গ্রুপ স্টাডির অতীত ও বর্তমান
অপর্ণা দত্তগুপ্ত
🕐 ১২:৫৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৫, ২০২১
টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোতে যখন ‘ব্রেকিং নিউজ’ শব্দটি দেখি তখন কিছুক্ষণের জন্যে হলেও চমকে উঠি। ব্রেকিং নিউজে আবার কি খবর এলো? ঠিক এমন একটি ব্রেকিং নিউজ গত ৭ তারিখ রাতে চোখে পড়ল। মাস্টারমাইন্ড স্কুলের এক কিশোরীর মৃত্যুর সংবাদ। পরবর্তীকালে জানলাম গ্রুপ স্টাডি করতে গিয়ে হতভাগ্য মেয়েটি মারা যায়। বহুদিন পর গ্রুপ স্টাডির কথা মনে পড়ল।
যখন ’৮০-এর দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম এবং পুরোনো শামসুন নাহার হলের ছত্রিশ নম্বর রুমে থাকতাম। আমার চট্টগ্রাম শহরে নিকট আত্মীয়ও ছিল না। সুদূর নোয়াখালী থেকে আসা-যাওয়া করতাম। হলের রুমমেটরা আমার পরমাত্মীয়ও বটে। রুমের জুনিয়ররা যখন বাইরে যেত তখন আমাকে বলে যেত সিনিয়র হিসেবে, ‘দিদি, খেলার মাঠে গ্রুপ স্টাডি করতে যাচ্ছি।’ তারা তাদের অন্য ছেলেবন্ধু বা মেয়েবন্ধুর নামও বলত যাদের সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি করত। ঠিক তেমনি আমিও যখন আমার বন্ধুদের সাথে গ্রুপ স্টাডি করতাম পরীক্ষার সময় তাদের কাছে বলে যেতাম। গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে পুরো মাঠটার একাংশ ভরে যেত পরীক্ষার আগে। ২ ঘণ্টা পড়াশোনা করে অনেক সুন্দর মন নিয়ে হলে ফিরতাম এবং এক সময় পরীক্ষা হতো এবং ভালো ফলাফলও করতাম। একই সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি করতাম আর নির্বাচনে বন্ধুর পক্ষে ভোট চাইতাম ক্যাম্পাসে বা হলে। কোথায় আমার মা-বাবা বা বড় ভাই-বোন আর কোথায় আমি; তাদের শতভাগ বিশ্বাস ও আস্থা ছিল সন্তানের প্রতি।
বর্তমান সময়ের মতো আমাদের মায়েরা ঘরে-বাইরে এত ব্যস্ত ছিল না। এখনকার মতো দুই-একটি সন্তানও ছিল না। প্রতিটি ঘরে পাঁচ-ছয়জন করে সন্তান। কিন্তু মায়ের অন্তরে ছিল ভালোবাসা এবং চোখে-মুখে শাসন। বর্তমান সময়ে আমরা বোধহয় আমাদের সন্তানের প্রতি বেশি ভালোবাসা বা বিশ্বাসের মাত্রাটি বাড়িয়ে দিয়েছি সেজন্য বেশি কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। নিজের কাছে সন্তানকে রেখেও সন্তানের নিরাপত্তা দিতে পারছি না। একজন মা চাকরি করে তার পরিবারকে ভালো রাখার জন্য সঙ্গে সঙ্গে নিজের মেধাকে সমাজে কাজে লাগানোর জন্যে।
সেখানে সন্তানদের মা-বাবার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলা, বখাটে বন্ধু নির্বাচন করা সবটার জন্যই আমাদের সমাজব্যবস্থা দায়ী বা পরিবারের নৈতিক শিক্ষার অভাব। আমার মতো মফস্বল থেকে আরও হাজার মা-বাবার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে থেকে পড়েছে অতীতে এবং বর্তমানেও পড়ছে বা ভবিষ্যতেও পড়বে কিন্তু এ রকম মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করছে কি না তা আমার জানা নেই। হাজার হাজার সন্তান দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে পড়াশোনা করবার জন্য প্রতিবছর। আমার বোন ১৭ বছর বয়সে সুদূর রাশিয়ায় গেছে পড়তে। দীর্ঘ ১০ বছর পড়াশোনা শেষ করে দেশে আসে কোনো ছেলেবন্ধু ছাড়াই। এখনকার প্রতিটি মা শিক্ষিত সে কর্মজীবী হোক বা না হোক কিন্তু সন্তান পালন করতে আমাদের মায়ের মতো শাসন করতে হবে অন্তরে লুকানো ভালোবাসা নিয়ে। না হলে হতভাগ্য কিশোরীর মায়ের মতো আমাদের প্রতিনিয়ত কাঁদতে হবে। সমাজব্যবস্থা হতো রাতারাতি পরিবর্তন করা যাবে না কিন্তু পরিবারকে তো করা যাবে। আর যেন কখনো এ রকম বুকভাঙ্গা ব্রেকিং নিউজ না আসে এটাই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা।
অপর্ণা দত্তগুপ্ত : অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। শ্যামলী, ঢাকা ১২০৭