আত্মবিশ্বাসই সবচেয়ে বড় চিকিৎসা
জেসমিন চৌধুরী
🕐 ১০:১৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৮
যারা সায়াটিকার পেইনে ভুগছেন তাদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার ইচ্ছা অনেক দিনের। কোমরের নিচের দিকের নার্ভে চাপ পড়ার কারণে পিঠে, কোমরে বা পায়ে যে ব্যথা হয় তাকেই সায়াটিকা বলে।
২০০২ সালে আমি প্রথম এ ব্যথা অনুভব করি। প্রথমে কোমরে হালকা একটা ব্যথা শুরু হলে খুব একটা পাত্তা দিইনি, কিন্তু ব্যথাটা যখন বারবার ফিরে আসতে লাগল এবং প্রতিবার ব্যথার মাত্রা এবং দৈর্ঘ্য বাড়তে লাগল তখন একটু চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। এক্স-রে করে কিছুই পাওয়া গেল না। তখন সিলেটের মেডিসিনের একজন বিখ্যাত ডাক্তার ছিলেন ফয়সল আহমেদ (উনার নামটা সঠিক মনে করতে পারছি না, অন্য কিছুও হয়ে থাকতে পারে)।
ডাক্তার সাহেব আমার সব উপসর্গের কথা মন দিয়ে শুনলেন। আমাকে দাঁড় করিয়ে নানাভাবে নড়াচড়া করিয়ে পরীক্ষা করলেন। উনি আমার চেয়ে কমপক্ষে ছয় ইঞ্চি খাটো ছিলেন, তার উচ্চতা পাঁচ ফুটেরও কম হয়ে থাকতে পারে। তিনি যখন মুখ উঁচু করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এ রোগের নাম লাম্বাগো, সাধারণত লম্বা লোকদের হয়ে থাকে’। আমার কেন যেন মনে হলো তার চেয়ে অনেক বেশি লম্বা একজন মানুষকে এ খবরটা দিতে পেরে তিনি কিছুটা হলেও আনন্দ পেয়েছেন। আমার ধারণা সম্পূর্ণরূপে ভুলও হতে পারে, তবে এত দিন ধরে বাঙালি নারী হিসেবে নিজের ‘এবাভ এভারিজ’ উচ্চতার জন্য প্রশংসা থেকে যে আনন্দটুকু পেয়ে আসছিলাম তার বিন্দুমাত্রও আর মনের মধ্যে রইল না। লম্বা হওয়াকে একটা অভিশাপ বলে মনে হতে লাগল।
এবারও এক্স-রে রিপোর্টে ব্যথার কারণটা পিনপয়েন্ট করা গেল না। ডাক্তার সাহেব বললেন ব্যথা বেশি হলে প্যারাসিটামল খেতে। আমার একটা ধারণা জন্মেছিল এভাবে প্যারাসিটামল খেতে থাকলে এক সময় তা গায়ে সয়ে যাবে, বুড়া বয়সে যখন অনেক ব্যথা-বেদনা হবে, তখন প্যারাসিটামলেও আর কাজ হবে না। কাজেই দিনের পর দিন প্যারাসিটামল না খেয়েই ব্যথা সহ্য করে যেতে থাকলাম। এক দিন ব্যথা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেলে প্যারাসিটামল খেয়েও কাজ হলো না। আবার একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো আমাকে। তিনি প্রেসক্রিপশনে একটা ইনজেকশনের নাম লিখে দিলেন, বললেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেটা নিয়ে আসতে এবং ততক্ষণ ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ডাক্তার সাহেব, এ ইনজেকশনে কি আমার অসুখটা আসলে কমবে?’
তিনি বললেন, ‘ব্যথাটা কমবে’।
‘চিরদিনের জন্য?’
‘সেই নিশ্চয়তা তো দেওয়া যাচ্ছে না, তবে আপাতত কমবে।’
‘ব্যথা কীভাবে কমে বলেন তো?’
‘অনুভূতিকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অবশ করে দিয়ে।’
‘কিন্তু সেটা তো আমার জন্য খারাপও হতে পারে?’
ব্যথায় কাতরাচ্ছে এমন একজন রোগীর মুখে এ জাতীয় প্রশ্ন সম্ভবত ডাক্তার সাহেবকে একাধারে বিরক্ত এবং বিস্মিত করল। তিনি গলা খাদে নামিয়ে বললেন, ‘আপনার মতো সচেতন রোগী আমরা খুব বেশি পাই না। রোগী যখন ব্যথা নিয়ে আসে, হাইডোজের পেইনকিলার একটা ইনজেকশন দিয়ে ব্যথাটা তাৎক্ষণিকভাবে কমিয়ে দিতে পারলে তারা ভাবে ডাক্তার সাহেব ম্যাজিক জানে, এতে আমাদের পসার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু আপনি ঠিকই বলেছেন, এ জাতীয় ইনজেকশন লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করে। যদি ব্যথাটা সহ্য করে নিতে পারেন, তাহলে ইনজেকশন না নেওয়াই ভালো।’
ডাক্তার সাহেবের সততায় মুগ্ধ হলেও আমি ব্যথা সহ্য করার সিদ্ধান্তই নিলাম। ইনজেকশনটা না নিয়েই ফিরে এলাম। এ ব্যাপারে আমার নিজস্ব একটা থিওরি ছিল। ইনজেকশনের প্রভাবে অবশ হয়ে যাওয়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়ার ব্যাপারে আমি যথেষ্ট সতর্ক থাকব না, ফলে মূল সমস্যাটা আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
একপর্যায়ে কোমরের ব্যথায় আমার স্বাভাবিক জীবন এবং দৈনিক কর্মকাণ্ড এতটাই ব্যাহত হয়ে পড়ল যে ব্যথার কারণ নির্ধারণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ঢাকায় এমআরআই করাতে গেলাম। এবার ঘটনাটা পরিষ্কার বোঝা গেল। এত দিন পর সমস্যার খুঁটিনাটি ঠিক মনে করতে পারছি না, তবে আমার লাম্বার ফাইভ অর্থাৎ মেরুদণ্ডের পাঁচ নাম্বার জয়েন্টের জেলিতে একটা সমস্যার কারণে লাম্বার ফাইভের নার্ভে ক্রমাগত চাপ পড়ার কারণে ব্যথাটা হচ্ছিল। তত দিনে ব্যথাটা আমার নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি মুহূর্তেই হালকা একটা ব্যথা অনুভূত হচ্ছিল এবং মাঝেমধ্যে তা এত প্রকট হয়ে দাঁড়াচ্ছিল যে তখন কোনো কাজকর্ম করা তো দূরের কথা, সোজা হয়ে হাঁটতেই পারছিলাম না।
একের পর এক বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলাম। তাদের সবাই এক বাক্যে এক মাস নির্বিঘ্ন বেডরেস্টের পরামর্শ দিলেন। আমার মাতৃসম বড় তিন বোন আমাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এক মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে আমাকে বাধ্য করলেন। বাচ্চাদের স্কুলে আনা-নেওয়া, আমার সংসারের দায়িত্ব, আমাকে গোসল করানো, খাওয়ানো সব দায়িত্ব বুয়ার সাহায্যে তারাই পালন করলেন। এক মাস বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি অসংখ্য বই পড়লাম। জ্ঞান অর্জন ভালোই হলো, কিন্তু এক মাস পর যখন বিছানা থেকে নামলাম তখন মনে হলো আমি হাঁটতেই ভুলে গেছি। ব্যথাটাও দ্রুতই ফিরে এলো।
তখন থেকে কোমরের ব্যথাটাই যেন হয়ে উঠল আমার একমাত্র পরিচয়। দেখা হলেই সবাই কোমরের ব্যথার কথা জানতে চায় যেন আমার জীবনে আর কিছু নেই। বান্ধবীদের বৃদ্ধ মা-বাবারা আমার সঙ্গে তাদের নিজেদের বার্ধক্যজনিত ব্যথা-বেদনার গল্প করেন, আমার মন খারাপ লাগে। আমার বয়স মাত্র বত্রিশ, এই বয়সে কি আমার এসব গল্প করবার কথা ছিল?
আবার শুরু হলো ডাক্তারদের কাছে ছোটাছুটি। এমআরআই রিপোর্ট দেখে ডাক্তাররা বললেন অপারেশন করাতে হবে। অপারেশন করে কীভাবে সুস্থ হয়ে উঠব, পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা কেউ ঠিকমতো ব্যাখ্যা না করায় আমি তাদের পরামর্শে আস্থা রাখতে পারলাম না। এ সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কিছুটা অর্থ সমাগম হওয়ায় ঠিক করলাম চিকিৎসার জন্য বাইরের কোনো দেশে যাব। আমার এক কলিগের পরামর্শ অনুযায়ী থাইল্যান্ডের বুমরুংগ্রাদ হাসপাতালে গেলাম।
বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া এমআরআই রিপোর্ট তারা না দেখেই নাকচ করে দিল। নিজেরাই নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালো আমার লাম্বার ফাইভের জেলিটা শুকিয়ে গেছে অথবা স্ট্রাকচারটা ভেঙে গেছে বিস্তারিত বিবরণ এখন আর আমার স্পষ্ট মনে নেই ফলে নার্ভের ওপর চাপ পড়ছে এবং সেজন্যই ব্যথাটা হচ্ছে।
অপারেশন করলে কি সমস্যাটার সমাধান হবে? জানতে চাইলে তারা বলল ফিফটি ফিফটি। কমতেও পারে, আবার নাও কমতে পারে। বরং চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার একটা শঙ্কাও আছে। বুমরুংগ্রাদ হাসপাতালের ডাক্তাররা চাইলেই এ অপারেশনটা করে আমার কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে পারত কিন্তু তারা আমাকে এ ঝুঁকিটা না নেওয়ারই পরামর্শ দিল। ডাক্তাররাও তবে মানুষ হতে পারে? তাহলে ঘটনাটা কী দাঁড়াচ্ছে? সারা জীবন এ ব্যথাটা নিয়েই আমাকে বাঁচতে হবে? বিশেষজ্ঞরা বললেন ঠিক তাই। এ ব্যথাটা নিয়েই আমাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে, কিন্তু আমি যতটা খারাপ ভাবছি বিষয়টা ততটা খারাপ নাও হতে পারে। ব্যথার সঙ্গে সখ্য করতে শিখতে হবে। পুরোটাই মাইন্ডসেট এবং লাইফস্টাইলের ব্যাপার। তারা আমাকে প্রচুর পরামর্শ দিলেন শক্ত বিছানায় ঘুমাতে হবে, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে- সুইমিং করলে ভালো হয়, যে কোনো পজিশনে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না- অর্থাৎ একটানা বিশ মিনিটের বেশি বসা বা দাঁড়ানো ঠিক নয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে মনোবল রাখতে হবে, মনে রাখতে হবে ব্যথাটাই সবকিছু নয়, ব্যথা নিয়ে বেশি চিন্তাভাবনা না করাই ভালো। যেহেতু এটা আমার সঙ্গেই থাকবে, একে যথাসম্ভব কম পাত্তা দিলেই ভালো। নিয়মিত মেডিটেশন করলে উপকার পাওয়া যেতে পারে।
এসব উপদেশ নিয়ে কিছুটা ভগ্নমনে দেশে ফিরে এলাম। সবাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী অবস্থা এখন?’
আমি বললাম, ‘ব্যথাটা কমে গেছে।’
‘তাই নাকি? কী চিকিৎসা করালে?’
‘যা যা প্রয়োজন সবই করিয়েছি। এখন আর ব্যথাটা নেই।’
ডাহা মিথ্যা কথা! ব্যথাটা তখনো পুরাদমেই ছিল, কিন্তু আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম, কারও সঙ্গে এ নিয়ে আর আলোচনায়ই যাব না। কাঠের দোকানে অর্ডার দিয়ে একটা শক্ত বিছানা বানালাম। সাঁতার কাটতে জানি না তবু সাত মাইল দূরের সিলেট ক্যান্টনমেন্টের সুইমিং পুলে নিয়মিত সুইমিং করার ব্যবস্থা করলাম। রেইলে ধরে হাত পা ছোড়াছুড়ি করি, ডাক্তার বলেছে এতেও লাভ হবে।
মেডিটেশন করতে শুরু করলাম, মনোবল সত্যিই বেড়ে গেল। মনে হলো আমি চাইলে সব পারি, ব্যথা টেথা কিছু না। এক দিন সুইমিংপুলে হাত-পা ছুড়তে গিয়ে দেখি আরে, আমি তো রীতিমতো পানিতে ভাসছি। কেমন করে অবলীলায় সাঁতার কাটতে শিখে গেলাম সেও এক রহস্য। সম্ভবত নিয়মিত মেডিটেশনলব্ধ আত্মবিশ্বাসের সুফল।
তারপর ১৬ বছর কেটে গেছে। এ ১৬ বছরের মধ্যে একটা সেকেন্ডও ব্যথাহীন মুহূর্ত কাটেনি আমার, কোমরের ব্যথাটা সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে আছে। কিন্তু যারা আমাকে বাউল গানের সঙ্গে পাগলের মতো নাচতে দেখেন, ১০ কেজি ওজনের চালের বস্তা অনায়াসে বইতে দেখেন, দিনভর পাগলের মতো কাজ করতে দেখেন, জিমে গিয়ে এক সিটিং এ পাঁচশ কেলোরি পুড়াতে দেখেন তাদের জন্য বিশ্বাস করা কঠিন যে আমি একজন সায়াটিকা রোগী। এ রোগ আমৃত্যু আমার সঙ্গী, কখনোই আমাকে ছেড়ে যাবে না।
এখন আমার বয়স সাতচল্লিশ। নিয়মিত ব্যায়াম করি, দিনভর পরিশ্রম করি, অনেকের থেকেই সুস্থ আরামদায়ক জীবন বাঁচি। কিন্তু এ সবকিছুর পেছনে ব্যথাটা আছে। প্রায়ই জানান দিয়ে যায়-‘আমি আছি’। আমিও বলি, ‘থাকলে থাকো। আমি থোড়াই কেয়ার করি!’
জেসমিন চৌধুরী : কলাম লেখক ও অনুবাদক।
[email protected]