করোনা টিকা : সবার কথাই ভাবতে হবে
সাঈদ চৌধুরী
🕐 ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২৪, ২০২১
যখন লিখতে বসছি তখন বিভিন্ন পত্রিকায় করোনায় মৃত্যুর গড়গুলো চোখে এসে পড়ছে। মানুষের অপারগতার কী নিশ্চুপ আস্ফালন চারিদিকে। বুক ভেঙে গেলেও করোনা থেকে মানুষগুলো বাঁচতে পারেনি। বিশ্ব স্থবির হতে যাচ্ছে আবারও। যখন লেখা শুরু করেছি তখন গড় হিসেবে প্রতি ছয়জনে একজন করোনায় মারা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। আমাদের মতো দেশ থেকে মৃত্যু গোনা আর জীবিকার তাগিদ যখন একই সরলরেখায় তখন অনেক চিন্তা আমাদের ইচ্ছের বাইরেও করতে হয়। সামনের দিনগুলোতে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছি হয়তো সে প্রশ্নের উত্তরটি নিয়ে হাজির হবে টিকার প্রয়োগ কিন্তু তাতে আমাদের কী?
নতজানু হয়ে পরাজয় শিকার করতে করতে আমরা যা ভাবছি তা হলো, মৃত্যুক্ষুধার কাছে খুবই নগণ্য চিন্তা। খুব নিষ্ঠুর নিয়তির অসাধারণ পরিসমাপ্তি যখন আমরা খুব সাধারণভাবে নিয়ে জীবন চালাতে শুরু করি তখনই কেবল বুঝি আমরা বাঙালি সাহসী জাতি। টিকা আবিষ্কার হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য একটি ভালো সংবাদ। দেশে টিকা এসেছে আমাদের আশা জাগাচ্ছে। আদতে কাদের কাছে টিকা পৌঁছাবে তা নিয়েও অনেক কথা হচ্ছে। সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মী আর প্রবীণ মানুষরাই আগে টিকা পাবে। এও শোনা গিয়েছে টিকার নিবন্ধন করা হবে অনলাইনে। সব কিছুই ঠিক পথে চলছে ধরে নিলাম। তবে আমাদের সমাজে যাদের জন্য কথা বলার কেউ নেই তাদের টিকা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত হবে তো!
সেই কবে রিকশাওয়ালা আবুল শ্বাসকষ্টে মারা গেল সে আদৌ করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল কিনা তাও জানা যায়নি! হঠাৎ জ¦র এসে যদি কেউ মারা গিয়ে থাকে সে মৃত্যুটিও করোনার জন্য কিনা তাও আমরা বলতে পারি না অনেক ক্ষেত্রেই। পরিবারের মাত্র একজন উপার্জন করে এমন মানুষও করোনায় মারা গিয়েছে। কেউ পরীক্ষার আওতায় এসেছে কেউ আসেনি। তবে?
বৃদ্ধ বয়সে যে রিকশা চালায় সে কি করোনার টিকা পাবে? যাদের আমরা পতিতা বলে গাল দিই এবং নিজেরাই আবার তাদের পল্লির অংশীদার হয়ে যাই তারা কি এই টিকার ভাগ পাবে? যে বৃদ্ধ নারী বিধবা ভাতার আওতায় আসেনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধির একটু বেখেয়ালে সে কি টিকা পাওয়ার নিশ্চয়তা পাবে?
আচ্ছা ভেবে বলুন তো, জেলের মধ্যে বসে থাকা বৃদ্ধজন কি টিকা পাবে সময়মতো? সামনে অনেক সমীকরণ। একবারে সব টিকা দিয়ে ফেলা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা তা খুব করে বুঝি। কিন্তু দেখুন যে জায়গায় টিকা পেলে সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা সম্ভব সে জায়গাগুলো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
যেমন স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সংবাদকর্মী, রাস্তায় পড়ে থাকা বৃদ্ধ মানুষ এদের নিশ্চয়তার পরই যাদের কথা আসবে তারা হলো পোশাককর্মী ও অন্যান্য শ্রমিক। এদের সুরক্ষা দেওয়া আমাদের জন্য বড় কাজ। পোষাক শিল্পের শ্রমিকরা নিশ্চিত স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া মানেই হচ্ছে স্বনির্ভর বাংলাদেশ। এরপরই আসবে কৃষকদের কথা। গ্রামে বড় আকারে প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার আগেই বৃদ্ধ কৃষকদের টিকার আওতায় আনা প্রয়োজন।
সরকারকে এখন কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে টিকা কার্যক্রম চালানো যেতে পারে। টিকা কারা পাবে সেনাবাহিনী তাদের সার্চিং কমিটির মাধ্যমে তা খুঁজে বের করবেন এবং টিকা কার্যক্রম চালাবেন।
যদি সবার মধ্যে টিকা সমানভাবে সরবরাহ না করা যায় তবে শুধু এক শ্রেণির মানুষ টিকার সুবিধা পাবে আর অন্যরা একবার পেছনে পড়লে সামনে এগোনোর কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং টিকার বিষয়ে যতটা মানবিক আচরণ করা যায় সেভাবেই এগোনো প্রয়োজন। টিকা আছে অথচ তার সামনে শ্বাসকষ্টে মারা যাচ্ছে মানুষ এ যেন নাগরিক অধিকার না পাওয়ারই এক প্রকার মেসেজ!
রাস্তায় থাকা ছিন্নমূল মানুষের কথা ভাবুন। তারাও যেন টিকা পায় এবং তাদের সুস্থতা নিশ্চিত হয় এটাই এখন বড় চাওয়ার জায়গা। করোনার জিনোম পরিবর্তন হচ্ছে শুরু থেকেই, হচ্ছে আচরণগত পরিবর্তনও। কেউ বলছে আরও ভয়ানক হয়ে উঠবে করোনার সামনের দিনগুলোতে। এই অবস্থায় টিকা প্রাপ্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টজনদের আরও বেশি উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। আশা করি স্বাস্থ্য খাতের উন্নতিগুলো দৃশ্যমান করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও সচেষ্ট হবে।
সাঈদ চৌধুরী : সদস্য, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি ও কলাম লেখক
শ্রীপুর, গাজীপুর