মুহম্মদ দবিরুল ইসলাম কিংবদন্তি ছাত্রনেতা
অজয় কুমার রায়
🕐 ১২:১৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৪, ২০২১
গত ১৩ জানুয়ারি ছিল বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিক ও ভাষাসৈনিক মুহম্মদ দবিরুল ইসলামের ৬০তম মৃত্যুবার্ষিকী। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) গঠনে যে কয়েকজন তেজোদীপ্ত তরুণ ছাত্রনেতা বিশেষ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। রাজনৈতিক জীবনে সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আজিজ আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আব্দুল হামিদ চৌধুরী, নঈমউদ্দিন, মোল্লা জালালউদ্দিন, আবদুল রহমান চৌধুরী, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, লুলু বিলকিস, নুরুল হুদা, কাদের বক্স, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ক্লাসের সহপাঠী।
মুহম্মদ দবিরুল ইসলাম ১৯২২ সালের ১৩ মার্চ ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বামুনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৌলানা তমিজউদ্দিন আহমেদ, মাতা দখতর খানম। পিতা মৌলানা তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিক, সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী এবং এমএলএ। মাতামহের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের প্রখ্যাত জামালপুর জমিদারবাড়ি। তিনি লাহিড়ী এমই স্কুল থেকে বিভাগীয় বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন। ঠাকুরগাঁও হাইস্কুল থেকে ১৯৩৮ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে রাজশাহী বিভাগীয় ‘মায়াদেবী উন্মুক্ত রচনা প্রতিযোগিতা’য় স্বর্ণপদক লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে চতুর্থ স্থান অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী ও অন্যান্য আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়েন।
১৯৪৭ সালে তিনি বিএ পাস করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্রে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়ার সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে ধর্মঘট পালন এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাকে জেলে যেতে হয়। তাকে জেলের ভেতর ভীষণভাবে মারধর করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন। ফলে পাক সরকারের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ান। বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি ও কর্মচারীদের ধর্মঘটের সঙ্গে একাত্মতা হয়ে কাজ করায় তাকেসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন ছাত্রকে আজীবনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে এবং ১৯৫৫ সালে কারাবাস থেকে এলএলবি পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।
১৯৪৭ সালের ৬-৭ সেপ্টেম্বরের ঢাকায় গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী সম্মেলনে বৃহত্তম দিনাজপুর থেকে ছাত্রনেতা দবিরুল ইসলামের নেতৃত্বে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল ও আব্দুর রহমান যোগদান করেন। ১৯৪৮ সালে নঈমুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিতে দিনাজপুর জেলা থেকে দবিরুল ইসলাম, ফরিদপুর জেলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, কুমিল্লা থেকে অলি আহাদসহ বিভিন্ন জেলার ১৩ জন সদস্য নির্বাচিত হন। ছাত্রদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে উৎসাহিত করে। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে দিনাজপুরের নূরুল হুদা, কাদের বক্স, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল, দবিরুল ইসলাম প্রমুখ নেতৃত্ব দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন- ‘১৯৪৯ সালে জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে দিনাজপুরে ছাত্রদের গ্রেফতার করা হয়েছে। জেলের ভেতরে দবিরুল ইসলামকে প্রচ- মারধর করেছিল। যার ফলে জীবনের তরে তার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়েছিল’।
১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন এবং দবিরুল ইসলাম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি জেলে ছিলেন। ছাত্রদের কাছে এত জনপ্রিয় ছিলেন যা জেলে থাকার পরও কেউ কোনো দ্বিমত করেনি এবং ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে দবিরুল ইসলাম যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভায় তিনি প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি (শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রম) নিযুক্ত হন। সে সময়ে তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে সুগার মিল স্থাপনের জন্য জোরাল উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিরল প্রতিভার অধিকারী মুহম্মদ দবিরুল ইসলাম ১৯৪৯ ও ১৯৫৪ সালের কারা অভ্যন্তরে অকথ্য নির্যাতন ভোগ করায় হৃদরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হন। তিনি ১৯৬১ সালের ১৩ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
অজয় কুমার রায় : কবি ও গবেষক
[email protected]