বাড়ছে মানসিক সমস্যা
প্রদীপ সাহা
🕐 ১:০২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১২, ২০২১
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত একটি মাধ্যম। জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, স্ন্যাপচ্যাট, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের সবাই এসব মাধ্যমের সঙ্গে যেভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে, তা সত্যিই চিন্তার বিষয়। বিশেষ করে শিশু কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে ভীষণভাবে। তাদের এভাবে জড়িয়ে পড়াটা নিঃসন্দেহে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাই চিন্তিত, উদ্বিগ্ন। অনেক প্রচেষ্টার পরও অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কাছ থেকে এসব অভ্যাস ছাড়াতে পারছেন না। ফলে সন্তানরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারিবারিক এবং সামাজিক বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে।
শিশু-কিশোরদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের কুফল নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন বেশ কিছু চিকিৎসক ও শিশু কল্যাণ বিশেষজ্ঞ। ব্রিটেনের একজন চিকিৎসক রঙ্গন চ্যাটার্জি জানিয়েছেন, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মানসিক সমস্যা এবং তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের মধ্যে যে একটা সম্পর্ক আছে তার অনেক প্রমাণ তিনি পেয়েছেন।
একদল মার্কিন শিশু কল্যাণ বিশেষজ্ঞ ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গের কাছে একটি চিঠি লেখেন। এতে তারা ‘মেসেঞ্জার কিডস’ নামে বাচ্চাদের মেসেজিং অ্যাপটি বন্ধ করে দেওয়ার আহ্বান জানান। তারা বলেন, ‘১৩ বছরের কম বয়সীদের এই প্লাটফর্মটি ব্যবহার করতে উৎসাহিত করাটা দায়িত্বজ্ঞানহীন।’
তারা তথ্যপ্রমাণ পেয়েছেন, সামাজিক মাধ্যমের কারণে কিশোর-কিশোরীদের মানসিকতায় অস্বাভাবিক সব পরিবর্তন হচ্ছে। একজন ১০ বছরের মেয়েও তার দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগছে।
২০১৭ সালে ‘রয়াল সোসাইটি অব পাবলিক হেলথ’ ১১ থেকে ১৫ বছর বয়স্ক দেড় হাজার কিশোর-কিশোরীর ওপর একটি জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, স্ন্যাপচ্যাট এবং ইনস্টাগ্রাম তাদের মনে সবচেয়ে বেশি হীনম্মন্যতা এবং দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে। ১০ জনের মধ্যে ৭ জন বলেছে, ইনস্টাগ্রামের কারণে তাদের নিজেদের দেহ নিয়ে মন খারাপ হয়েছে। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সের তরুণ-তরুণীদের অর্ধেকই বলেছে, ফেসবুকের কারণে তাদের মানসিক দুশ্চিন্তা ও অশান্তি বেড়ে গেছে। দুই-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা বলেছে, ফেসবুকের কারণে সাইবার বুলিং বা অনলাইনে অপমান-হয়রানি করার প্রবণতা আরও গুরুতর আকার নিয়েছে।
ব্রিটেনের চিকিৎসক রঙ্গন চ্যাটার্জি একবার ১৬ বছরের একটি কিশোরকে রোগী হিসেবে পেয়েছিলেন, যে তার নিজের হাত-পা কাটার পর তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পাঠানো হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তাকে বিষন্নতারোধী ওষুধ দেব। কিন্তু আমি তার সঙ্গে কথা বলার পর মনে হলো, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করায় তার স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’
ড. চ্যাটার্জি তার কাছে আসা ছেলেটিকে একটা সহজ সমাধান দিয়েছিলেন- তাকে সামাজিকমাধ্যম ব্যবহার করা কমিয়ে আনতে হবে অর্থাৎ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এক ঘণ্টার বেশি নয়। তবে কয়েক সপ্তাহ পর এ সময় বাড়ানো যেতে পারে। ছয় মাস পর তার অবস্থা লক্ষণীয়ভাবে ভালো হতে শুরু করল।
ড. চ্যাটার্জি ছেলেটির মায়ের কাছ থেকে চিঠি পেলেন, সে স্কুলে গিয়ে অনেক আনন্দ পাচ্ছে এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গেও মিশছে। তিনি বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এটি একটি বড় সমস্যা এবং এ ক্ষেত্রে কিছু নিয়মকানুন করা অবশ্যই প্রয়োজন।’
ব্রিটেনের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লুই থিওডোসিও জানান, দু-তিন বছর আগেও তার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টের মাঝখানে কোনো শিশু তাদের ফোন ব্যবহার করছে বা টেক্সট করছে এমন ঘটনা ছিল খুবই অস্বাভাবিক। কিন্তু এখন এটা খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। শিশুরা তাদের ফোন নিয়ে খুব বেশি সময় কাটাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে টিনএজাররা বিষন্নতা, দুশ্চিন্তা বা অন্য মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। আর এমন কেসের সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। এসব শিশু-কিশোররা এক কল্পনার জগতে বাস করছে, এতে তাদের শারীরিক স্বাস্থ্য খারাপ হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘অভিভাবকদের জন্য পরিস্থিতি খুব কঠিন হয়ে গেছে। তিনি এমন অভিভাবকের কথাও শুনেছেন যারা ওয়াইফাই রাউটার নিজেদের সঙ্গে নিয়ে ঘুমান, যাতে সন্তানরা মাঝরাতে উঠে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারে।
যুক্তরাজ্যের ১৫ হাজার মানুষের ওপর এক সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের কারণে তাদের যৌনজীবনে ছন্দপতন ঘটছে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ক্যাথ মার্সার বলেন, ‘বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে সাধারণ মানুষ এমনিতেই মানসিক চাপে থাকেন। চাকরি, রোজগার এসব নিয়ে চিন্তার শেষ নেই।’
সমীক্ষাটি সামনে রেখে মার্সারের মন্তব্য, ‘আধুনিক প্রযুক্তিকে আমরা টেনে বেডরুম বা বিছানায় আনছি। ল্যাপটপ, ট্যাবলেট খুললেই ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের জগৎ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দিনদিন এসবের কাছে আত্মসমর্পণ করছি। মানসিক চাপ কাটাতে যৌনসঙ্গীর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব আসক্তির ফলে দেখা যাচ্ছে, ১৬ থেকে ৪৪ বছরের যুগলরা অনলাইন পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। এটি বেডরুমে প্রযুক্তির অবাধ প্রবেশের ফল।’
সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি হলো, বর্তমান জীবনধারায় কেউ এখন একা নন। কারণ সঙ্গী হিসেবে আছে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব! সমীক্ষায় দেখা গেছে, অনেকেই একা থাকতে পছন্দ করেন। তার মানে এ নয়, যৌনতার প্রতি তাদের কোনো আকর্ষণ নেই। কেননা, তাদের অনেকেই ইন্টারনেটের মধ্যে যৌনতার স্বাদ নেয়। কিন্তু যৌনসঙ্গীতে তীব্র আপত্তি। এর ফলে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগও কমছে। কমছে সংসার পাতার প্রবণতাও। সমীক্ষাটি ব্রিটেনের হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্যান্য উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে ফলাফল খুব বেশি হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা কম। উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল কম-বেশি একই হবে।
বিশেষজ্ঞরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপারে তাই অভিভাবকদের নানা উপায়ে তাদের সন্তানদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর নজর রাখতে এবং তা সীমিত করতে পরামর্শ দিচ্ছেন। ফেসবুক, টুইটার, অ্যাপল এবং স্ন্যাপচ্যাটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও এসব অভিযোগ নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, তারা এ ব্যাপারে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিশেষজ্ঞমহল মনে করছেন, দ্রুত এসব ব্যাপারে কার্যকরী উদ্যোগ ও পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ এবং ভয়ঙ্কর।
প্রদীপ সাহা: কবি ও কলাম লেখক