ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ক্রিস্টোফার কলম্বাস

হাফিজ উদ্দীন আহমদ
🕐 ১২:৩২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৪, ২০২১

ক্রিস্টোফার কলম্বাস

কখন থেকে ঘুরছি মেরিটাইম মিউজিয়ামে। কী বিচিত্র সংগ্রহ! যত দেখছি ততই মোহিত হচ্ছি। ঢোকার সময়ই রিসেপশনের ইউনিফর্মধারী সুন্দরী ব্রিটিশ গাইড বলে দিয়েছে এক তলা দু’তলা ও তিন তলায় বিভিন্ন জোনে কোথায় কী আছে। আমার সামনে এখন কলম্বাসের বিরাট রঙিন চিত্র। পাশে তিনি যে বাহামাতে অর্ধনগ্ন আদিবাসীদের মাঝে তার জাহাজ শান্তা মারিয়া, নিনা ও পিন্টা ভিড়িয়ে নেমেছিলেন তার হাতে আঁকা ছবি। ডিসকভারি অব আমেরিকা শিরোনাম দিয়ে নিচে লেখা : ফার্স্ট ল্যান্ডিং অব কলম্বাস এট আমেরিকা। দিনটা ছিল ১২ মে (মতান্তরে ১২ অক্টোবর), ১৪৯২। তবে কে প্রথম আমেরিকা আবিষ্কার করেছিল এ নিয়ে কিছু উৎসাহী পণ্ডিত বিভিন্ন কথা বলেন। ১৯৬৬ সালে ইংরেজ পণ্ডিত অলউইন রাডক নানা দলিলপত্র ঘেঁটে মত দেন ভেনিসিও নাবিক জুয়ান শ্যাবতো ১৪৭০ সালের দিকেই আমেরিকায় হাজির হয়েছিলেন। তিনি ইংল্যান্ড থেকে রওনা হয়েছেন বলে তাকে ইংরেজরা জন ক্যাবট বলে।

ইতালীয় ইতিহাসবিদ ফ্রান্সেস্কো গিডি-ব্রাস্কোলি একটা পুরনো পার্চমেন্ট মানচিত্র পেয়ে তাতে ইতালীয় ভাষায় ভেনিসের গিওভান্নি শ্যাবটকে (ক্যাবট) নতুন দেশে যাত্রার নির্দেশ দেওয়া আছে দেখতে পান জানান। কেউ কেউ বলেন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ভাইকিং জলদস্যুরা এদের সবার আগে এ অঞ্চলে যাওয়া আসা করত। তারাই প্রথম ইউরোপীয়, যারা উত্তর আমেরিকার ভূখণ্ডে যায় যা কলম্বাস পারেননি। কলম্বাসের অনেক পর ইতালির আরেক নাবিক ১৪৯৭-১৫০৪-এর মাঝে প্রথমে স্পেন ও পরে পর্তুগালের পক্ষে দুবার মূল ভূখণ্ডে আসেন ও তার বর্ণনা দিয়ে দুটি ছোট ভ্রমণ পুস্তক লেখেন। সেই আমেরিগো ভেসপুচির নামেই মহাদেশটির নাম হয় আমেরিকা। অন্য এক দলের আবার মত, মধ্য এশিয়ার ইসলামি পণ্ডিত পৃথিবী গোল যার জানা ছিল সেই আবু রায়হান আল-বিরুনি এ কৃতিত্বের দাবিদার। অবশ্য এ নিয়ে কোনো বিতর্কে যাচ্ছি না আমি। অদূরে স্পেনের রাজা ফার্ডিনান্ড ও রানি ইসাবেলাকে কলম্বাস তার ভ্রমণের লিখিত বৃত্তান্ত রাজদরবারে নিবেদন করার হাতে আঁকা চিত্র শোভা পাচ্ছে। পাশে তার আমেরিকা আবিষ্কারের স্মরণে বের করা বেশকিছু মেডেল সাজানো। তবে কলম্বাস আসলে কি নমস্য? কারও কাছে তিনি পৃথিবী বিখ্যাত বীর আর কারও কাছে মহাশয়তান।

যারা বীরত্বের মুকুট পরান তারা বলেন তার এ আবিষ্কারের সুবাদেই আজ গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের স্বর্গ হয়ে উঠেছে আমেরিকা। এমনকি তার এ আবিষ্কারের ফলে এ নতুন মহাদেশ অর্থাৎ প্রায় অর্ধ পৃথিবী ক্রমান্বয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়, তাই আইরিশ ক্যাথলিকরা তাকে ঈশ্বর প্রেরিত মহামানব ভাবতে শুরু করে। কিন্তু তিনি আদিবাসীদের ওপর যে গণহত্যা, পাইকারি ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও লোমহর্ষক নির্যাতন চালিয়েছিলেন তা জগতে বিরল। তাদের তিনি দাসত্বের জালে আবদ্ধ করে নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ চালান সেথায়। ফেরার পথে বেশকিছু আদিবাসী নর-নারীকে গলায় ও হাতে পায়ে বেড়ি পরিয়ে লোহার শিকল দিয়ে গরু-ছাগলের মতো বেঁধে রাজ দরবারে নিয়ে আসেন সে দেশের মানুষের নমুনা দেখতে। ইসাবেলা এতে তার ওপর ভীষণ রুষ্ট হন ও সঙ্গে সঙ্গে লোকদের মুক্ত করে দেন। অবশ্য কিছু বিরল উদ্ভিদ ও তোতা পাখি নিয়ে এসেছিলেন তিনি উপহার হিসেবে। তবে আরও একটি জিনিস নিয়ে এসেছিলেন তিনি যা রানি জানতেন না তা হলো একটি ভয়ানক রোগ, যা তিনি পাইকারি ধর্ষণ দ্বারা অর্জন করেছিলেন তথা পরবর্তীকালে সারা সভ্য দুনিয়াতে এ নতুন রোগ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং যে রোগ হলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ অকেজো হয়ে একদিন পক্ষাঘাত ও ক্রমে পাগল হয়ে যায় মানুষ ও পুরুষানুক্রমে ছড়ায়। রোগটি হলো সিফিলিস। এ সম্পর্কে প্রতিটি মেডিকেল কলেজে পাঠ্য লন্ডনের এইচ কে লুইস অ্যান্ড কো. লিমিটেড হতে প্রকাশিত বেইলি অ্যান্ড লাভস শর্ট প্র্যাকটিস অব সার্জারি বইতে লেখা আছে- ‘অন হিজ রিটার্ন ফ্রম হাইতি টু বার্সেলোনা ইন ১৪৯৩ কলম্বাস ব্রট ব্যাক সিফিলিস, প্যারোটস, অ্যান্ড রেয়ার প্ল্যান্টস’ বটোলোমে লাস কাসাস নামে এক স্পেন দেশীয় পাদ্রী তার মৃত্যুর প্রায় ৫০ বছর পর প্রশ্ন রেখেছেন সভ্য সমাজের কাছে- এ নির্যাতন কি আদৌ প্রয়োজন ছিল? কলম্বাসের সফরের বিস্তারিত বর্ণনা রেখেছেন তিনি। সোজা ভাষায় অনেকে তাকে জলদস্যু আখ্যা দেন। মৃত্যুর পর প্রায় ২০০ বছর তাই তাকে নিয়ে কেউ মাতামাতি করেনি। তবে ক্রমে আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী লোক বাড়তে থাকলে তারা নিজেদের ইংরেজ থেকে আলাদা ভাবতে থাকে এবং ১৭৯২ সালে ঘটা করে আমেরিকা আবিষ্কারের তিন শত বছর উদযাপন করে। নিউইয়র্কস্থ কিং কলেজের নাম বদলে রাখা হয় কলম্বাসের নামে, রাজধানী ওয়াশিংটন এলাকার নাম দেওয়া হয় ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া। এমনকি দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরের দেশটির নাম দেয় দেওয়া হয় কলম্বাসের নাম অনুযায়ী রিপাবলিক অব কলম্বিয়া। কিন্তু মজার ব্যাপার কলম্বাস কখনো সে দেশটিতে আসেননি। ১৪৯৯ সালে দেশটি আবিষ্কার করেছিলেন এলোনসো দি ওজেডা।

কলোম্বাসকে কেউ বলেন পর্তুগিজ, কেউ গ্রিক বা আর্মেনীয়। কেউ আবার কলম্বাসের সঙ্গে রানি ইসাবেলার রোমান্টিক সম্পর্কের ইশারা দেন। বলেন ইসাবেলা নাকি তার সমুদ্রাভিযানের খরচ মেটাবার জন্য তার গায়ের অলংকার খুলে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এ সবই মিথ্যা। সুঠামদেহী লালচে চুলের অধিকারী কলম্বাস ছিলেন ইতালীয় এবং এক গরিব তাঁতি পরিবারে জন্মেছিলেন জেনোয়াতে ১৪৫১ সালে। এ পরিচয় তিনি মুছে দিতে সবসময় হীনম্মন্যতায় ভুগেছেন। খুব লেখাপড়ারও সৌভাগ্য হয়নি। বাবা ছিলেন ঋণগ্রস্ত। তাই অল্প বয়সেই বাণিজ্য আর অ্যাডভেঞ্চারের নেশা পেয়ে গিয়েছিল তাকে। ইতালির সঙ্গেই ভূমধ্যসাগরে নৌ পরিচালনা করে বেশ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন সমুদ্র ও নৌ চালনা সম্পর্কে। ভারতের ধন ঐশ্বর্যের অনেক কিংবদন্তি শুনেছেন তিনি ছোটবেলা থেকে। শুনেছেন সেখানকার জিভে লালা ঝরানো মসলার কাহিনি। সুতরাং পূর্ণবয়স্ক হয়ে ভারতে যাওয়ার পথ আবিষ্কারের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। টলেমি, প্লিনি, স্প্যারো প্রমুখের বই গোগ্রাসে গিলতে থাকেন ভৌগোলিক জ্ঞানের জন্য। ভাবেন আটলান্টিকের ওপারেই হয়তো পেয়ে যাবেন সে স্বপ্নের দেশ, কিন্তু এর জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।

প্রথমে পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয়জনের কাছে যান সাহায্য চাইতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে পরে রাজা ফার্ডিনান্ড ও রানি ইসাবেলার দ্বারস্থ হন। তারাও তাকে ফিরিয়ে দেন। কলম্বাস একে একে ডিউক অব মেডিনা, অতঃপর ডিউক অব মেডিনা কেলির দ্বারস্থ হন। এর মাঝেই ইসাবেলার মন একটু গলে। তিনি কলম্বাসকে ডেকে পাঠান। তিনি তার যাত্রায় বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং রাজাকে এ ব্যাপারে মতামত দিতে বলেন। রাজা একটি কমিটি গ্রহণ করে তাদের ওপর মতামতের ভার দিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত কমিটি রাজি হলে ১৪৯২ সালে যাত্রা শুরু করেন কলম্বাস। ক’দিন পরই জাহাজে যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয় এমনকি কম্পাসটাও বিগড়ে যায়। শুধু আকাশের তারার ওপর নির্ভর করে তিনি জাহাজ চালাতে থাকেন। বিশাল আটলান্টিক। কুলকিনারা নেই। দীর্ঘদিন চলেও কোনো ভূমির দেখা না পেয়ে বিদ্রোহ শুরু করে নাবিকরা। নাবিকদের থামাতে না পেরে শেষে তিনি লোভ দেখান যে, পশ্চিম দিকে প্রথম ভূখ- দেখতে পাবে তাকে বিরাট অংকের পুরস্কার দেওয়া হবে। পরে যে দেখতে পেয়েছিল তার দাবি উপেক্ষা করে ধূর্ত কলম্বাস ঘোষণা দেন তিনি নিজেই প্রথম দেখেছেন এবং পুরস্কারের প্রাপ্য অর্থ থেকে তাকে বঞ্চিত করেন। তিনি যেখানে নামলেন তা ছিল সানসালভেডর। তবে তার ধারণা ছিল তিনি ভারতে পৌঁছে গেছেন তাই এলাকাটির নাম দেন পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ অর্থাৎ ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৪৯২ থেকে ১৫০৪ সালের মাঝে চারবার গিয়েছিলেন সেখানে। ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের উত্তর উপকূলে ইসাবেলা নামে উপনিবেশ গড়ে নিজেকে তার শাসক ঘোষণা করে দিনের পর দিন নিরপরাধ লোকদের ফাঁসি দিয়ে প্রকাশ্য স্থানে ঝুলিয়ে রাখতেন তিনি স্থানীয়দের ভয় দেখাতে। হেঁটে হেঁটে মিউজিয়ামের অন্য দ্রষ্টব্য দেখার জন্য সরে যাওয়ার আগে আরেকবার ভালো করে তাকালাম চিত্রটির দিকে। মনে হলো ছবির ভেতর থেকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছেন কলম্বাস আমার দিকে।

হাফিজ উদ্দীন আহমদ : সাহিত্যিক ও চিকিৎসক
[email protected]

 
Electronic Paper