ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

করোনাকালীন উত্তরবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থা

এনাম রাজু
🕐 ১:২৪ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১২, ২০২১

করোনাকালীন উত্তরবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থা

পৃথিবীতে অনেক কিছু আছে যা মানুষের চিন্তার বাইরে। তাই হয়তো করোনা নামক মহামারী পৃথিবীকে জানান দিয়ে যাচ্ছে। এই ভাইরাসের কারণে মানুষ একদিকে গৃহবন্দি থাকতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে পৃথিবীজুড়ে অনেক অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হয়েছে। যদিও তা নিরুপায় হয়ে। কিন্তু এসবের ফলও গুরুত্বপূর্ণ। যা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ না এলে হতো না হয়তো। এই যেমন শিক্ষাব্যবস্থা তার মধ্যে অন্যতম। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে ১৬ মার্চ থেকে বন্ধ হয় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখনো বন্ধই আছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হঠাৎ বন্ধ হওয়া এবং শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সচল রাখতে সরকার অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। এই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম একদিকে শিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের গৃহবন্দি জীবনের একঘেয়েমি দূর করতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। মহামারীর প্রাদুর্ভাবে যখন স্বাভাবিক জীবনযাত্রা স্থবির তখন ঘরে বসেই শিক্ষাগ্রহণ নিঃসন্দেহে একটি অভাবনীয় সাফল্য। তাছাড়া বাংলাদেশে কখনো অনলাইনে ক্লাস হতে পারে এমনটা চিন্তা করাও দুঃসাধ্য ছিল এতকাল। গত কয়েকটি মাসের শিক্ষা কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে সকলেই একমত পোষণ করবেন বিশ্বাস করি। কেননা অনলাইনে ক্লাসের ব্যবস্থা না নেওয়া হলে কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় মনোযোগ ধরে রাখা যেত না। এর ফলে দেশে অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থীর লেখাপড়ায় অমনোযোগী হতে অভ্যস্ত হতো। যা পরবর্তীকালে শিক্ষাব্যবস্থায় কঠিন আঘাত হানত।

গ্রাম্য একটি প্রবাদ আছে- ‘শিখেছ কোথায়? ঠকেছি যেথায়!’ মহামারীকালীন বাংলাদেশের অনলাইনও অনেকটা তাই। বাধ্য হয়ে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সুফল নতুন দিক উন্মোচন করেছে। ফলে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশও অনেকটা এগোচ্ছে উন্নত দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই। বাধ্য হয়েই কিনতে হয়েছে অনেককে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপসহ অনেক ইলেকট্রনিক সামগ্রী। কিন্তু অনলাইন ক্লাসে যোগদানের ক্ষেত্রে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতাও লক্ষ্য করা যায়। একদিকে ব্যয়বহুল ও অন্যদিকে ধীরগতির ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, প্রযুক্তিগত অদক্ষতা ইত্যাদি। এর পরে তো আছে পারিবারিক ও মানসিক অস্বস্তি এবং সময় মেইনটেন করার ব্যাপারে উদাসীনতা। এসব সমস্যাকে উতরে অনেকেই আবার ক্লাসে উপস্থিত থাকতে অনাগ্রহী।

অনলাইনে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ও সমস্যা সম্পর্কে উপর্যুক্ত আলোচনায় যা ফুটে উঠেছে তার আড়ালে রয়েছে আরেক চিত্র। আরেক সংকট। এই সংকট মূলত করোনার কারণে সৃষ্ট হলেও করোনা তাতে খুব স্পর্শ করতে পারেনি। বলছি উত্তরবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থার কথা। করোনাকালীন প্রযুক্তির বদৌলতে শিক্ষার যতটুকু আলো ছড়িয়েছে তা যেন অধরাই থেকে গেল উত্তরবঙ্গের শিক্ষার্থীদের কাছে। তারা জানে, অনলাইনে ক্লাস হয়। সেই ক্লাসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎ ঘটে। কিন্তু তারা সেই শিক্ষার আলো থেকে অনেক পিছিয়ে। বসবাস করছে যেন কোনো আদিম সমাজে! যে সমাজে রূপকথার মতো লাগে অনলাইন ক্লাস ও তার গল্প। গুটি কয়েক শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাই অন্য বন্ধুর কাছ থেকে গল্প শুনে হা-হুতাশ করে। কেউ কেউ অন্য বন্ধুর কাছে ক্লাসের অভিজ্ঞতার কথা শুনে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে থাকে। হয়তো কেউ কেউ আলাদিনের চেরাগের স্বপ্নে বিভোরও হয়। কিন্তু কোথায় সে চেরাগ, যে চেরাগ ঘষলেই হাতে আসবে অন্তত একটা স্মার্ট ফোন। সেই স্মার্ট ফোনেই যে তাদের কাছে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জাদুর ব্যাংক।

করোনার কারণে উত্তরবঙ্গে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। ‘যে অঞ্চলের মানুষের পেটে ক্ষুধা তাদের আবার কীসের করোনা! করোনা তো বড় লোকের অসুখ, যাদের মেলা ট্যাকা পয়সা’- এসব কুড়িগ্রাম অঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষের কথা। কথা কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে বিশ্লেষণ না করে বরং মেনে নিয়েই এগুতে চাই। করোনার কারণে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই উত্তরবঙ্গে তাই হবে।

কিন্তু যে অঞ্চলের মানুষ আজ অবধি মাস্ক ব্যবহার শুরু করেনি কিবা কেউ কেউ মাস্ক ব্যবহার প্রয়োজনীয় শেষ হয়েছে জানে তাদের কাছে করোনার গল্প বলাটাও লজ্জার। এই অঞ্চলের মানুষ করোনাকে উপেক্ষা করেই কাজের জন্য ঘুম থেকে জেগেই মাঠে যায়। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই গ্রামের ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে আঙুলের ডগায় থু থু মিশিয়ে টাকার হিসাব কষে। সেই টাকা ভাগ বাটোয়ারা করে প্রয়োজনীয় চাল ডাল কিনে বাসা ফেরে। ঘরে বসে থাকার সুযোগ কোথায়? দিন এনে দিন খায় যাদের অবস্থা তারা কীভাবে সন্তানের খবর রাখবে। তাছাড়া অনেক অভিভাবক নিজেও জানে না তার সন্তান কোন ক্লাসে পড়ে।

অনেকেই জানে না, তার সন্তান খুব মেধাবী কিংবা মেধাবী নয়। শুধু জানে তার ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। পড়ালেখা করে। কোনো রকম নাম লিখতে পারলেই কেল্লাফতে। এমন অভিভাবকের ঘরে জন্ম নেওয়া মেধাবী ছাত্ররা একটা সময় তার মেধার সাক্ষর রাখে। আর তার ওপর ভর করে পরবর্তী প্রজন্ম আলোর পথে হাঁটে। এভাবেই উত্তরবঙ্গের গুটি কয়েক ঘর শিক্ষিত হয় বছরে বছরে। কিন্তু করোনাকালীন এই সংকটে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে অনেক শিক্ষার্থী বাবা-মায়ের সঙ্গে মাঠে কাজ করতে যাচ্ছে। কারণ এই অভাবের সময়ে সন্তানদের কাজে লাগিয়ে কিছু বাড়তি উপার্জন, এটা কম কীসে!

বাড়তি উপার্জন করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ প্রযুক্তিগত সুবিধা নেওয়ার মতো বাস্তবতা অধিকাংশ পরিবারে নেই। তাছাড়া উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা বিশেষ করে কুড়িগ্রামে অস্বচ্ছল পরিবারের সংখ্যাই বেশি। তাতে আবার স্মার্টফোন কেনার মতো স্মার্ট অভিভাবকেরও বড্ড অভাব। এর পরে তো আছে আর্থিক দৈন্য। বলা চলে করোনার চেয়েও বড় ক্ষতি করেছে সরকারি নির্দেশ। যদি সরকারি সকল নির্দেশ না মেনেও সবাই একত্রে ও সামাজিক দূরত্ব না মেনেই কাজ করে ও মেলামেশা করে। তাহলে তো শিক্ষা ব্যবস্থাও চলতে পারত অন্তত কুড়িগ্রামে। কিন্তু এমন চিন্তা করাটা আত্মঘাতী হতেও পারত। তাই হয়তো সরকারি নির্দেশনাকে অমান্য করার সুযোগ নেই। কিন্তু অভাবের কারণে যে প্রযুক্তিগত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা তা নিরসনে সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এরপরে আবার যেসব শিক্ষার্থী স্কুল বন্ধ থাকার কারণে অর্থ উপার্জনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তাদের লেখাপড়ায় ফেরানো খুব কঠিন হবে।

বলা যায় এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্ধেক শিক্ষার্থী আর পড়ালেখায় ফিরতে পারবে না। আর যারা ফিরবে তারাও কতটুকু অনলাইনে ক্লাস করা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে এগিয়ে নিতে পারবে নিজেকে? তাও একবার ভেবে দেখা দরকার। তাহলে কি বলা যায়- করোনার পরবর্তী সময়ে আবারও উত্তরবঙ্গ পিছিয়ে পড়বে? নাকি শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে জ্বালো স্লোগান নিয়ে ফের কুড়িগ্রামে ক্যাম্পেইন করতে হতে পারে।

শুধু উত্তরবঙ্গই নয়। এরকম আরও অনেক জেলা আছে। যে জেলার কোনো কোনো গ্রামের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার জন্য মাইলের পর মাইল পাড়ি দিতে হয়। যেতে হয় শিক্ষার আলো জ্বালাতে মন ও মগজে। সে অঞ্চলেও নিশ্চয়ই দরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীটিরও একই অবস্থা। তাহলে কি করোনা শুধু জীবন কেড়ে নিয়েছে এমনটা নয়...? সেই সঙ্গে দরিদ্র মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের আজীবন অভিশাপ হয়ে থাকবে! তাছাড়া করোনা নিয়ে এখনো কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সময় আসেনি।

কারও জানা নেই এই করোনার সংকট কতটা বছর বহন করতে হবে বিশ্ববাসীকে। যদি আরও কয়েক বছর এমন সময় কাটে তাহলে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা সকল শিক্ষার্থীর জন্য করে দেওয়া হোক। যদি তা করতে ব্যর্থ হয় পরিবার ও রাষ্ট্র, তাহলে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে একটা বড় ধরনের ব্যবধান সৃষ্টি হবে। শহুরের শিক্ষার্থী ও মোটামুটি ধরনের সচেতন অভিভাবকের সন্তানরা এগিয়ে গেলেও দরিদ্র ও অসচেতন পিতা-মাতার ঘরে জন্ম নেওয়া মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা পিছিয়ে পড়বে। ফলে একটা সময় গোটা দেশ একটা ভারসাম্যহীন হওয়ার আশঙ্কাও ভুল হবে না।

এনাম রাজু: কবি ও গল্পকার

[email protected]

 
Electronic Paper