ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন ভাবনা

আবু আফজাল মোহা. সালেহ
🕐 ১০:০৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৮

স্থানীয়ভাবে জনশ্রুতি আছে, ভাগ্যবানরা দেশের দক্ষিণে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বাস করে আর সবচেয়ে দুর্ভাগারা বাস করে উত্তরবঙ্গে। লালমনিরহাটে চাকরির সুবাদে একথা মেনে নিতে হয়। এখন কিন্তু ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে এ অঞ্চলে। মঙ্গা নেই বললেই চলে। বেশ কয়েকটা সেতু হয়েছে। কিন্তু আগের পিছিয়ে পড়া অংশ পূরণ করে উন্নয়নের মূলধারায় আসতে ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এগিয়ে যেতে হবে। একটা পরিসংখ্যান দেই-

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ অক্টোবর ২০১৭-এ প্রকাশিত Priliminary Report on Household Income and Expenditure Survey ২০১৬ অনুসারে, জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্য হার যেখানে উচ্চ দারিদ্র্য রেখা অনুসারে ২৪ হয়েছে ৩ শতাংশ, সেখানে সব বিভাগের মধ্যে রংপুর বিভাগে দারিদ্র্য হার সবচেয়ে বেশি ৪৭ হয়েছে ২ শতাংশ। উল্লেখ্য, Household Income and Expenditure Surve ২০১০ অনুযায়ী, রংপুর বিভাগে ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪২ হয়েছে ৩ শতাংশ। সারা দেশে যখন দারিদ্র্যের হার কমছে, তখন রংপুর বিভাগে এটি বেড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক বিষয়।
কিন্তু ব্যাপক সম্ভাবনা আছে উত্তরবঙ্গের রংপুর বিভাগের। শুধু টাকার অঙ্কে দরিদ্রতা নির্ণয় না করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে শনাক্ত করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। এ অঞ্চলের আছে অন্যতম বৃহত্তম লালমনিরহাটের বুড়িমারী ও দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর। এ দুটি চালু আছে। আধুনিকায়ন করতে হবে। আছে তেঁতুলিয়া পর্যটন এলাকা। এখানে স্থলবন্দরও আছে। এখানে রয়েছে অর্গানিক চা বাগান। তেঁতুলিয়া যাওয়ার পথে পড়বে কান্তজিউ মন্দির। বাংলাদেশের বৃহত্তম টেরাকোটার অনুপম ও নিদর্শন। তিস্তা ব্যারেজ আছে, আছে রামসাগর। ঠাকুরগাঁওয়ে রয়েছে পুরাতন স্থাপনাগুলো। উল্লিখিত স্থানের ব্যাপক পর্যটন আকর্ষণ রয়েছে। লালমনিরহাটে আছে রেলের বিভাগীয় শহর। পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে লালমনিরহাটের বিমানবন্দর। দিনাজপুরের সুগন্ধি চাল আর জগৎ বিখ্যাত লিচু আছে। এ অঞ্চলে রয়েছে প্রচুর আগের চাষ। চাল প্রক্রিয়াকরণ মিল। ধানের এলাকা বলা হয় দিনাজপুরেকে। দেশের শাক-সবজির বড় অংশ সরবরাহ করে এ অঞ্চল। ভাওয়াইয়া গানের জন্মভূমি। এ গানকে ছড়িয়ে দিতে হবে। শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে।
সমস্যাগুলো রয়েছে কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা, অনগ্রসর শ্রেণিপেশার একটি অংশ (ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী), খরাপ্রবণ এলাকা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আয়-বৈষম্য প্রকট, নিচু এলাকা আছে। গাইবান্ধায় রয়েছে নদীভাঙন প্রবণতা। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ সত্ত্বেও এ ‘রাজনৈতিক দূরত্ব’ বিরাজমান, যে সেতু উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকা ও দেশের অন্য কৃষি-ব্যবসাকেন্দ্রগুলোর সংযোগ স্থাপন করেছে। আলোচ্য অঞ্চলের ৬০-৬৫ শতাংশ কৃষকই দরিদ্র, প্রান্তিক। উপরন্তু প্রকটভাবে তাদের পুঁজি ঘাটতিও রয়েছে। ফলে এসব কৃষক সবুজ বিপ্লব প্যাকেজের ‘বীজ-সার-সেচ-যান্ত্রিকীকরণের আওতায় উচ্চ ফলনশীল জাতের (এইচওয়াইভি)’ প্রতিশ্রুতিতে একীভূত হতে ব্যর্থ হয়। রয়েছে মাত্র দুটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় (ভালো) নেই। পিছিয়ে পড়া এলাকায় শিক্ষার আলো জ্বালাতে হবে। রেলের লালমনিরহাট সেকশন খুবই অবহেলিত বলে মনে করা হয়। রংপুর বিভাগীয় শহর হলেও একটিমাত্র ট্রেন (রংপুর এক্সপ্রেস) ঢাকা যাতায়াত করে। জনশ্রুতি আছে, পূর্বাঞ্চলের বাদপড়া ক্যারেজ লালমনিরহাট সেকশনে এসে বিলাসবহুল হয়। লালমনিরহাট শহর রেলের আর বিমানবাহিনীর অনেক জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। শহরজুড়ে এ দুই বিভাগের জমি। আইনি জটিলতার কারণে লালমনিরহাট শহরের অবকাঠামো উন্নয়ন থেমে আছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেলকারখানা নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে। জনবল সংকট আর বাজেট স্বল্পতার কারণে ধুঁকছে এ কারখানাটি। অথচ একটি গ্রামকে এ কারখানাটিই দেশের শীর্ষ ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত করেছিল।
বলা যায়, সৈয়দপুর রেলকারখানা ধুঁকছে না তো-ধুঁকছে এ এলাকার স্বপ্ন। এ জটিলতাগুলো সমাধানের জন্য দরকার সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত। প্রধানমন্ত্রী লালমনিরহাট বিমানবন্দরে হেলিকপ্টার/যন্ত্রাংশ নির্মাণের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বাস্তবায়ন দ্রুত শুরু করা দরকার। সরকার আন্তরিক। ওয়াচডগের ভূমিকা পালন করলে কম বরাদ্দে ও কোন কোন ক্ষেত্রে শুধু সিদ্ধান্ত দিলেই লালমনিরহাট ও নীলফামারী বা এ অঞ্চলের অনেক সমস্যার সমাধান হবে। অন্য ক্ষেত্রে প্রান্তিক শ্রেণি শনাক্ত করে স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কর্মসূচি যাতে ওভারলেপিং (একই কাজ ভিন্ন নামে ভিন্ন ভিন্ন দপ্তর) যাতে না হয় সে জন্য আমাদের সতর্ক হতে হবে।
পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টির জন্য মূল হলো অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এ জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে রংপুর অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। যোগাযোগ ও যাতায়াতের জন্য সময়ের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। রাজধানী থেকে দূরবর্তী এলাকা হওয়ায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব খুব কম আছে। যোগাযোগও হয় অন্য এলাকার তুলনায় কম। এ এলাকার মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যরা তাদের নিজ এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করছেন বা করেছেন। অনেক সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। কিন্তু রংপুর বিভাগের সামগ্রিক উন্নয়নে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস খুবই কম আছে বলে আমার পর্যবেক্ষণ বলছে।
রংপুর অঞ্চলে শিল্পায়নে বাধার অন্যতম কারণ হলো জ্বালানি সমস্যা। এখানে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এ অঞ্চলে বেসরকারি খাত বিনিয়োগে উৎসাহিত না হলে প্রথম দিকে সরকারি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। এ অঞ্চলে পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধাসহ ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক স্থাপন করতে হবে, যাতে উদ্যোক্তারা সুবিধা পান। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা ও এডিপিতে বাজেট বরাদ্দ রাখা। রংপুর ওয়াসা গঠন করা ও এডিপিতে বাজেট বরাদ্দ রাখা। আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস করতে গুণগত শিক্ষার সুযোগ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন ও মেয়েদের শিক্ষার ওপর গুরুত্ব বাড়াতে হবে। রংপুর বিভাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বাড়াতে হবে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন-অনুমোদন দিতে হবে, কারিগরি শিক্ষার জন্য নেই মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। চরাঞ্চলে সেসব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, সেখানে বিদ্যালয় স্থাপন করা প্রয়োজন।
আইটি পার্ক স্থাপন করা যেতে পারে। আইটি পার্ক, আইসিটি সহায়তা, ইনকিউবেশন সেন্টার হলে শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠী কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা প্রান্তিক শ্রেণিদের জন্য বিশেষ প্রকল্প চালু করতে হবে। আর যেগুলো চালু আছে সেগুলো সমন্বয় করতে হবে। পর্যটনকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বাজারজাতকরণের সমস্যা এলাকায় প্রকট। আরও হিমাগার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বেসরকারি অংশকে উৎসাহিত করতে হবে।
বলা হয়, তিস্তা-ধরলা-করতোয়ার কোল বেয়ে যেমন বয়ে যায় জল তেমনি বয়ে যায় সময়। কিন্তু ভাগ্য বদলায় না রংপুর বিভাগের মানুষের। আমরা চাই, উন্নয়ন হবে এলাকার-সামগ্রিক উন্নয়ন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি কর্তৃপক্ষকে কিন্তু এ এলাকার জনগণকেই আকৃষ্ট করতে হবে! তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

 

আবু আফজাল মোহা. সালেহ : উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, লালমনিরহাট।
[email protected]

 

 
Electronic Paper