ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আনুশকাদের বাঁচাতে দিহানদের ঠেকাতে হবে

প্রদীপ সাহা
🕐 ১:০২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২২, ২০২১

আনুশকাদের বাঁচাতে দিহানদের ঠেকাতে হবে

ইদানীং খুন, হত্যা, ধর্ষণ এসব ঘটনা যেন নিয়মিত একটা রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবিক অর্থে, দেশে দিন দিন এসব ঘটনার মাত্রা বেড়েই চলেছে। গত ৭ জানুয়ারি স্কুলছাত্রী আনুশকা ধর্ষণ-হত্যার ঘটনা আবার এক আলোচনায় ওঠে এলো। এ ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো, দিহানরা এ সমাজে এখনো বুক উঁচিয়ে চলাফেরা করছে। দিহানদের দাপটে সত্যিই যেন জিম্মি হয়ে আছে পুরো জাতি, পুরো সমাজ। কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না নৃশংস হত্যা, খুন, ধর্ষণ ও অপরাধমূলক সব ঘটনা। এসব ঘটনা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। আইনের সংশোধন এবং আইন প্রয়োগের চেষ্টা থাকলেও অপরাধীদের সংখ্যা কমছেই না কোনোভাবে।

আনুশকা হত্যার ঘটনাটি সবার হৃদয়ে কঠিনভাবে নাড়া দিয়ে গেল। আবারও প্রমাণিত হলো, সত্যিই আমরা সবাই এক নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে সময় কাটাচ্ছি। বর্তমানে আমাদের দেশে যে হারে খুন, হত্যা, ধর্ষণের মতো বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে ক্রমশ যেন এক অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

জানা গেছে, কলাবাগানের মাস্টারমাইন্ড স্কুলের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থী আনুশকা নূর আমিনকে ধর্ষণ-হত্যার ঘটনায় আটক হয়েছে অভিযুক্ত ইফতেখার ফারদিন দিহান (১৮)। দিহান তার কলাবাগানের বাসায় আনুশকাকে ধর্ষণ করে হত্যা করে। হত্যার পর ঘটনাটি অন্যদিকে নেওয়ার জন্য দিহান নিজেই আনুশকাকে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন এবং তাদের সহযোগিতায় দিহানকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়।

নিহতের পরিবারের অভিযোগ, কৌশলে মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। আনুশকার মা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘দিহান ও তার সঙ্গীরা গত ৭ জানুয়ারি আমার মেয়েকে নিয়ে যায়। বাসায় নিয়ে ধর্ষণ শেষে তাকে হত্যা করা হয়। মেয়েকে হত্যার পর দিহান আমাকে ফোন দিয়ে জানায়। তারপর আমি হাসপাতালে যাওয়ার পর সে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করে বলে- আন্টি আমাকে বাঁচান।

দিহান জানায়, সে তার তিন বন্ধুসহ আনুশকাকে তার বাসায় নিয়ে যায় এবং সেখানে সে অচেতন হয়ে পড়ায় হাসপাতালে নিয়ে আসে।’

আনুশকার মা আরও জানিয়েছে, অপহরণ মামলা করতে চাইলে পুলিশ তা করতে দেয়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমার মেয়ের চরিত্র হনন করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে- দিহানের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এ তথ্য মোটেও সঠিক নয়। দিহানের সঙ্গে আমার মেয়ের কোনো পরিচয়ই ছিল না।’

ফরেনসিক রিপোর্টে জানা যায়, আনুশকার শরীরের কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া না গেলেও যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথে মারাত্মক ক্ষতচিহ্ন পাওয়া গেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিকৃত যৌনাচারের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে।

কী বিভৎস, কী লোমহর্ষক ঘটনা! ধর্ষণের আগে তাকে চেতনানাশক কোনো কিছু খাওয়ানো হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত করতে ডিএনএ নমুনাও সংগ্রহ করা হয়েছে।

আনুশকার বাবার অভিযোগ, তার মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে।

অন্যদিকে অভিযুক্ত দিহান বলছে, পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্মতির ভিত্তিতে তাদের মেলামেশা হয়েছে। তবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে অজ্ঞান হয়ে গেলে ঘাবড়ে গিয়ে তাকে নিজের গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

চিকিৎসকরা নিশ্চিতভাবে জানান, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছে, ধর্ষণের ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে দিহান আনুশকাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আনুশকাকে ধর্ষণ ও হত্যার বিষয়ে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দেয় কথিত বন্ধু দিহান।

আনুশকা ও দিহান দুজনেই বয়সে কিশোর। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমানে আমাদের সমাজে কিশোর অপরাধী তথা কিশোর গ্যাং একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লক্ষ করা গেছে, এ বয়সটির মধ্যেই অপরাধের ঘটনা ও প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিভিন্নরকম অপরাধের ঘটনায় এদের সংখ্যাই যেন বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। খুন, হত্যা, ধর্ষণ এসব তাদের কাছে খুবই তুচ্ছ এবং সাধারণ একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের অবাধ চলাফেরা ও কার্যকলাপে ভুক্তভোগীরা অসহায় জীবনযাপন করছে। বলতে বাধ্য হচ্ছি, এসব কিশোররা খুব সহজে বেছে নিয়েছে অপরাধের এ জগতকে। কিশোর বয়সটা একটি অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষা পার হওয়ার সময় এবং অধ্যায়।

মনোবিজ্ঞানী এবং অভিজ্ঞমহল মনে করেন, এ সময় প্রতিটি পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে; প্রতিটি অভিভাবককে তাদের সন্তানদের দেখাশোনার সঠিক দায়িত্ব নিতে হবে। সন্তান কোথায় যায়, কী করে, কার সঙ্গে মিশে- এসব খোঁজখবর প্রতিটি বাবা-মাকে অবশ্যই রাখতে হবে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
অভিভাবকদের অবহেলাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের বিপথে পরিচালিত করে। তাদের এ অবহেলায় কিশোর অপরাধীদের খাতায় সহজেই তাদের সন্তানদের নাম উঠে যাচ্ছে। কেউ কেউ ধর্ষক কিংবা হত্যাকারী হিসেবে সমাজে সহজেই পরিচিত হয়ে উঠছে। তবে এক্ষেত্রে শুধু অভিভাবকদের দায়ী করলেই চলবে না- প্রশাসন এবং আইনেরও যথাযথ প্রয়োগের বাস্তবায়ন থাকতে হবে। যেকোনো অপরাধ দমনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে রাষ্ট্রকে, প্রশাসনকে। দেশের বিচার ব্যবস্থাকে আরও জোরদার এবং শক্তিশালী করতে হবে অপরাধ নির্মূল করার জন্য। দিহানরা সহজেই সমাজে বেড়ে উঠছে।

তবে দিহানরা আজ যেভাবে সহজেই বেড়ে উঠছে আমাদের সামনে, তার জন্য মূলত দায়ী কে? এ প্রশ্ন নিজেকে এবং সবাইকে করতে হবে। দিহানদের দাপট আর নৃশংসতায় আর কোনো আনুশকাকে যেন রক্তাক্ত হতে না হয়, আর কোনো আনুশকা যেন এভাবে অকালে ঝরে না পড়ে, সে ব্যাপারে অবশ্যই জোরালো ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে রাষ্ট্রকে। দ্রুত বিচার আইনে দিহান ও তার সহযোগীদের বিচারের আওতায় এনে কঠিন থেকে কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। পাশাপাশি এমন বাস্তবভিত্তিক কার্যকরী ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে নিতে হবে, যাতে সত্যিকার অর্থেই এ সমাজ থেকে দিহানদের অবসান হয়- চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় দিহানদের নৃশংসতা। সহজেই যেন গড়ে ওঠে অপরাধহীন একটি সুন্দর সুশীল ও নিরাপত্তামূলক সমাজ, যেখানে দিহানদের মতো দানবরা সহজে বেড়ে উঠতে না পারে।

দিহানদের অবসান হোক, রক্ষা পাক তাদের হাত থেকে আনুশকার মতো অসহায় সন্তানরা। আনুশকাদের বাঁচাতে এখনই দিহানদের ঠেকাতে হবে, তাদের এই সহজ ও ঘৃণ্যতম নৃশংসতা অবশ্যই থামাতে হবে। আর এ কাজে এগিয়ে আসুক সমাজ, এগিয়ে আসুক রাষ্ট্র- জাগ্রত হোক আমাদের বিবেক।

প্রদীপ সাহা: কবি ও কলাম লেখক

[email protected]

 
Electronic Paper