চুলের চুলচেরা বিজ্ঞান বিশ্লেষণ
শেখ আনোয়ার
🕐 ১২:০৪ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৮, ২০২১
মানুষের সৌন্দর্যের একটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে চুল। চুল সৌন্দর্যের এক অলংকার। সুন্দর চুল কে না পছন্দ করে? রেশমি ঘন কালো চুলে মুগ্ধ হয়ে কত কবি-সাহিত্যিক যে গান, কবিতা রচনা করেছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তাই চুল এক ধরনের সম্পদ। আর নারীদের ক্ষেত্রে চুল অলংকারস্বরূপ। তাই চুল নিয়ে নারীদের চিন্তার শেষ নেই। লম্বা চুলের কদর রয়েছে যুগ যুগ ধরে, কালে কালে। মানুষ লম্বা চুলের জন্য কত যত্ন যে করে থাকে তার ইয়ত্তা নেই।
এখনো মানুষ লম্বা চুলের পাগল। স্নিগ্ধ বাতাসে যখন লম্বা চুল ঢেউ খেলে যায় তখন সেই সৌন্দর্যের কোনো উপমা খুঁজে পাওয়া যায় না। এই চুলের হিসাব করোনাকালে দরকারি। কারণ করোনার প্রথম ২৫টি উপসর্গের মধ্যে রয়েছে চুল পড়ে যাওয়া। যদিও করোনার সঙ্গে চুল পড়ার সরাসরি সম্পর্ক কী তা বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, করোনায় স্ট্রেস বা উদ্বিগ্নতা থেকে এই চুল পড়ে যায়। শরীরে একসঙ্গে অনেকটা ধকল বা স্ট্রেস তৈরি হলে বা কোনো ট্রমা হলে এই ধরনের উপসর্গ দেখা যেতে পারে।
চুল সম্পর্কে বিজ্ঞান কী বলে? চুল অন্তঃত্বক বা ত্বকের বহিঃস্তরে অবস্থিত ফলিকল থেকে উৎপন্ন চিকন লম্বা সুতার মতো প্রোটিন তন্তু। শুধু স্তন্যপায়ী প্রাণীর শরীরে পাওয়া যায় বলে চুল স্তন্যপায়ী প্রাণীর একটি নির্দেশক বৈশিষ্ট্য। চুলের প্রধান উপাদান হচ্ছে কেরাটিন। মানুষ ব্যতীত অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর শরীরে যে নরম, সুন্দর চুল পাওয়া যায় তাকে ফার বা লোম বলে, চুল নয়।
অন্যদিকে ভেড়া এবং ছাগলের শরীরে উৎপন্ন হওয়া কোঁকড়ানো চুলকে উল বলে। যদিও কিছু অ-স্তন্যপায়ী প্রাণী, বিশেষত পোকামাকড়ের দেহ থেকে চুলের মতো জিনিস বের হতে দেখা যায়। কিন্তু বিজ্ঞান সেগুলোকে চুল বলে না। গাছের গায়ে চুলের মতো রোঁয়া বের হতেও দেখা যায়। পোকামাকড় এবং মাকড়সার মতো কিছু প্রাণীর শরীরে যে রোঁয়া দেখা যায়, তা চুল নয়। এগুলো চিটিন নামের এক ধরনের পলিস্যাকারাইড। কিছু কুকুর, বিড়াল এবং ইঁদুর লোমবিহীন হয়। আবার কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে জীবনচক্রের নির্দিষ্ট সময় শরীরে লোম থাকে না।
চুলের রসায়ন
বিজ্ঞান মতে, চুলের গঠনগত মূল উপাদান প্রোটিন। চুল প্রধানত তন্তুময় প্রোটিন কেরাটিন দ্বারা গঠিত। সকল প্রোটিনের মতো কেরাটিনও অ্যামাইনো অ্যাসিড শৃঙ্খল দ্বারা গঠিত। তবে অন্য সকল প্রাণীর চুল বা উল থেকে মানুষের চুলের পার্থক্য রয়েছে। মানুষের চুলে প্রচুর পরিমাণে সিস্টিন নামক অ্যামাইনো অ্যাসিড রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের চুলের অধিকাংশ সালফার সিস্টিন আকারে থাকে। তাই সিস্টিন ঘাটতি কোনো খাদ্য বস্তুতে এই অ্যামাইনো অ্যাসিড যোগ করলে শরীরের অন্যান্য কোষ কলার বৃদ্ধির তুলনায় চুলের বৃদ্ধিকে বেশি উদ্দীপিত করে। তিন প্রকার বলের দ্বারা অ্যামাইনো অ্যাসিড শৃঙ্খলগুলো পরস্পরের সঙ্গে লেগে থাকে। যথা- হাইড্রোজেন বন্ধনী, ডাইসালফাইড সংযোগ এবং পানির আকর্ষণ বা পারস্পরিক ক্রিয়া।
এবার জানা যাক, চুলে শ্যাম্পু কন্ডিশনারের কাজ কী? চুলের প্রোটিন শৃঙ্খলগুলো হাইড্রোজেন বন্ধনী দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে লেগে থাকে। তাই চুলের ওপর শ্যাম্পু ও কন্ডিশনারের ক্রিয়া বোঝার জন্য হাইড্রোজেন বন্ধনীর গুরুত্ব রয়েছে। একটি শৃঙ্খলের কার্বোক্সাইড গ্রুপের সঙ্গে অন্যটির অ্যামাইনো গ্রুপ সংযুক্ত থাকে। চুল ভেজানো হলে গ্রুপগুলো পরস্পরের সঙ্গে বন্ধন না করে পানির সঙ্গে হাইড্রোজেন বন্ধনী তৈরি করতে পারে। ফলে শৃঙ্খলগুলোর মধ্যে হাইড্রোজেন আয়নের ঘনমাত্রার জন্য হাইড্রোজেন বন্ধনী ভেঙে যায়। এটি সাধারণত পিএইচ স্কেলে প্রকাশ করা হয়। শক্তিশালী ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক বল একটি আয়োনাইজড কার্বো অক্সাইড গ্রুপযুক্ত প্রোটিন শৃঙ্খলের সঙ্গে অপর একটি আয়োনাইজড অ্যামাইনো গ্রুপযুক্ত শৃঙ্খলকে ধরে রাখে। পিএইচের পরিবর্তনের জন্য লবণ সেতু ভেঙে যেতে পারে। পিএইচ কমে গেলে কার্বোঅক্সাইড গ্রুপ একটি প্রোটিন গ্রহণ করে ক্ষয় করে এর ঋণাত্মক আধান হারায়। পিএইচ বৃদ্ধি পেলে অ্যামাইনো গ্রুপ থেকে একটি প্রোটিন অপসারিত হয় এবং একটি ধনাত্মক আধান হারায়। উভয় ক্ষেত্রেই প্রোটন শৃঙ্খলগুলোর মধ্যে বল অনেকাংশে দুর্বল হয়ে যায়।
চুলের হাল ফ্যাশন কি খুবই দরকার? হাল ফ্যাশনে অনেকেই চুল কালার করছেন। ঢেউ খেলানো চুল বানিয়ে ফ্যাশন করছেন। কিন্তু জেনে রাখা দরকার, চুল ঢেউ খেলানো রাখতে প্রয়োজন বাড়তি কিছু যতেœর। নয়ত আপনার পছন্দের ঢেউ খেলানো চুল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আবার ভুল পরিচর্যায়ও নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঢেউ খেলানো চুল তৈরিতে তাপ দেওয়া হয় বলে ডাইসালফাইড সংযোগ ভেঙে যায় অথবা পুনঃস্থাপিত হয়। যখন চুল স্থায়ীভাবে ঢেউ খেলানো হয় অথবা সোজা করা হয় তখন একটি বিক্রিয়া ঘটে। এই শক্তিশালী বন্ধনী ভাঙার জন্য শক্তিশালী রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। ত্বকের কেরাটিনের তুলনায় চুলের কেরাটিনে প্রায় পাঁচগুণ বেশি ডাইসালফাইড সংযোগ রয়েছে। ঢেউ খেলানোর জন্য চুল পানিতে ভেজালে কেরাটিন পানি শোষণ করে এবং চুল নরম ও অধিকতর প্রসারণশীল হয়। বিজ্ঞান মতে, এই অবস্থায় পানিতে হাইড্রেজেন বন্ধনী এবং কিছু লবণ সেতু ভেঙে ফেলে। যেহেতু অ্যাসিড ও ক্ষার বিশেষভাবে লবণ সেতুকে ভেঙে ফেলে, সেহেতু চুলের পরিচর্যায় পিএইচ নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় ৪.১ মাত্রার পিএইচে সর্বোচ্চ সংখ্যক লবণ সেতু পাওয়া গেছে।
কালো চুল সাদা চুলের নেপথ্য কথা
চুল কালো হোক, সাদা হোক, বাদামি হোক চুলের দৃশ্যমান প্রোটিন অংশ সবসময় মৃত থাকে। কেবল চুলের গোড়ার অংশ সিরাম দ্বারা জীবন্ত থাকে। এই কারণে চুলে তেল না দিলেও চুল এমনিতেই তৈলাক্ত হয়। চুল ধোয়ার সময় এর সঙ্গে লেগে থাকা তেল ও ময়লা দূর হয়। চুল ধোয়ার কাজে, সাবানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি শ্যাম্পু ও মৃদু পানিতে ভালো কাজ করে। কিন্তু খর পানিতে চুলের ওপর মলিন আস্তরণ তৈরি করে। তাই অনেকেই ভিনেগার অথবা লেবুর রস দিয়ে চুল ধুয়ে এই আস্তরণ দূর করে থাকেন। এখন অবশ্য এর প্রয়োজন নেই। কেননা আধুনিক শ্যাম্পুতে কৃত্রিম ডিটারজেন্ট মেশানো থাকে। বড়দের সব শ্যাম্পুতেই থাকে সিন্থেটিক ডিটারজেন্ট। যা প্রায়ই অ্যানায়োনিক প্রকারের। যাতে থাকে ক্ষারীয় ধাতব লবণ এবং এসিড। অপরদিকে শিশুদের শ্যাম্পুতে থাকে অ্যাম্ফোটেরিক অক্সাইড। এটি নন মেটালিক অক্সাইড। তাই ছোটদের এই শ্যাম্পুতে চোখ জ্বালা করে না বললেই চলে। অ্যাসিড এবং ক্ষার উভয়ের সঙ্গেই অ্যাম্ফোটেরিক ডিটারজেন্ট বিক্রিয়া করতে পারে। এটি অ্যাসিড দ্রবণে প্রোটিন গ্রহণ করে এবং ক্ষারীয় দ্রবণে প্রোটিন ত্যাগ করে। শ্যাম্পুতে একমাত্র অত্যাবশ্যক উপাদান হলো কোনো এক প্রকারের ডিটারজেন্ট। তবে উচ্চমাত্রার ক্ষারীয় অথবা অম্লীয় শ্যাম্পু ত্বক ও চোখের প্রদাহ সৃষ্টি করা ছাড়াও চুলের ক্ষতি করতে পারে। অধিকাংশ শ্যাম্পুর পিএইচ-এর মান ৫ থেকে ৮ হয়ে থাকে। শ্যাম্পুর প্রোটিন বিশেষভাবে চুলের ফাটা প্রান্তকে জোড়া লাগায় এবং চুলের ওপর আস্তরণ তৈরি করে বলে চুল পুরু হয়। প্রোটিন শ্যাম্পু ছাড়াও তৈলাক্ত অথবা শুষ্ক চুলের জন্য শ্যাম্পু রয়েছে এবং মূলত এতে উপস্থিত ডিটারজেন্টের আপেক্ষিক পরিমাণের জন্য পার্থক্য হয়। তাই চুলে প্রতিদিন শ্যাম্পু না করাই ভালো। শ্যাম্পু করলে চুল আরও বেশি রুক্ষ হয়ে যায়।
চুলে রঙ করবেন কেন
এমনিতে প্রাকৃতিকভাবে মানুষের গায়ের ও চুলের রঙ প্রভাবিত হয় জাতি, লিঙ্গ, বয়স ইত্যাদি দ্বারা। বিজ্ঞান মতে, এটি মূলত নির্ধারিত হয় মেলানিনের পরিমাণ ও বিস্তার দ্বারা। মেলানিন হলো এক প্রকার রঞ্জক পদার্থ যা মেলানোসাইটে টাইরোসিন নামক অ্যামাইনো অ্যাসিড থেকে তৈরি হয়। তামা সম্বলিত এনজাইম টাইরোসিনেজ এই বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। মেলানিনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে শক্তিশালী জারক-বিজারক চুলের রঙের পরিবর্তন ঘটায়। মনে রাখতে হবে, কালোকেশীদের বেশি পরিমাণে এবং স্বর্ণাভকেশীদের কম পরিমাণে মেলানিন রঞ্জক পদার্থ থাকে। কালোকেশী স্বর্ণাভকেশী হতে চাইলে কালো রঙ জারিত করে বর্ণহীন করা হয়। বর্ণহীন করতে জারক হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ব্যবহার করা হয়। রঙিন চুলের রঙ ঠিক রাখতে চুলে লেবুর রস, টকদই ও ভিনেগার দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। পার্লারের বিউটিশিয়ানরা এই কারণ জানেন। এর যে কোনোটিতেই চুলের রঙ ফেইড হয়ে যায়। তবে চুল বর্ণহীন করার চেয়ে কালো করা অধিকতর জটিল প্রক্রিয়া। রঙ অস্থায়ী হতে পারে এবং পানিতে দ্রবণীয় ডাই ধুয়ে ফেলা যায়। কিন্তু কিছু ডাই চুলের ভিতরে প্রবেশ করে এবং সেখানেই থেকে যায়। প্রায়ই এই ডাইগুলো পানিতে দ্রবণীয় অবস্থায় ব্যবহৃত হয় এবং বর্ণহীন অগ্রবর্তী পদার্থ হিসেবে চুল শোষণ করে নেয়। পরবর্তীকালে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড দ্বারা জারিত হয়ে রঙিন যৌগে পরিণত হয়। স্থায়ী ডাই এর অধিকাংশই হলো একটি অ্যারোমেটিক অ্যামিন ডেরিভেটিভ। একে বলে প্যারা ফিনাইমিনিডাই অ্যামিন। যা নিজেই কালো রঙ তৈরি করে এর ডেরিভেটিভ, প্যারা অ্যামাইনোডাইফিনাইল অ্যামিন সালফোনিক অ্যাসিড। এগুলো ব্যবহৃত হয় স্বর্ণাভ ফরমুলেশনে। অন্যান্য ডেরিভেটিভ ব্যবহার করে মধ্যবর্তী রঙ পাওয়া যেতে পারে। তবে এ রকম একটি ডেরিভেটিভ ফেনিলিন ডাইঅ্যামিন এবং এর সালফেট লবণ ইঁদুরে ক্যান্সার সৃষ্টি করে বলে প্রমাণিত হয়েছে। এরই একটি সাবস্টিটিউট মানুষেরও ক্যান্সার সৃষ্টি করে থাকে। পার্লারের রঙিন চুলের জন্য আরেকটি সতর্কতা হচ্ছে রঙিন চুল যতটা সম্ভব ইস্ত্রি বা আয়রন এড়িয়ে চলতে হবে। রঙিন চুলে আয়রন করলে রঙ হালকা হয়ে যায়।
গবেষকদের মতে, চুলের বহিঃস্থ মৃত অংশ শাপট-এর ওপরই কেবল চুলের ডাই-এর প্রভাব রয়েছে। কেননা মাথার খুলি থেকে যে নতুন চুল গজায় তার প্রাকৃতিক রঙ থাকে। প্রকৃতপক্ষে, ত্বক অভেদ্য ও রক্ষাকারী ঝিল্লী হিসেবে কাজ করে অংশত সিবেসাস গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত মোমের মতো সিবাস প্রতিবন্ধক স্তরের উপস্থিতির জন্য। এগুলো পানি ও ইলেক্ট্রোলাইটের প্রবেশে বাধা দেয়। তবে ত্বক সম্পূর্ণরূপে অপ্রবেশ্য নয়। কেননা লিপিড দ্রাবক এবং লিপিডে দ্রবীভূত কতিপয় পদার্থ, যেমন কিছু কিছু স্টেরয়েড, ভিটামিন, ওষুধ এবং বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বিভিন্ন মাত্রায় শোষিত হয়।
কোঁকড়ানো চুল
চুল কোঁকড়ানো করলে চুলের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। কোঁকড়ানো চুলের রসায়ন খুবই আগ্রহোদ্দীপক। স্থায়ী ঢেউ খেলানো চুলের জন্য কেরাটিন অণুর গঠনের পরিবর্তন হয়। চুল ঢেউ খেলানো করার সময় যে ভেজা তাপ ব্যবহৃত হয়, তা কেরাটিনের ডাইসালফাইড বন্ধনীকে মুক্ত করে দেয়। যদি চুল কৃত্রিমভাবে কোঁকড়া করে শুকানো হয়, তাহলে ডাইসালফাইড বন্ধনী আবার তৈরি হয় এবং ঢেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে থেকে যায়। চুলের স্থায়ী ঢেউয়ের জন্য কেউ কেউ বিজারক সম্বলিত, যেমন থায়োগ্লাইকোলিক অ্যাসিড, লোশন ব্যবহার করেন। এই লোশন ডাইসালফাইড সংযোগকে ভেঙে ফেলে এবং প্রোটিন শৃঙ্খল দূরে সরে যায়। তারপর চুলে হাল্কা জারক, যেমন হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড লাগিয়ে কালার অথবা রোলারের ওপর রাখা হয়। এতে নতুন অবস্থানে ডাইসালফাইড সংযোগ তৈরি হয় এবং চুল নতুন আকৃতি ধারণ করে। কোঁকড়ানো চুলকে সোজা করতে একই রাসায়নিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করা যায়।
চুল পাকে কেন
আমাদের মাথায় এক থেকে দু’লাখ চুল থাকে। আমাদের ত্বকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকে, একে ফলিকল বলে। এরা বৃদ্ধি পায়। বছরে প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার হারে চুল লম্বা হয়। এমন কি যখন আমাদের দেহের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়, তখনও চুলের বৃদ্ধি চলে। চুলের শাফট একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যে পৌঁছালে, উপযুক্ত পুষ্টির অভাবে এর বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর এটি পড়ে যায়। তবে নতুন চুল দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মেলানিনের সরবরাহ কমে যায় অথবা বন্ধ হয়ে যায় এবং চুল মূল রঙের পরিবর্তে সাদা হতে থাকে। যাকে আমরা বলি চুল পেকেছে। বর্তমানে অনেক কম বয়সী ছেলেমেয়েদেরও চুল পেকে সাদা হয়ে যাচ্ছে। এটি বংশগত কারণে হয়, অপুষ্টি, টেনশন এং গভীর মানসিক দুঃখ পাওয়ার জন্যও মেলানিন তৈরি হ্রাস পেতে পারে। ফলে চুল সাদা হয়। কঠিন অসুখের জন্যও মেলানিন তৈরি প্রভাবিত হয়।
মাথায় কেন টাক পড়ে
টাক প্রধানত দু’প্রকারের। যথা, স্থায়ী এবং অস্থায়ী। স্থায়ী টাকের তিনটি প্রভাবক হলো বংশগতি, বয়স এবং পুরুষ যৌন হরমোন বা অ্যান্ড্রোজেন। স্থায়ী টাকের অন্যান্য কারণ হলো চর্মরোগের জন্য ক্ষত, আঘাত, জন্মগত ত্রুটির কারণে চুল না গাজানো এবং রাসায়নিক ও ভৌত এজেন্টের জন্য চুল গজানো কেন্দ্রের ক্ষতি। অস্থায়ী টাকের কারণ হলো অতিমাত্রায় জ্বর, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি। দুর্বলতার জন্যও চুল পড়ে যেতে পারে। রোগ ও দুর্বলতার কারণে যে টাক পড়ে তা পুষ্টিকর খাবার ও টনিক খেলে ঠিক হয়ে যায়। এক্স রশ্মি সম্পাত, (ক্যান্সার থেরাপি) কতকগুলো ওষুধ সেবন, (যদি কোনো ওষুধ সেবনের জন্য চুল পড়ে সে ক্ষেত্রে ঐ ওষুধ বন্ধ করতে হবে।) অপুষ্টি, চর্মরোগ, অ্যান্ডোক্রাইনের গোলযোগ অস্থায়ী টাকের আরও কতকগুলো কারণ। এছাড়া মানসিক চাপ, বড় কোনো রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, মাথার ত্বকে চর্মরোগ, খুশকি, ঘুম কম হওয়া, যথাযথ পুষ্টির অভাব, হরমোনের সমস্যা, বংশগত কারণেও চুল পড়তে পারে।
চুল পড়া কি করোনার উপসর্গ
জি হ্যাঁ। সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা যায়, হঠাৎ অতিরিক্ত চুল পড়ে যাওয়া করোনার উপসর্গ। চুল পড়ে যাওয়া যদিও বহু মানুষের মধ্যে বিভিন্ন কারণে দেখা যায়। কিন্তু করোনার কারণেও চুল উঠতে পারে বলে জানাচ্ছে নতুন গবেষণা। বিশেষত বহুদিন ধরে এই ভাইরাসে আক্রান্ত থাকলে চুল পড়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা যায়। যদিও চুল পড়া সম্পূর্ণরূপে নিরাময়ের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ওষুধ অথবা থেরাপি উদ্ভাবিত হয়নি।
করোনাকালে উপযুক্ত চুলের যত্ন এবং পুষ্টিকর খাবার খেয়ে চুল পড়া, টাক পড়া কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আগেই বলা হয়েছে, চুলের গঠনগত মূল উপাদান প্রোটিন। তাই প্রথমেই চুলের জন্য প্রোটিন জাতীয় খাবার যেমন- মাছ, দুধ, দই, মুরগির মাংস, ডিম, বাদাম ইত্যাদি খেতে হবে। পাশাপাশি প্রচুর ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে। কারণ এসবে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন ও খনিজ উপাদান যা মানব সৌন্দর্যের প্রতীক, মূল্যবান চুলকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক