ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কুটি মনসুর: কে বলে মানুষ মরে

শ্রদ্ধাঞ্জলি

বঙ্গ রাখাল
🕐 ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৭, ২০২১

কুটি মনসুর: কে বলে মানুষ মরে

গীতিকার-সুরকার কুটি মনসুরের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে-ছাত্র অবস্থায়। আড্ডার আসরে কবি বন্ধু লিটন বলল, কুটি মনসুরের গান শুনতে পারিস। নামটাই কেমন যেন আকর্ষণ ধরাল। মনের মধ্যে একধরনের তাগাদা অনুভব করলাম। এসে সার্চ দিয়ে সারা রাত শুনেছিলাম- কে বলে মানুষ মরে/ বুঝলাম না ব্যাপার। গানটা শুনে ঝিম ধরে বসেছিলাম, আর ভেবে ছিলাম- যে মানুষ এই গান লিখতে পারে সেই মানুষের চিন্তার জায়গা কতই না প্রখর? সেই থেকে তাকে নিয়ে কাজ করার প্রবল ইচ্ছাশক্তি জন্ম নেয় হৃদয়ের গহীন কোণে। শুরু হয় তথ্য সন্ধানের পথে এগিয়ে চলা।

১৯২৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার লোহারটেক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা গানের পরিচিত নাম কুটি মনসুর। কুটি মনসুরের মূল নাম মো. মনসুর আলী খান হলেও তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হওয়ায় আদর করে মায়ের ডাকা নাম কুটি মনসুর। এ নামেই তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। কুটি মনসুরের পিতা আবেদ আলী খান ও মাতা আবেদুন্নেসা। তিনি ১২ বছর বয়স থেকে সঙ্গীতে তালিম গ্রহণ শুরু করেন এবং ১৫ বছর বয়সেই নিজে গান রচনা করে তাতে সুর সংযোজন করে নিজেই বিভিন্ন মঞ্চে পরিবেশন করতে শুরু করেন। তার লেখা ‘আমি কি তোর আপন ছিলাম না রে জরিনা’ গানটি শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কালজয়ী গানটি এখনো লোকের মুখে মুখে ফেরে। এরকম আরও অনেক গান রয়েছে এর মধ্যে কয়েকটি গান হলো- আইলাম আর গেলাম’; ‘যৌবন জোয়ার একবার আসে রে’; ‘কে বলে মানুষ মরে’; ‘হিংসা আর নিন্দা ছাড়ো’; ‘সাদা কাপড় পরলে কিন্তু মনটা সাদা হয় না’।

কুটি মনসুর ৬০ বছরের সংগীতজীবনে প্রায় আট হাজার গান লিখেছেন। এসবের মধ্যে পল্লিগীতি, জারি-সারি, পুঁথিপাঠ, আধুনিক, ভাটিয়ালি, পালাগান, মুর্শিদী, আধ্যাত্মিক, মারফতি, দেহতত্ত্ব, হামদ-নাত ও ইসলামি গান অন্যতম। তিনি ১৯৫৯ সালে মৎস্য অধিদফতরে চাকরিতে যোগদান করেন। একই বছর কণ্ঠশিল্পী এবং ১৯৬২ সালে গীতিকার ও সুরকার হিসেবে বেতারে তালিকাভুক্ত হন। এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকে গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ১৯৮২-১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ পরিদফতরের অধীনে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধকরণের নিমিত্তে তার রচিত ৩০০ গান দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাউল শিল্পীদের প্রশিক্ষণের কাজ করেছেন এবং তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের কণ্ঠশিল্পী অডিশন বোর্ডের সম্মানিত বিচারক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমিতে ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত অধ্যক্ষ হিসেবে এবং আনসার ভিডিপিতে ১৯৯৭-২০০২ সাল পর্যন্ত সঙ্গীত প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও দেশভিত্তিক প্রচুর গান ও কবিতা রচনার পাশাপাশি তিনি প্রায় ৫০টি বিষয়ে ৮ হাজার গান রচনা ও ৪ হাজার ৫০০ গানের সুরারোপ করেছেন। তার রচিত ও সুরারোপিত আড়াই শত গান ঢাকা রেকর্ড ও ইপসা রেকর্ড নামের দুটি গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে লং প্লে ডিস্ক রেকর্ডে প্রকাশ হয়েছে। এসব গানের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে- ন্যায্য কথা বলতে গিয়া শেখ মুজিবর জেলে যায়,/ বাঙালিরা দোষী কোন জায়গায়,/ শিয়াল কয় খাটাশ ভাইরে,/ যৌবন জোয়ার একবার আসে রে/সখি রে ইচ্ছা হয় ডুবিয়া মরি নদীর জলে। এসব গান নাকি তৎকালে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল, মাইক মালিকদের কাছে এ গান না থাকলে মাইকই ভাড়া হতো না। বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত জনসংখ্যা সমস্যার উপরে তার লেখা অসংখ্য গান বাংলাদেশ বেতারের জনসংখ্যা কার্যক্রমে এবং টেলিভিশনে নিয়মিত প্রচার হয়েছে এবং এখন পর্যন্তÍও হচ্ছে।

কুটি মনসুরের লেখা ছড়া ও কবিতা দেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশ হয়েছে। এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- মৎস্য উন্নয়নে উদ্বুদ্ধকরণের গান ও কবিতা সম্বলিত বই ‘মীন গীতিকা’, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধকরণের বই ‘পরিবার-পরিকল্পনার গান’, ‘কুটি মনসুরের অমর সঙ্গীত’, ‘কুটি মনসুরের ভান্ডারী গান’, এবং ‘আমার বঙ্গবন্ধু আমার ৭১’।

কুটি মনসুর তার গভীর দেহতত্ত্ব গানে তার পরিচয় তুলে ধরেছেন- সেই সঙ্গে বাউলিয়ানা মনবাসনার সন্ধান দিয়েছেন। মানুষ মারা যায় না, তার কর্ম থেকে বিদায় নেয়। এমন নানা প্রশ্নে মনসুরের মন তাড়িত ছিল। তবে মরণে তার বিশ্বাস ছিল না। তিনি পরম আত্মার সঙ্গে জীব আত্মার বিলীনতাকেই প্রকাশ করেছেন দার্শনিক এই বয়ানের মাধ্যমে- কে বলে মানুষ মরে/ আমি বুঝলাম না ব্যাপার/ মানুষ মরিয়া গেলে বিচার হবে কার/ পঞ্চ আত্মা পঞ্চ রুহ হিসাবেতে দেখতে পাই/ আবার একেতে হয় দুয়ের জন্ম/ পরম আত্মার মরণ নাই।/ পরম আত্মার কর্ম লইয়া/ জীব আত্মা যায় বিলীন হইয়া/ জন্ম-মৃত্যু নাম ধরিয়া/ চালাইছে কোন কারবার...।

কুটি মনসুরের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রায় সব খ্যাতমান শিল্পী। তার কথা ও সুরে গান গেয়েছেন সৈয়দ আবদুল হাদী, এন্ড্রু কিশোর, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, দিলরুবা খান, নীনা হামিদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, ফকির আলমগীর, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, ফিরোজ সাঁই, কিরণ চন্দ্র রায়, মুজিব পরদেশী, মমতাজ, জানে আলম, ডলি সায়ন্তনী, মীনা বড়ুয়া, মনির খান, এম এ মতিন, রবি চৌধুরী, শুভ্র দেবসহ আরও অনেকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় জীবদ্দশায় এই শিল্পীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। তাই তো মারা যাওয়ার সময় তার সন্তানদের গভীর কষ্ট ও ক্ষোভ থেকে বলেছেন, বেঁচে থাকতে যেহেতু আমার কোনো মূল্যায়ন হলো না, তাই আমি মারা যাওয়ার পর কোনো মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়া হলে তোমরা তা গ্রহণ করো না। নিজের বিশ্বাসে তিনি ছিলেন একজন অটুট মানসিকতার মানুষ। বিশ্বাস করতেন মানুষের বিনাশ নাই। এই মানুষই তো আল্লাহ, ভগবান।

বঙ্গ রাখাল: কবি, গবেষক ও ছোটকাগজকর্মী

[email protected]

 

 
Electronic Paper