ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

চালের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানির প্রভাব

আব্দুল হাই রঞ্জু
🕐 ২:২৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২১, ২০২১

চালের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানির প্রভাব

বলা চলে, আমন কাটা মাড়াইয়ের মৌসুম এখন শেষ। শেষ মৌসুমেও হুহু করে বাড়ছিল চালের দাম। সরকার মূলত আপদকালীন খাদ্য মজুদ ও কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বছরে আমন ও বোরো মৌসুমে ধান ও চাল সংগ্রহ করে থাকে। এ বছর চলতি আমন মৌসুমে অভ্যন্তরীণভাবে ২৬ টাকা কেজিতে ২ লাখ মেট্রিক টন ধান, ৩৭ টাকা কেজিতে ৬ লাখ মেট্রিক টন সেদ্ধ চাল ও ৩৬ টাকা কেজিতে ৫০ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। কিন্তু ধানের বাজার দর শুরু থেকেই বেশি থাকায় এ বছর সরকারের সঙ্গে অধিকাংশ চালকল মালিক চুক্তিবদ্ধ হননি। মূলত প্রতি কেজি ধানের মূল্য ২৬ টাকা হলে একমণ ধানের মূল্য দাঁড়ায় ১০৪০ টাকা। আর সরকারি রেশিও মতে একমণ ধানে চাল পাওয়া যায় ২৬ কেজি। এই হিসাবে সরকারিভাবে এক কেজি চালের মূল্য দাঁড়ায় ৪০ টাকা। এর সঙ্গে ভাঁপা, সেদ্ধ, শুকানো, ছাঁটাই করা থেকে সরকারি খাদ্য গুদাম পর্যন্ত পরিবহন খরচ ধরলে প্রতি কেজিতে খরচ পড়ে ২ টাকা। 

একুনে সরকারি হিসাব মতে, এক কেজি চালের প্রকৃত মূল্য দাঁড়ায় ৪২ টাকা। সেখানে সরকার সংগ্রহ মূল্য ধার্য করেছে প্রতি কেজিতে ৩৭ টাকা। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সরকার প্রতি কেজি চালে ৫ টাকা কম মূল্য ধার্য করেছে। ফলে চালকল মালিকগণ সরকারের সহিত চুক্তি করতে আগ্রহ দেখায়নি।

জানা গেছে, বাস্তব এ অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে চালকল মালিকগণ সরকারের খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করে প্রতি কেজি চালের মূল্য ৪২ টাকা নির্ধারণের জন্য অনুরোধ করলেও কোনো সুফল মেলেনি। ফলে এ বছর মোট ১৭ হাজার চাল কলের মধ্যে ১০ ভাগের বেশি চালকল মালিক চুক্তি করেননি। যারা চুক্তি করেছেন তারাও অতিরিক্ত বাজার মূল্যের কারণে খাদ্য গুদামে চাল জমা দিতে পারছেন না। গত বোরো মৌসুমেও ধান ও চাল সংগ্রহের দরে এমনিই ফারাক থাকার কারণে লোকসান গুনে চালকল মালিকগণ সরকারকে চাল দিয়েছে। ফলে আমনে অধিকাংশ চালকল মালিক সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হননি। বাস্তব এ কারণে গত বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ শতভাগ সফল হয়নি।

এরই মধ্যে টানা বর্ষণ, দফায় দফায় বন্যার কারণে এবার আমন আবাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উল্লেখ্য, খাদ্যভা-ারখ্যাত উত্তারাঞ্চলে উজানের পানির ঢলে ৬ বার বন্যা হয়েছে। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। ৫মবার বন্যা শেষে চাষিদের ধারণা ছিল, আর হয়ত বন্যা হবে না। তারপর চাষিরা অনেক কষ্টে আমন চারার বীজতলা ফেলে, আবার দূরদূরান্ত থেকে চারা সংগ্রহ করে তা রোপণ করে। এ বছর অতিরিক্ত বন্যা ও বৃষ্টির কারণে জমিতে পলির পরিমাণ বেশি থাকায় মাটির উর্বরাশক্তিও ভালো ছিল। ফলে খুব অল্প দিনের মধ্যেই আমনের মাঠ সবুজে সবুজে ভরে ওঠে। ধারণা ছিল, এ বছর আমনের বাম্পার ফলন হবে। দুর্ভাগ্য, ৬ষ্ঠবার ভারী বর্ষণ ও উজানের পানির ঢলে রাতারাতি আমনের মাঠ পানির নিচে তলিয়ে গেল। খানখান হয়ে ভেঙে গেল কৃষকের স্বপ্ন। অনেক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুড়িগ্রামে এ বছর ৬ষ্ঠবারের বন্যার কারণে অধিকাংশ কৃষক পরিবারে একদিনের খাবারের ধানও ঘরে ওঠেনি। কম-বেশি এ অবস্থা দেশের প্রতিটি জেলায়। সঙ্গত কারণে আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বেশি ছিল। মূলত সরকারের কৃষি বিভাগ ও খাদ্য বিভাগের সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে অনেক সময়ই ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হয় না।

বিশেষ করে তথ্য বিভ্রাটের কারণেও জনস্বার্থ কিংবা ভোক্তার স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়ে থাকে। এ বছর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) জানিয়েছে, চলতি বছর আউশ, আমন ও বোরো মিলিয়ে ৩ কোটি ৭০ লাখ ৪২ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। আগামী জুন পর্যন্ত মাথাপিছু দৈনিক ৪০৫ গ্রাম করে চাল ধরে ১৬ কোটি ৭০ লাখ মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ করার পরও ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। তাহলে চালের বাজার দর প্রতিদিনই বাড়ছে কেন? প্রকৃত অর্থে ‘কাজীর গরু খাতায় আছে, গোয়ালে নেই’ অবস্থার মতো যদি তথ্যউপাত্তে কাগজ-কলমের সঙ্গে বাস্তবতার মিল না থাকে, তাহলে গরমিল হওয়াটাই স্বাভাবিক!

বোরো ও আমন মৌসুমে সরকার ধান-চাল কিনতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারের গুদামের মজুদে ভাটা পড়েছে। খোদ খাদ্য অধিদপ্তরের ২৯ ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারের খাদ্য গুদামে চালের মজুদ আছে ৫ লাখ ৩৬ হাজার টন। অথচ গত বছর একই সময়ে চাল মজুদ ছিল ১০ লাখ ৬৬ হাজার টন। এখন প্রতি মাসেই খাদ্য মজুদ কমতে কমতে এখন মজুদ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছে গেছে। এদিকে করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হতে না হতেই বিশ্ববাজারে চালের দামও বাড়তে শুরু করেছে। এরই মধ্যে ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডে রপ্তানিযোগ্য চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বখাদ্য সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে ইঙ্গিত করা হয়েছে, চালের রপ্তানি বাজারে অস্থিরতা দেখা দিলে বাংলাদেশে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। জানুয়ারি থেকেই মজুদের অভাবে চালের বাজার অস্থির হতে পারে আরও। ফলে নিম্নবিত্ত, দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের খাদ্য সংকট তীব্র হতে পারে। এ দিকে ইউএসডিএর পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চলতি আমন মৌসুমে ৫ লাখ টন চাল কম উৎপাদন হয়েছে। এমতাবস্থায় চালের মূল্য বাড়াটাই স্বাভাবিক। তবে বাজার বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চালের রফতানি বাজার আরো অস্থির হওয়ার আগেই সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আরও ৭-৮ লাখ টন চাল আমদানি করা উচিত। তবে আমদানি শুরু হওয়ায় বাজারে দাম কমতে শুরু হয়েছে।

অবশ্য গত ২৭ ডিসেম্বর খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বেসরকারি খাতে চাল আমদানিতে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ হতে শুল্কহার কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে ১৩টি শর্তে চাল আমদানির সুযোগ দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে খাদ্য মন্ত্রণালয় ১০ লাখ মেট্রিক টন ও বেসরকারি ভাবে ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির সুযোগ দেবে। এ ব্যাপারে খাদ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রাজস্ব বোর্ডের সমন্বয়ে গঠিত টিম শর্তগুলো তৈরিতে কাজ করছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১০ জানুয়ারির মধ্যে আমদানিকারকগণ পরিমাণ ও সম্ভাব্য বাজার দরসহ তথ্যাদি ফরম পূরণ করে খাদ্য মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত বেসরকারি পর্যায়ে ৯ লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। গত ৯ জানুয়ারি বন্দর দিয়ে ভারত থেকে চাল আমদানি শুরু হয়। ওই দিন বন্দর দিয়ে তিনটি ট্রাকে ১১২ টন চাল আমদানি হয়।

১১ ও ১২ জানুয়ারি ২ দিনে ১২১৩ টন চাল আমদানির পর ১৩ জানুয়ারি এইচএম কোড নিয়ে প্রশ্ন তোলে ভারত। এরপর থেকে টানা পাঁচ দিন চাল আমদানি বন্ধ থাকে। বিষয়টি সুরাহা করতে এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয় যোগসাজসিক শুল্ক বন্দর ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিএন্ডএফ) এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। অবশেষে গত ১৭ জানুয়ারি নতুন এইচএম কোড সংকলিত প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর। এরপর সৃষ্ট জটিলতার নিরসন হয় এবং যথারীতি চাল আমদানি শুরু হয়। এরই মধ্যে স্থানীয় বাজারে ধানের দাম কমে এসেছে। আশা করা যাচ্ছে, চাল আমদানি পুরোপুরি শুরু হলে দ্রুত চালের বাজার দর কমে আসবে।

অবশ্য এ বছর ধানের ঊর্ধ্ব বাজার দর প্রসঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম ইঙ্গিত করে বলেছেন, বাজারে সংকট সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণ ধানের দাম বেশি। এখন কৃষক ভালো দাম পাচ্ছেন। আমরা এটাই চাইছি। এ বছর কোনো মিল মালিক আমাদের চাল দেয়নি। ফলে সরকার প্রাথমিকভাবে ১০ লাখ টন চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। যা দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। আর বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত আমদানির সুযোগটি অব্যাহত থাকবে মর্মেও তিনি মন্তব্য করেন। তবে আমরা মনে করি, অপরিকল্পিতভাবে বেসরকারি পর্যায়ে অতিরিক্ত চাল আমদানি করে উৎপাদকের স্বার্থও যেন কোনোভাবেই ক্ষুন্ন না হয়। বাস্তবে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার জন্য উৎপাদকের স্বার্থরক্ষারও কোনো বিকল্প নেই।

উল্লেখ্য, চাল আমদানির ঘোষণার পর এখন বাজারে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই স্থানীয় বাজারে ধানের দাম কমতে শুরু করেছে। তবে বেসরকারিভাবে আমদানির প্রক্রিয়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অনেক সময়ই বিলম্বিত হয়, তা যেন আর নয় যা খেয়ালে রাখতে হবে।

এ নিয়ে সতর্ক করেছেন, খাদ্যনীতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আখতার আহমেদ বলেন, বাজারে দ্রুত চালের জোগান না বাড়ালে দাম আবার বাড়তে পারে। এতে সাধারণ ভোক্তার কষ্ট বাড়বে। আমরাও মনে করি, বিলম্বে হলেও সরকারের শুল্কহার কমিয়ে চাল আমদানির জন্য নেওয়া সিদ্ধান্ত সঠিক ও সময়োচিত। এতে সাধারণ ভোক্তার কষ্ট অনেকাংশেই লাঘব হবে বলে বিশ্বাস।

আব্দুল হাই রঞ্জু: সাবেক ছাত্রনেতা

[email protected]

 
Electronic Paper