ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু আর কত

হাসনা হেনা
🕐 ১১:০২ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২০, ২০২১

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু আর কত

সড়ক যেন এক মৃত্যু ফাঁদ। পত্রপত্রিকার পাতায় কিংবা টিভির পর্দায় আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি সড়কে ভয়াবহ সব দুর্ঘটনার চিত্র। প্রতিটি জীবকে অবশ্যই মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হবে এটাই সত্য। তবে সবাই স্বাভাবিক মৃত্যু চায়। দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ কারওই কাম্য নয়। আমরা সবাই চাই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, দুর্ঘটনায় হতাহতের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়, এটি সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে আমাদের কী কিছুই করার নেই? যন্ত্রদানবের তাণ্ডবতা প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে নানা বয়স ও শ্রেণির মানুষের। প্রাণ আঁতকে ওঠে যখন দেখি একই পরিবারের চার-পাঁচজন একই সঙ্গে দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর সড়ক পথের যথেষ্ট উন্নতি হলেও জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল নয়। আমাদের দেশে শুধু মোটরযান সংখ্যাই প্রায় ৬ লাখেরও বেশি। রিকশা, ভ্যান, সাইকেল, ঠেলাগাড়ি, অটোরিকশা ইত্যাদি অগণিত। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে উন্নত দেশের তুলনায় এ সংখ্যা ৩০ গুণেরও বেশি। মানুষের জীবন মানেই বিভিন্নমুখী চাওয়া-পাওয়ার রণক্ষেত্র। আর জীবনের চাওয়া-পাওয়াগুলোর সম্মিলন ঘটাতেই মানুষকে ছুটতে হয় এদিক-ওদিক। কখনো জীবিকার অন্বেষণে কখনো অন্য কোনো প্রয়োজনে। ঘর থেকে বেরুলেই আমাদের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে সড়ক দুর্ঘটনা নামক আতঙ্ক।

দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেনি এমন কোনোদিন নেই। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোই কেবল অনুভব করতে পারে আপন কারও তরতাজা প্রাণ চলে গেলে কিংবা পরিবারের কেউ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করলে কতটা দুঃসহ যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে হয়। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে মা, বাবা হারাচ্ছেন তাদের প্রিয় সন্তান, সন্তান হারাচ্ছে তাদের বাবা, মা। কত স্ত্রী স্বামী হারিয়ে অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে আছেন তার হিসেব নেই। কত কুড়ি ফুল হয়ে ফোটার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে তারও হিসেব নেই। একটি সড়ক দুর্ঘটনার কারণে পরিবারের সবাইকেই হয়তো সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয় একটা দগদগে ক্ষত। আমাদের সবারই কম-বেশি জানা আছে আমাদের দেশের সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো। দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে বিভিন্নভাবে কখনো যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষে কখনো গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে কখনো পায়ে হেঁটে রাস্তা পার হওয়ার সময়, কখনো আবার দেখা যায় নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকা পথচারীর ওপর উঠে গেছে। এসব দৃশ্য দেখে মনে হয় মৃত্যু যেন ওত পেতে বসে আছে মহাসড়ক কিংবা অলিগলির সড়কগুলোতে। এ যেন নিষ্ঠুর মরণ খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ আমাদের একটু সচেতনা এবং দায়িত্বশীলতায় এ মরণ খেলা অনেকাংশে কমে আসতে পারে। বিশেষ করে শীত মৌসুম আসলেই সড়ক দুর্ঘটনা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

শীতের ঘনকুয়াশার ধূম্রজালে মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে উঠে দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক। বিশেষ করে আঁকাবাঁকা এবং উঁচু-নিচু সড়কগুলোতে এসময়টায় খুব সতর্কতার সহিত গাড়ি চালাতে হবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৫৫ জন ব্যক্তি প্রাণ হারাচ্ছে। বাংলাদেশ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রায় ১২ হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে আর আহত হচ্ছে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ। প্রতিবছর এই সংখ্যা কমছে না বরং বেড়েই চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে অতিরিক্ত গতি ও ওভারটেকিং-কে দায়ী করা হয়। পুলিশ রিপোর্টেও বলা হয় অতিরিক্ত গতি ও চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। এছাড়া গাড়ি দ্রুতবেগে ব্রিজে ওঠার সময় দুর্ঘটনা ঘটার ইতিহাসও রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ আইন অমান্য করা। এক জরিপে দেখা যায় ৯১ শতাংশ চালক জেব্রা ক্রসিংয়ে অবস্থানরত পথচারীদের পাত্তা দেয় না। পাশাপাশি ৮৫ ভাগ পথচারী নিয়ম ভেঙে রাস্তা পারাপার হয়। তাছাড়া এক সমীক্ষায় বলা হয় ঢাকা শহরের ৮৪ শতাংশ রিকশাচালক ট্রাফিক আইন ও নিয়ম সম্পর্কে অজ্ঞ। এছাড়াও রাস্তার প্রস্থতা কম হওয়া, লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়কের ওপর অবৈধ দোকানপাট, দীর্ঘ সময় ধরে রাস্তার ওপর সরঞ্জাম ফেলে রেখে স্থাপনা নির্মাণ, বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা না করে যখন-তখন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। মহাসড়কে সার্ভিস রোড ও শ্লথ গতির যানবাহনের জন্য পৃথক লেন থাকা জরুরি। মহাসড়কের নির্মাণে ত্রুটি ও দুর্বল সড়ক ব্যবস্থাপনার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ চালকেরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ চালকই পঞ্চম শ্রেণি পাস কিংবা আরও কম পড়াশোনা করেছে। প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে চালক হয়েছে, এমন চালকের সংখ্যা নিতান্তই কম। হেলপারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজে নিজে ড্রাইভিং শিখে কোনো রকম টাকা দিয়ে লাইসেন্স সংগ্রহ করে চালকের আসনে বসে গাড়ি চালানো শুরু করে। দালালের মাধ্যমে ভুয়া লাইসেন্স সংগ্রহ করে গাড়ি চালাচ্ছে এমন অনেক চালকও রয়েছে। কোনো ট্রাফিক আইন জানে না, সাইন-সিম্বল চেনে না, এরকম চালকরা দায়িত্ববোধ সম্পর্কে উদাসীন হয়ে থাকে। আসলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে চালক, যাত্রী, পথচারী, ট্রাফিক দায়িত্বে যারা আছেন সবারই সতর্ক থাকা জরুরি। পথচারীদের ট্রাফিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং রাস্তা পারাপারে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে হবে। যাত্রীদের প্রয়োজনীয় সেফটি ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করতে হবে। যেমন, সিট বেল্ট, হ্যালমেট, মাস্ক ইত্যাদি। মালিকপক্ষকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক নিয়োগ দিতে হবে। লাইসেন্স নেই এমন গাড়ির রোড পারমিট বাতিল করতে হবে। লাইসেন্সবিহীন চালকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। ফিটনেসবিহীন ও যান্ত্রিক ত্রুটিযুক্ত গাড়ির রোড পারমিট বাতিল করতে হবে। চালকদের ডোপ টেস্ট করে, গাড়ি চালানোর অনুমতি দিতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থায় গতি আনতে হবে। গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে ট্রাফিক কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। চালকদের অবশ্যই ওভারটেকিংয়ের মনোভাব পরিহার করতে হবে। চালকের গাড়ি চালানো অবস্থায় ফোনে বা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো যাবে না। ঝুঁকিপূর্ণ মোড়গুলোতে বিশেষ লাইটিংয়ের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে। শীত মৌসুমে কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তায় চালক, যাত্রী ও পথচারীদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

যাত্রী সেবার মানোন্নয়ন ও সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে, পরিবহন সেক্টরে সুশৃঙ্খলা আনতে প্রথমেই চালকদের প্রতি নজর দিতে হবে। দক্ষ, সচেতন, দায়িত্ববান ও পেশাদার চালক তৈরির জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনা থাকা অপরিহার্য। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য গাড়ির মালিকদের দায়ও কোনো অংশে কম নয়। কারণ অনেক মালিক ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চালাতে চালককে বাধ্য করে থাকেন। এছাড়াও একজন চালক একটানা ৬ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর কথা, অথচ অনেক মালিক চালককে দিয়ে ১৪-১৫ ঘণ্টাও গাড়ি চালিয়ে নিচ্ছেন। বিশেষ করে খুব ভোরে কিংবা সকালের দিকে যেসব দুর্ঘটনাগুলো ঘটে, সেগুলো বেশিরভাগই ঘুমের কারণে ঘটে। রাত জেগে গাড়ি চালানো খুব পরিশ্রমের কাজ। যেকোনো সময় ঘুম চলে আসতে পারে। তাই মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের এই বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তবেই এই সব দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে। অনেক যাত্রী চালকদের দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে উৎসাহিত করেন। এটা অবশ্যই পরিহার করতে হবে।

মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ গাড়িগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে চালকদের কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবহন সেক্টরে চালকরাই আসল চালিকাশক্তি। মূলত তাদের সচেতনতা সুশৃঙ্খলতার ওপরই নির্ভর করছে যাত্রীসেবার মান ও নিরাপত্তা। কিন্তু আমাদের দেশের পরিবহন শ্রমিকরা অনেকটাই অবহেলিত। তাদের সঠিক প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, তাদের বেতন-ভাতা বাড়াতে হবে, পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দিতে হবে, সামাজিকভাবে তাদের মর্যাদা দিতে হবে, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চাকরির পেশাদারিত্ব সৃষ্টি করতে হবে। পরিবহন খাতের দুর্নীতি সড়কে যান চলাচলের কর্তৃপক্ষ সমূহের দুর্নীতি এবং এসবের সুফলভোগীদের ওপর সরকারের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা যত বড় সমস্যাই হোক না কেন সকলের সামগ্রিক চেষ্টা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এটি প্রতিরোধে কাজ করলে দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে যাবে।

হাসনা হেনা : শিক্ষক ও সাহিত্যিক
[email protected]

 
Electronic Paper