ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

এক কলামে মাইল পার

মাসুদ কামাল হিন্দোল
🕐 ১১:৫৫ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২৭, ২০২১

এক কলামে মাইল পার

জ্ঞানী গুণী পরিচিত ব্যক্তিদের নিজের পরিচয় নিজেকে দিতে হয় না। নিজের ঢোল নিজেকে পেটাতে হয় না। তারা স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তখন ছিল সংবাদপত্রের সোনালি যুগ। সাংবাদিকতা জগতে অনেক প্রতিভাবান আপাদমস্তক সাংবাদিক-কলামিস্ট ছিলেন। এখনো কেউ কেউ আছেন। হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবেন। সে সময়ে কলাম লেখকরা ছিলেন জাঁদরেল স্বাধীন মত প্রকাশে উদার এবং পাঠকনন্দিত। তারা ব্যক্তিকে ছাপিয়ে পরিণত হয়েছিলেন এক একটা ইনস্টিটিউশনে। তাদের কলামে থাকত জীবনের প্রতিচ্ছবি। তারা সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারতেন। লেখার সামাজিক দায়বদ্ধতা ও গুরুত্ব ছিল। পাঠক সেই সব লেখা পড়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। পরিবর্তন করত জীবনের বাঁক। সরকারও পুনর্বিবেচনা করত তার সিদ্ধান্ত। সে সময় ছদ্মনামে উপসম্পাদকীয় বা কলাম লেখার রেওয়াজ ছিল। তারা নেপথ্যে থেকেও পরিচিত এবং আলোচিত ছিলেন। মনে করা হতো তারা জাতির থিংক ট্যাঙ্ক। ’৯০ এর গণআন্দোলনে দুই নেত্রীকে এক টেবিলে বসার ব্যবস্থা করেছেন তারা।

এই কলাম লেখকদের অনেকে পরে স্বনামে কলাম-উপসম্পাদকীয় লেখা শুরু করেন। বেশ কয়েক বছর পর লেখার সঙ্গে লেখকের ছবি ছাপানো শুরু হয়। এখন লেখার সঙ্গে লেখকের ই-মেইল ছাপা হচ্ছে। কখনো কখনো ফোন নম্বরও। রিপোর্টের সঙ্গে রিপোর্টারের ছবিও থাকে। বিদেশ থেকে রিপোর্ট মন্তব্য কলাম পাঠালে তো কথাই নেই। ছবি অনিবার্য। একাধিক রিপোর্টের সঙ্গে একাধিক ছবি। এটা সময়ের দাবি। ছদ্মনামকে পাঠক হয়তো আগের মতো গ্রহণ করছে না। তারা প্রকৃত কারিগরকেই জানতে বা দেখতে চায়। সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতে চান তাদের সঙ্গে। তাৎক্ষণিক মন্তব্য অভিমত জানাতে চান।

বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা চলাকালীন পত্রিকার পাতায় পাতায় খেলা নিয়ে অনেক কলাম ছাপা হয়েছে গত একযুগে (২০১৮ বিশ্বকাপের আগে)। ব্যর্থ ফুটবল খেলোয়াড়দের অনেকেই বিশেষজ্ঞ কলাম লিখেছেন। খেলোয়াড় হিসেবে তারা ছিলেন চরম ব্যর্থ। খেলা সম্পর্কে যে মন্তব্য লিখতেন তার ফল প্রতিদিনই উল্টো হতো। কলামিস্ট লিখলেন আগামীকাল জার্মান ইংল্যান্ড খেলায় ইংল্যান্ড ৩-০ গোলে জয়ী হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ইংল্যান্ড ৩ গোল খেয়ে পরাজিত হয়েছে। সেসব ভবিষ্যদ্বাণী অধিকাংশ সময়ে ভুল হতো। অনেকেরই আধুনিক ফুটবল খেলা সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নেই। বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার সময় যারা কলাম লিখেছেন তাদের কেউ কেউ ছিলেন মিডিয়া জগতের তারকা। দু’একটি নাটক কিংবা মডেলিং করেছেন এমন তথাকথিত তারকারাও জটিল খেলা ক্রিকেট সম্পর্কে অতিথি কলাম লেখক হিসেবে অবলীলায় কলম চালিয়েছেন।

আজকাল পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয়ে যারা টিপস দেন তারাও নিজেকে কলামিস্ট হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যাদের লেখা চিঠিপত্র কলামে ছাপানোর যোগ্য না তারাও (কলামিস্ট সম্পর্কে বাংলা একাডেমির English to Bengali ডিকশনারিতে বলা হয়েছে, বিশেষ বিষয়ের ওপর নিয়মিত লেখেন এমন সাংবাদিক। Oxford Advanced Learner’s ডিকশনারিতে বলা হয়েছে- যিনি নিয়মিত রাজনীতি ও সমসাময়িক বিষয়ের ওপর সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে লেখেন)। মিডিয়া জগতে এখন যার সঙ্গে পরিচয় হয় শুনি তিনিই একজন কলামিস্ট। একজন সাংবাদিক কলামিস্ট নিজেকে বহুমাত্রিক কলামিস্ট হিসেবে পরিচয় দেন। আমরা জানি না বহুমাত্রিক শব্দটি ক্রিকেটের অলরাউন্ডারের বিকল্প কি না? ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকে একজন কলাম লিখেছেন। তার ছোট কলামের শব্দ সংখ্যা ৫০৬ আর লেখক পরিচিতি দেওয়া হয়েছে ৩০ শব্দে। এ কথা বললে এখন নিশ্চয়ই ভুল হবে না যে ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়’।

এমন অনেক কলাম-উপসম্পাদকীয় লেখক আছেন যারা কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ানটিটিকে বেশি গুরুত্ব দেন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো পত্রিকায় তাদের লেখা ছাপা হয়। কখনো কখনো একাধিক। তারা নিজেরাও জানেন না বা জানার চেষ্টাও করেন না তাদের কোন লেখা কখন কোন পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। লেখা যাচ্ছে এটা ভেবেই তারা তৃপ্ত। লেখার সঙ্গে নাম আর ছবিটা থাকলেই হলো। এ সব লেখার কোনো রিঅ্যাকশন বা চেইন রিঅ্যাকশনও হচ্ছে না। লেখা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথাও নেই। দিনের পর দিন বছরের পর বছর এভাবে লিখেই চলেছেন।

এই কলাম লেখকদের একজন আমাকে বলেছেন তার কয়েকশ’ উপসম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে। পাঠকের তেমন কোনো অভিমত বা প্রতিক্রিয়া কোনোটিই পাননি। অনলাইনে লাইক বা শেয়ারের সংখ্যাও উল্লেখ করার মতো না। আসলে এই লেখকদের লেখা ‘ধারেও কাটে না, ভারেও কাটে না। কাটে পোকায় আর সম্পাদক’। এ ধরনের একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। আজকাল অনেক বিভাগীয় সম্পাদকরাও কাটাকাটি করতে চান না তেমন একটা। অন্যের লেখা সম্পাদনার চেয়ে নিজে অন্য পত্রিকায় খেপ (খ্যাপ) মারতে পারলে ক্ষতি কি? ইদানিং সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষও উপসম্পাদকীয়-কলামকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় বলে মনে হয় না। একই লেখা একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে পদবিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দু’একটি দৈনিক ছাড়া অধিকাংশ পত্রিকার নিজস্ব কলাম লেখক বা লেখক প্যানেল নেই। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হয় না কলাম-উপসম্পাদকীয়। ক্রিয়েটিভ রাইটিং বা কলাম লেখার কোনো কোর্সও সচরাচর চোখে পড়ে না। সম্পাদকীয় বিভাগে লোকবল কলেবর কমে আসছে।

‘কলম দিয়ে লিখলেই যে কলামিস্ট হওয়া যাবে তা নয়। কলামিস্টের লেখা হতে হবে কুড়কুড়ে। কুড়কুড়ে মুড়ির মতো। যে মুড়ি ভালোবাসে, পৃথিবী জয় করতে পারে সে কথাটা বলেছিলেন পল্লীকবি জসীম উদদীন। বলেছিলেন, আমার হাতের লেখা খারাপ হতেই পারে। ডাক্তারদের লেখাও তো কেউ পড়তে পারে না। আমি কলম দিয়ে লিখি না, লিখি মন দিয়ে। আমার বাড়ির মুড়ি যেমন খাঁটি সরিষার তেল কাঁচা লংকা ও পেঁয়াজ দিয়ে প্রস্তুত, তেমনি লেখাটিও মুড়ির মতোই টাটকা ও কুড়কুড়ে। যে জানে সে জানে।’ (যে জানে সে জানে- মুস্তাফা জামান আব্বাসী, গোধুলীর ছায়াপথে পৃ. ১১ মুক্তদেশ প্রকাশন )।

এখন দেখা যাচ্ছে কলাম লেখকদের পদে পদে নতজানু হতে। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা আর পেশাজীবী বা বিনোদন তারকা কলাম লেখকদের দৌরাত্ম্যে প্রকৃত কলাম লেখকরা অনেকটা কোণঠাসা। লেখার শেষে তাদের পুরো প্রোফাইল ছাপা হওয়া সত্ত্বেও তাদের ব্যাপারে পাঠকের আগ্রহ কম। অধিকাংশ কলাম লেখকই পাঠকের আগ্রহের তালিকায় নেই। প্রযুক্তির উন্নতির কারণে কলম এখন সস্তা। মাত্র চার-পাঁচ টাকায় কলম পাওয়া যায়। আমাদের দেশে পাঠকের চেয়ে পত্রিকা বেশি, পত্রিকার চেয়ে কলামিস্ট বেশি। তাই আমরা সবাই কলামিস্ট। পুরনো কথাটিকে একটু ঘুরিয়ে এভাবে বলা যায়, ‘কলম যার কলাম তার, এক কলামে মাইল পার’।

মাসুদ কামাল হিন্দোল : সাংবাদিক ও রম্য লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper