ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন অপরাধ নয়
ওয়াসিম ফারুক
🕐 ১:০৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৮, ২০২১
দাবি আদায়ে ছাত্র আন্দোলন নতুন কিছু নয়। যুগ যুগ ধরে নিজেদের ন্যায্য অধিকার আাদায়ের পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজের নানান ন্যায্য অধিকারের দাবি নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলন করেছেন। করে আসছেনও। এর জন্য অনেক শিক্ষার্থীকে জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে হয়েছে ও হচ্ছে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, চীনের ইমপেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারের কয়েকটি নীতির প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। আর এটা পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম ছাত্র আন্দোলন।
ইমপেরিয়ালে পড়তে আসা গরিব মেধাবী ছাত্ররা তাদের অধিকার ও দাবি প্রতিষ্ঠার জন্যই এই আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে এই আন্দোলনে চীনা গণমানুষের অংশগ্রহণে মহাআন্দোলনে রূপ নেয়। ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ ছাত্রদের এই আন্দোলনে শরিক হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। ১৭২ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে অমানুষিক নির্যাতন করেও তৎকালীন চীনা সরকার আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়।
পরবর্তীকালে ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মানতে বাধ্য হয়। এছাড়াও ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নাৎসি শাসনের বিরুদ্ধে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘হোয়াইট রোজ আন্দোলন’-এর সূচনা করে। হিটলার প্রশাসনের বিরুদ্ধে জনমানুষকে সচেতন করাই ছিল এই হোয়াইট রোজ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। ১৯৪৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট রোজের দুই সদস্য জার্মান গুপ্ত পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। একে একে ধরা পড়েন হোয়াইট রোজ গ্রুপের অন্য সদস্যরাও। অবশেষে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ছয় সদস্যকে তথাকথিত বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে প্রত্যেককেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। হিটলার প্রশাসনকে এই আন্দোলন তেমন পরিবর্তন করতে না পারলেও ছাত্রদের সাহসী পদক্ষেপ নাৎসি প্রোপাগান্ডায় কিছুটা হলেও ফাটল সৃষ্টি করে। হিটলার প্রশাসনের বিরুদ্ধে জার্মান জনগণকে সজাগ করতে পেরেছিল।
১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের মধ্যে দাবি-দাওয়া নিয়ে অসন্তোষ চলছিল। কর্মচারীদের মাসিক বেতন ছিল নগণ্য। তাদের থাকার জন্য কোনো বাসস্থান ছিল না। ৩ মার্চ থেকে কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করেন। কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ৩ মার্চ ক্লাস বর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে ৫ মার্চ পূর্ণ ছাত্র ধর্মঘটের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে বেলা ১২টায় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় বলা হয়, কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া কর্তৃপক্ষ যত দিন মেনে না নেবে, ততদিন সহানুভূতিসূচক ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রনেতা ও যুবকর্মী হিসেবে কর্মচারীদের আন্দোলনকে শুরু থেকেই সমর্থন করে আসছিলেন। শুধু তা-ই নয়, একসময় তিনি এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সে সময় অন্যদের মধ্যে নঈম উদ্দিন আহমেদ, মোল্লা জালাল উদ্দিন, আবদুস সামাদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, কল্যাণ দাশগুপ্ত, নাদেরা বেগম, অলি আহাদ, দবিরুল ইসলাম প্রমুখ আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। প্রাদেশিক সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই আন্দোলন ভ-ুল করার জন্য ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।
১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষ। ৬ জনকে ৪ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৫ জনকে আবাসিক হল থেকে বহিষ্কার করা হয়। একজনকে ১০ টাকা জরিমানা করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৫ জনকে ১৫ টাকা করে জরিমানা করা হয়। এছাড়া তাদের মুচলেকা দিতে বলা হয়। অনাদায়ে ছাত্রত্ব বাতিল এই মর্মে ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের এই সিদ্বান্তের প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের ২০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে হরতাল ও অবস্থান ধর্মঘট ডাকা হয়। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। গ্রেফতার অবস্থায় তাকে ছাত্রত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য জরিমানা ও মুচলেকা দিতে বলা হয়। তিনি মুচলেকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সিদ্ধান্তে শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান।
উপরের ঘটনাগুলো টানার কারণ সাম্প্রতিক সময়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার প্রেক্ষাপটে। ৫ দফা দাবি নিয়ে অনেক দিন ধরেই আন্দোলন করে আসছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনের জের কঠিনভাবে দিতে হয়েছে কয়েকজন ছাত্র ও শিক্ষককে। কী আছে শিক্ষার্থীদের ৫ দফা দাবিতে? ৫ দফা দাবির মধ্যে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অধ্যাদেশ বাতিল, নির্মাণ কাজের অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ, শিক্ষার্থীদের আবাসন-সংকট নিরসন ও বেতন-ফি কমানো। এর প্রত্যেকটাই যৌক্তিক দাবি হিসেবে মেনে নিয়েছেন খুলানা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. ফায়েক উজ্জামান। এমনকি তিনি বলেছেন ২০১৯ সালের নভেম্বরেই অধিকাংশ দাবি পূরণ করা হয়। তারপরও কেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন!
আমরা জানি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট চরমে। তাই কয়েকটি ছাত্রাবাস নির্মাণের কাজ হাতে নেওয়া হয়। ওই সকল ছাত্রাবাস নির্মাণে চরম দুর্নীতির কথা আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারি। ছাত্রাবাসের জীবনানন্দ দাশ ভবনে ৫ ইঞ্চির জায়গায় ৩ ইঞ্চি ছাদ দেওয়া হয়েছে। ওই ভবনের মোট ৭টি কক্ষের বিভিন্ন জায়গায় এই সমস্যা ধরা পড়ে। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের টেন্ডারে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এর নির্মাণ কাজের ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় নানা দুর্নীতি ও অপকর্মের দায়ে বর্তমানে কারাগারের বাসিন্দা জি কে শামীমের কোম্পানি জিকেএস-কে। তাই ছাত্ররা যে দাবিগুলো নিয়ে আন্দোলন করে আসছেন তা অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক দাবি।
ছাত্রদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ সকল যৌক্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে সঠিক পথ দেখাতে সহায়তা করাই একজন আদর্শ শিক্ষকের দায়িত্ব। আমার মনে হয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদী আন্দোলন করে যাচ্ছেন তাতে যেই শিক্ষকরা সমর্থন করেছেন তারা অবশ্যই প্রত্যেকেই নীতিবান আর্দশ শিক্ষকের মতোই নৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই আন্দোলননের জের ধরে যেই দুই শিক্ষার্থীর বহিষ্কার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বহিষ্কারের জন্য চূড়ান্ত নোটিস দিয়ে যে অগণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করেছেন তা ১৯৪৯ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন ও তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকাই ছিল মুখ্য।
বায়ান্নে, ঊনসত্তরে, একাত্তরে, নব্বইয়ে। সব সময়ই আমরা দেখে আসছি বিশ্ববিদ্যালয়ে একশ্রেণির শিক্ষক নিজেদের পদ-পদবি ও স্বার্থরক্ষায় সরকারের নানান লেজুড়বৃত্তিতে লিপ্ত ছিলেন। সে জন্যই আজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল স্থানেই অযোগ্যদের আধিপত্য। কারণ যে রাষ্ট্র বা সমাজে মেধার চেয়ে লেজুড়বৃত্তিকে মূল্যায়ন করা হয় সেই সমাজের কর্তাব্যক্তিরা সাধারণ মানুষের জন্য কতটুকুই-বা করবেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ঘটনা ঘটে গেল তা সম্পূর্ণভাবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনাবিরোধী। বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান সিন্ডিকেট ও ভিসি দ্বারা নতুন করে ইতিহাসের পাতায় এক কালো অধ্যায় রচিত হলো। এখন হয়তো যে কোনোভাবেই হোক ছাত্রদের অনশন ভাঙানো সম্ভব হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের মন থেকে, ইতিহাস থেকে এই আঁধার মোছা কখনই সম্ভব না।
ওয়াসিম ফারুক: কলাম লেখক