ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মুখে কাদা না ছুড়ে গায়ে মাখুন

নূরুজ্জামান
🕐 ৯:৫৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৮

থানা নির্বাহী কর্মকর্তা (টিএনও) সাহেব আমাদের আগে আগে মোটরসাইকেল চালিয়ে ভাঙাচোরা রাস্তার কাদা উপেক্ষা করে ছুটে গেলেন যমুনা নদীপাড়ের এক আশ্রয় কেন্দ্রের বন্যাদুর্গতদের মাঝে। এমন কাজ তো করার কথা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের।

কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ও ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাউকে সেখানে পেলাম না। আমরা অবশ্য এমন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর বিশ্বাসও রাখতে পারিনি। কারণ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শাসন দেখেছি। যখনই দল ক্ষমতায় থেকেছে তখনই নেতাকর্মীদের একটা অংশ যেন বাঘ হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তাই বাঘের মুখে মুরগি পড়ার ভয় করেছিলাম। আবার সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদেরও বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ তাদের কিছু সংখ্যকের মাধ্যমেও নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ শোনা গেছে। তাই নিজেরাই স্বহস্তে বন্যাদুর্গতদের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ত্রাণ দিতে গিয়েছিলাম। ত্রাণের টাকা ছিল আমার এক সুহৃদ বন্ধুর।
২০১৬ সালের কথা বলছি। আমরা বন্যার্তদের মাঝে সেই বন্ধুর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়েছিলাম জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলায়। যমুনা নদীর চরের বানভাসী মানুষ ওরা। বন্যায় সব হারিয়ে তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন নদীপাড়ের আশ্রয়ণ কেন্দ্রে। আমার বন্ধুটির ধারণা যার মাধ্যমেই ত্রাণ দেবেন তিনিই অধিকাংশ মেরে খাবেন, না হয় স্বজনপ্রীতি বা দলপ্রীতি করবেন। ফলে প্রকৃত দুস্থরা ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হবেন। তাই ঢাকা থেকে ক্ষেতমজুর সমিতির এক নেতাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। আর সঙ্গে ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। যিনি থানা নির্বাহী কর্মকর্তার চেয়ে ছোট পদমর্যাদার। তারপরও তিনি ছিলেন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। তিনিই যোগাযোগ করেন মাদারগঞ্জ থানা কর্মকর্তার সঙ্গে। যদিও ক্ষেতমজুর সমিতির লোকেরা সেখানে আগে থেকেই ত্রাণ পাওয়ার উপযুক্ত দুস্থদের একটি তালিকা করে রেখেছিলেন, তথাপি থানা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজে সেখানে রোদের মধ্যে বসে আমাদের ত্রাণ বিতরণে সাহায্য করলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, একজন সরকারি আমলা হয়েও তিনি জনগণের কাছের মানুষ হয়ে গেছেন! তিনি সেখানকার অধিকাংশ মানুষকেই ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। এমনকি দুস্থ পরিবারগুলোর অনেকেরই নামও জানেন। অথচ শুনেছিলাম তার বাড়ি না-কি সৈয়দপুর কি নীলফামারী জেলায়। তার মানে তিনি অন্য জেলার মানুষ হওয়া সত্ত্বেও নিজ দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে নিয়মিত এসব বানভাসী মানুষগুলোর সুখ-দুঃখের খরব রাখেন। এই দুস্থ মানুষের সঙ্গে তার এতটাই গভীর সম্পর্ক হয়ে গেছে, আমরা তালিকানুযায়ী ত্রাণ বিতরণ শেষ করার পর তিনি বললেন, ‘আপনাদের দুস্থ বন্যার্তদের বাছাই করা যথার্থই হয়েছে। তবে লোকগুলোর মধ্য কিছু লোক ক্ষেতমজুর সমিতির। শামীম ভাই, আমি আপনাকে অনুরোধ করব, যদি পারেন একটা ছেলেকে কিছু টাকা দিয়ে যাবেন! ছেলেটি কলেজে পড়ে, দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেছে। তার বাবা দিনমজুর। ছেলেটির চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য তার নাই। আমরা চাঁদা তুলে কিছু টাকা জোগাড় করে তাকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম। সে টাকাও শেষ হয়ে গেছে। অথচ এখনো তার চিকিৎসা শেষ হয়নি। যদি কিছু টাকা থাকে তবে আমার অনুরোধ, ছেলেটির চিকিৎসার জন্য কিছু দিয়ে যান!’
টিএনও সাহেবের এমন আকুতিভরা কণ্ঠে একটা পঙ্গু ছেলের চিকিৎসার জন্য সাহায্য চাওয়ার কথা শুনে উপস্থিত অনেকেই বলে উঠলেন, ‘হ, ছেলেটার খুব কষ্ট, তার চিকিৎসার জন্য কিছু দিয়ে যান!’
আমি অবাক বিস্ময়ে টিএনও সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই সরকারি অফিসারটি তার থানার অতি সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের সব খবরই রাখেন! মাদারগঞ্জে একজন সরকারি কর্মকর্তাকে দেখলাম তার মুখে কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নাই অথচ নিজে গায়ে কাদা মেখে দুস্থ মানুষের সেবায় নিবেদিত প্রাণ! আর আমাদের রাজনৈতিক নেতারা কি করছেন? অধিকাংশই দুঃখের দিনে মানুষের দুঃখের সঙ্গী না হয়ে, জনগণের সেবা না করে, জনগণের কাছ থেকে প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্নভাবে চাঁদা আদায় করছেন! আর ঢাকায় বসে গণমাধ্যমের মাধ্যমে এক দল অন্য দলের ও তার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করছেন। অর্থাৎ এ যেন মুখ দিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন!
অথচ রাজনীতি তো হওয়ার কথা জনগণের সেবা করা। দুঃখের দিনে জনগণের পাশে দাঁড়ানো। নিজের গায়ে কাদা মেখে গণমানুষের কাতারে শামিল হয়ে দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করা। তবেই না জনগণ তাদের প্রিয় নেতা হিসেবে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করবেন। তবেই না নেতার প্রাপ্য ভোট হবে মহামূল্যবান। হোক সে ভোট সংখ্যায় কম, কিন্তু তা যে গণমানুষের অন্তরের ভালোবাসায় সিক্ত। কমসংখ্যক মানুষের হলেও ভালোবাসার ভোটগুলো নেতাকে তৃপ্তি দেয়। পক্ষান্তরে নেতা যদি যে কোনো ধরনের আর্থিক বা অন্য কোনো শক্তির প্রভাব খাটিয়ে জনগণের কাছ থেকে ভোট আদায় করে নেন, তাতে না থাকে ভালোবাসার পরশ, থাকে না শ্রদ্ধার অর্ঘ্য। থাকে শুধু বাঘের থাবার রক্ত! আমাদের রাজনীতি বাঘের থাবার ওপর ভর করে চলছে কি-না রাজনীতি সংশ্লিষ্টরাই ভালো করে জানেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, অনেকেই গণমানুষের কাছে কালভদ্রেও যান না, তাদের দুঃখের দিনে পাশে থাকেন না, শুধু বড় রাজনৈতিক দলের নমিনেশন পাওয়ার জন্য, দলীয় প্রতীকের জোরে ভোট পেয়ে বড় নেতা বনে যাওয়ার জন্য, আরও বেশি ক্ষমতাশালী হওয়ার জন্য, ক্ষমতার অপব্যবহার করার উদ্দেশ্যে রাজনীতি করতে আসেন। তা না হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগমুহূর্তে কেন এত বিভিন্ন পেশার মানুষ বড় রাজনৈতিক দলের নমিনেশনের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করবেন? হয়তো জনগণের একটা অংশ তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য নামে চেনেন। কিন্তু তাদের চেহারা তো সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার জনগণ কোনোদিন চোখে দেখেননি। তাহলে রাজনীতিটা কী হলো? এই রাজনীতি জনকল্যাণের হবে কী করে? এই রাজনীতি তো সংশ্লিষ্ট জনগণকে শোষণ ও নিষ্পেষণ করার ভয়ঙ্কর নেশা ছাড়া কিছু না।
বোধ করি, আজ আমাদের পেশাদার রাজনীতিকরাও সেই শোষণ প্রক্রিয়া বজায় রাখার, প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখার বা বিত্ত-বৈভবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠার রাজনৈতিক বৃত্তের দুষ্টুচক্রে আটকে গেছেন। তাই তারাও অন্য পেশা থেকে আসা রাজনীতিকদের মতোই হয়ে উঠছেন। তাই বুঝি সেদিন আমরা ত্রাণকার্যে সাহায্যের জন্য কোনো রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে পাশে আসতে দেখলাম না। যেটা আমি আশা করেছিলাম। আমরা কোনো রাজনৈতিক নেতাকে না ডাকলেও এলাকার রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা জনসম্পৃক্ত থাকলে তাদের তো খোঁজ পাওয়ার কথা, কেউ আজ তাদের এলাকার বন্যার্তদের সাহায্য করতে আসছেন। সুতরাং সেখানে উপস্থিত থাকা তো তাদের রাজনৈতিক দায়িত্বেরই অংশ। যে কাজটি করলেন টিএনও সাহেব। অথচ জনগণ নেতাদের মুখে কাদা ছোড়াছুড়ি করা পছন্দ করুক আর না করুক তারা তা করে চলেছেন। এভাবে তারা রাজনীতিকে মুখে কাদা ছোড়াছুড়ির মধ্যেই আবদ্ধ করে ফেলেছেন। তাই তারা একে-অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনায় পারদর্শিতা দেখানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন! অথচ নেতারা যদি নিজ এলাকার জনগণের সুখ-দুঃখে পাশে থেকে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন, তাদের ওপর পরিচালিত যে কোনো ধরনের সামাজিক বা রাজনৈতিক জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করতেন, তাহলে একে-অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করার দরকার হতো না, কাদা ছোড়াছুড়ি করার দরকার হতো না। জনগণের প্রতি আস্থা রেখে, জনগণ প্রদত্ত কমবেশি ভোটকে জনগণের ভালোবাসা হিসেবে গণ্য করে আত্মতৃপ্তি পেতেন। নির্বাচনে পাস-ফেল নিয়ে মাথাব্যথা করতেন না। আর রাজনীতির এই সংস্কৃতির চর্চা হলে সমাজের সর্বস্তর থেকে জুলুম-নির্যাতন বিদায় নিতে বাধ্য হতো। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সে আসা সুদূর পরাভূত। কারণ বড় দুই রাজনৈতিক বলয়ে যেভাবে যারা যুক্ত হওয়া ও সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তা কোনোভাবেই জনকল্যাণের রাজনীতি গড়তে সহায়ক হতে পারে না। জনকল্যাণের রাজনীতি করতে হলে কাদা ছোড়াছুড়ি বাদ দিয়ে জনগণের দুঃখ-কষ্টে পাশে থেকে সব ধরনের অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। আর সে লড়াই হতে হবে জনগণের কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে। জনগণকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা আদায় করে ষাঁড়ের মতো মোটাতাজা হওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। নমিনেশনও দিতে হবে তেমন জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত রাজনীতিককে। কোনো বসন্তের কোকিলকে নমিনেশন দিলে জনকল্যাণের রাজনীতির পথ প্রশস্ত না হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। আর মুখে কুৎসা রটানো ও কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি ডালপালা গজিয়ে জনগণকে গিলে খাবে। তাতে জনগণ কখনই সন্তুষ্ট হতে পারবে না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন পর্যন্ত এমন রাজনীতিক খুব কমই দেখা গেছে। তাই তো দেখা যায়, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতারা পুনর্বার নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে শতভাগ আত্মবিশ্বাসী হতে পারেন না। তাই তারা টাকার জোরে বা পেশিশক্তির জোরে নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা করেন। এটাই বাস্তবতা। তা না হলে নির্বাচনের মাঠে মারামারি খুনোখুনি হতো না। নির্বাচন কমিশন যারাই হোন না কেন বা রাষ্ট্র যত চেষ্টাই করুক না কেন, জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত প্রিয় নেতাকে কখনই পরাজিত করা যায় না। নেতা যদি জনগণের হন, তবে জনগণ তার জন্য জীবন দিতে সদা প্রস্তুত থাকেন। যেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ আমাদের রাজনীতিতে তেমন নেতৃত্বের খুবই অভাব বলেই মনে হচ্ছে।
তা না হলে বিএনপি কেন আন্দোলন চাঙ্গা করতে ব্যর্থ হচ্ছে? আর রাজনীতির বাইরের লোকই বা কেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো এত বড় রাজনৈতিক দলের নমিনেশন প্রত্যাশা করবে? আর প্রত্যাশা করলেও তারা নমিনেশন পাবেনই বা কেন?
সুতরাং, যতই নির্বাচনী পদ্ধতি বা নির্বাচন কমিশন সংস্কার করুন না কেন, নির্বাচনের মাঠে যতই শক্তিশালী নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন না কেন, সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে আস্থার সংকট অতীতে ছিল, আগামীতেও থাকছেই। এর কারণ জনগণের স্বার্থ নিয়ে লড়াই করার মতো রাজনীতিকের সংকট ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সেই সঙ্গে বেড়েই চলেছে জনশোষণের রাজনীতি। বেড়ে চলেছে কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি। সংকীর্ণ হয়ে চলেছে গায়ে কাদা মাখার রাজনীতি ও রাজনীতিকের পথ। তাই বলবো মুখে কাদা না ছুড়ে গায়ে কাদা মাখার রাজনীতি করুন, কেউ আপনাকে পরাজিত করতে পারবে না। জনগণের ভালোবাসাই আপনাকে চিরঞ্জীব করে রাখবে।

নূরুজ্জামান : কলাম লেখক।
[email protected]

 
Electronic Paper