চর্চা একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটাকে ঘিরে। বাংলা ভাষাকে অবশ্য এখন আর চর্চার মধ্যে রাখারও কিছু তেমন কিছু নেই। ভাষাচর্চার ভার এখন শুধু সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের ওপর। সাহিত্যিকরাও যেন এখন দায়সারা কাজ করতে অভ্যস্ত। তাই বিশেষ দিন ছাড়া ভাষা ও ভাষার জন্য যারা নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ করেছে সে কথা বলা বা লেখা সময়ের অপচয় মাত্র। অধ্যাপক চেমন আরা আজও বাংলা ভাষাকে ধারণ করে বেঁচে আছেন। একজন মানুষ কতটা আত্মবিশ্বাসী ও প্রাণশক্তির অধিকারী হলে ৮৫ বছর বয়সেও লিখে যাচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের নানান শাখায়। কিন্তু দুঃখ হলো, বাংলা ভাষার জন্য যে ক’জন মানুষ রাজধানীতে আন্দোলন করেছেন, পোস্টার, ব্যানার তৈরি করেছেন তাদের অধিকাংশই একুশে পদক বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন। সেই তালিকায় অধ্যাপক চেমন আরা অবহেলিত। অথচ ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই সৈনিক পত্রিকায় তিনি বাংলা ভাষার পক্ষে লিখেছেন কবিতা।

নিজেই প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের সঙ্গে ভাষা আন্দোলন করেছেন। তার বাবাও ছিলেন তমুদ্দুন মজলিসের অর্থদাতা ও পরামর্শদাতা। তবুও তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে অনেক দূরে। ভাষার মাসে নিশ্চয়ই বিবেকবানদের হৃদয়ে ক্ষরণ হবে, তার মতো একজন বহুমাত্রিক প্রতিভাকে আমরা সম্মান জানাতে অক্ষম বলে।

এনাম রাজু : কবি ও ছোটকাগজকর্মী
[email protected]

 
Electronic Paper