ক্যাম্পাস কি স্থানীয়দের!
সাজ্জাদ হোসেন
🕐 ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২১
আমি যখন প্রথম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়াতে ভর্তির সুযোগ পেলাম- অনেকেই বলতেন স্থানীয় কোনো বড় ভাইয়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে। তিনি ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী হতে পারেন কিংবা বহিরাগত। এর পিছনের প্রধান কারণ বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যুষিত এলাকায় যেকোনো ধরনের ঝামেলায় বড় ভাই দেয়াল হয়ে দাঁড়াবেন। যাকে সচরাচর ব্যাকআপ বলা হয়। সেসব সিনিয়র ভাই-বন্ধুরা, অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে দাঁড়ান পূজনীয় মানুষ। এ পূজা ভয় থেকে করা। দেবী মনসা যেমন ভক্তের কাছ থেকে পূজা জোর করে আদায় করে নিয়েছিলেন- ঠিক তেমন পূজা। তারা হয়ে ওঠেন সাধারণ থেকে অনন্য সাধারণ। তারা যে অনন্য সাধারণ এ নিয়ে কেউ ভেবেছেন কিনা, পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে আমি বেশকিছু দৃষ্টান্তের মাধ্যমে তা প্রমাণ করার চেষ্টা করব।
কয়েক দিন আগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর যেভাবে বর্বর হামলা হয়; এতে করে পুরো ছাত্রসমাজের বুক কেঁপে ওঠে। বরিশাল নগরীর রুপাতলী হাউজিংয়ে গভীর রাতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মেসে হামলা চালায় পরিবহন শ্রমিকরা। হামলায় অন্তত ১১ শিক্ষার্থী আহত হন। আমরা জানি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এখান থেকে শুধু উন্নত নাগরিকই নয় বরং দেশ পরিচালনায় নেতা, আমলা থেকে শুরু করে উচ্চস্তরের নানান পেশাজীবীরা বের হয়। তাদের নিরাপত্তা নিয়ে যদি বারবার প্রশ্ন ওঠে; তাহলে জনসাধারণ কোন আলো নিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশা করবে!
কেবল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় নয় আরও সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা স্থানীয়দের আক্রমণের শিকার হয়। ক্যাম্পাস সংলগ্ন এলাকা গেরুয়ায় স্থানীয় লোকজন শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন ছাত্র গুরুতর আহত হয়েছেন। সেখানে মসজিদের মাইকে ঘোষণা করে লোকজনকে ডেকে এনে এই ঘটনা সৃষ্টি করা হয়। শিক্ষার্থীদের কয়েকটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এমনকি অনেকজনকে মেসের মধ্যে আটকে রাখা হয়। এই ক্ষমতাবলের অন্য কোনো উৎস নেই। উৎসটি অনেকটা ‘জোর যার মুলুুক তার’ কথাটির মতো।
গত বছরে ময়মনসিংহ শহরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তৌহিদুল ইসলামকে মেসে প্রবেশ করে নৃশংসভাবে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। হত্যার রাতে তৌহিদুল সেহেরীর জন্য টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখেছিলেন। এই হত্যাকা-ে শুধু শিক্ষার্থী গোষ্ঠী নয়, পুরো দেশের মানুষের বিবেকে কড়া নেড়েছিল। পুলিশ জানায় হত্যাকারী ছিলেন এলাকার পেশাদার চোর ও মাদকসেবী। এমন অসংখ্য অপ্রত্যাশিত ঘটনার দৃষ্টান্ত, প্রত্যেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আলোচনা করা যাবে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতের আনাগোনা খুবই সাধারণ ব্যাপার। ছাত্রীদের হলের সামনে বখাটেদের মোটরসাইকেল শোডাউন, শিস দেওয়াসহ নানান অঙ্গভঙ্গিতে ইভটিজিং করা নিয়ে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সংবাদ প্রতিবেদন হয়েছে।
কখনো কখনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেই স্থানীয়দের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর নাসির উদ্দিন নিজেই, ছাত্রদের হামলা প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে এলাকার মাস্তানদের ব্যবহার করতেন। এসব গুণ্ডা -মাস্তানদের অত্যাচারে অনেক সময় ক্যাম্পাসের অবকাঠামো নির্মাণকাজ অব্যাহত থাকে। বিষয়টির কারণ শ্রমিক ও অন্যান্য কাজে তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নিয়োগ না দেওয়া। দেশের ঢের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শহর থেকে দূরের এলাকাগুলোয়। যাকে অজপাড়াগাঁ বলা চলে। গ্রামে সাধারণত সবাই পরস্পর একতাবদ্ধ। তাই, কোনো ঝগড়া-বিবাদ বাঁধলে ন্যায়-অন্যায় বিচার না করে পূর্বেই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। তবে এর জন্য প্রশাসনের সুদৃষ্টি যেমন কাম্য- তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যারা দায়িত্বে আছেন তাদেরও কাম্য। তাদের অনেক ক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা দেখা যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার দীর্ঘ সময় পার হলেও পুলিশ ও প্রশাসন কেউ তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হননি। পুলিশ কেবল দুই পক্ষকে সমঝোতার মাধ্যমে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছে। অথচ, তারা চাইলে বিকল্প উপায়ে এমন উৎপাত নির্মূল করতে পারতেন। সেই সক্ষমতা তাদের রয়েছে।
আলোচনা যেহেতু প্রশাসন পর্যন্ত চলে এসেছে, সেহেতু রাজনীতি সম্পর্কেও পর্যালোচনা করা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু সমন্বয়ে বাধা প্রদান করি আমরাই। রাজনীতিতেও পাবলিক ক্যাম্পাসগুলো পুরনো ট্রেন্ড আঁকড়ে ধরে রয়েছে। স্থানীয় রাজনীতি আমাদের এমন করে মিশে গিয়েছে, যা ক্ষমতাশীল ছাত্র সংগঠনের দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়। প্রতিবার কমিটি হয় ঠিকই, কিন্তু প্রধান নেতৃবৃন্দ নির্বাচিত হয় স্থানীয় শিক্ষার্থীরা। এটা যেন একধরনের প্রথা হয়ে থাকে। যখন কোনো ব্যতিক্রম দেখা যায়; খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। এর একমাত্র কারণ বহিরাগত স্থানীয় শক্তি। আমার এই প্রসঙ্গের উদ্দেশ্য, স্থানীয় ছাত্রদের ছোট করা নয়; আবার তাদের অযোগ্য প্রমাণ করার কোনো মোটিভও দিইনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় যে একটা উর্বর ভূমি, যেখানে উন্মুক্ত চর্চা হয়, সবার সমান অংশগ্রহণ থাকে, সেই বিষয়টিই বুঝিয়েছি। নইলে আহমেদ ছফার উপন্যাস গাভীবৃত্তান্ত’র মতো ব্যাপারটি হয়ে যাবে। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টিতে জোর প্রদান করা উচিত। এর জন্য প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বসে সুরাহা করতে পারে। বিশেষত, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শহর থেকে দূরে অবস্থিত- সেসবে পুরোপুরি আবাসন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। নইলে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকবে। পূর্ণাঙ্গ আবাসস্থল না থাকায়, শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ থাকে শহরে। তাদেরকে প্রয়োজনে ক্যাম্পাসে আসতে অনেক সময় পাবলিক বাসে চড়তে হয়।
সেখানে তুচ্ছ ব্যাপারকে কেন্দ্র করে বাস স্টাফদের দ্বারা শিক্ষার্থী হেনস্তার কথা প্রায়ই শোনা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে বসবাসরত স্থানীয়রা যেমন এদেশের জনগণ, তেমনি শিক্ষার্থীরাও নাগরিক। এ রচনার উদ্দেশ্য পুরো স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে মন্দরূপে তুলে ধরা নয়, বরং তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা জীবিকার তাগিদে হোক আর পকেট রক্ষার জন্য হোক শিক্ষার্থীদের অভিমুখে ওত পেতে থাকে। সুযোগ পেলে সন্ত্রাসী হামলা করতেও পিছপা হয় না। তাই শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। ছাত্র-ছাত্রীদের মন থেকে অপশক্তির ভয় দূর হোক, প্রত্যেক ক্যাম্পাস নিরাপদ হয়ে উঠুক।
সাজ্জাদ হোসেন : কলাম লেখক ও গল্পকার
[email protected]