ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

‘সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব’

আসিফ নজরুল
🕐 ৯:৫৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৮

আসিফ নজরুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কলামিস্ট, ঔপন্যাসিক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে সুপরিচিত। আন্তর্জাতিক নদী আইনে পিএইচডি করেছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও নানা প্রসঙ্গ নিয়ে খোলা কাগজের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সীমান্ত বাঁধন চৌধুরী


খোলা কাগজ : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হলে গ্রহণযোগ্য হবে?
আসিফ নজরুল : গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সারা পৃথিবীতে একটি সংজ্ঞাই আছে। মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দেবে ও চাইবে। সেই ব্যক্তি নির্বাচিত হবে মানুষ যাকে চায়। এটিই সত্যিকারের বিষয় এবং সারা পৃথিবীতে একই ডেফিনেশন।
তার জন্য কতগুলো প্রি-কন্ডিশন আছে। প্রথমত, প্রার্থীদের এবং তাদের কর্মী বাহিনীকে নির্বিঘ্নে প্রচারণা চালাতে দিতে হবে। সমান সুযোগ দিতে হবে পাবলিক স্পেসে। সেটা গণমাধ্যম হতে পারে, জনসভা হতে পারে, রাস্তার মিছিল হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ভোটার যেন নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে, ভোট যেন কাউন্টেড হয়, কোনো প্রকার কারচুপি যেন না হয়। সর্বশেষ ওই ভিত্তিতে যেন রেজাল্ট হয়। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই তা সম্ভব।

অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কী করে সম্ভব?
পৃথিবীতে ডেমোক্রেসি এমন একটা স্টেজে চলে গেছে, সেটা ইউরোপিয়ান কান্ট্রি বলেন আর আমেরিকান কান্ট্রি বলেন, সেখানে একটা রোলিং গভর্নমেন্ট ইলেকশনে কারচুপি করবে এটা চিন্তাই করা যায় না। যেহেতু এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি, সে জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ এবং জামায়াত মিলে বাংলাদেশে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছিল। বিএনপি সে আন্দোলন মেনে নিয়ে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। মোটামুটি গ্রহণযোগ্য মডেল ছিল, ইলেকশন যেই সরকার পরিচালনা করবে তার যেন ওই ইলেকশনে কোনো স্টেক না থাকে। এটাই ছিল গ্রহণযোগ্য মডেল। আনফরচুনেটলি অত্যন্ত বিতর্কিতভাবে এটাকে বাতিল করা হয়। বাংলাদেশে এখনো সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব, এমনকি শেখ হাসিনার আন্ডারে কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট থাকার পরও।
নাম্বার ওয়ান কন্ডিশন হচ্ছে ইলেকশন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে এবং নির্বাচনী আচরণবিধি কঠিনভাবে প্রয়োগ করতে হবে। সবচেয়ে ভালো কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট করতে পারলে। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে এর চেয়ে শ্রেয়তর কোনো বিকল্প নেই।
তবে এখনকার বাস্তবতায় যা করা যায়, নির্বাচনকালীন যে সরকার থাকবে সে সরকারে বাংলাদেশের সংবিধানে রয়েছে, তারা মন্ত্রিসভা থেকে ওয়ান টেনথ বাইরে থেকে লোক নিতে পারে।
সরকারপক্ষ যে বলে, সংসদ নির্বাচনে যারা আসে নাই তাদের নির্বাচনকালীন সরকারে রাখা যাবে না, এটা একটা অবাস্তব কথা।
সরকার যদি ২০ সদস্যবিশিষ্ট একটা সরকার হয় সেখানে দুজনকে বাইরে থেকে নেওয়া যেতে পারে। যেমন স্বরাষ্ট্র আর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এই দুটি যদি বিএনপি থেকে না দিতে চান তাও উপায় আছে। লাস্ট কেয়ারটেকারে যারা ইলেকশন করেছে, যাদের অধীনে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে তেমনি হোসেন জিল্লুরের মতো দুটি লোক রাখতে পারেন; এটা হচ্ছে এক নাম্বার। নাম্বার টু হচ্ছে, ইলেকশন কমিশনকে সরকারের পক্ষ থেকে কনফিডেন্স দিতে হবে এই বলে, তুমি যদি সেনাবাহিনী নিয়োগ করতে চাও এটা সম্পূর্ণ তোমার ব্যাপার।
নির্বাচন কমিশনের তখন উচিত অবশ্যই নির্বাচন চলাকালে অন্তত সাত দিন আগে থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা। সেনাবাহিনী মোতায়েন হলে সরকারের মাথাব্যথার কোনো কারণ নেই। বিদেশে সেনাবাহিনী এত বড় বড় সুষ্ঠু নির্বাচন রক্ষার কাজ করে, আমাদের নির্বাচনে সেনাবাহিনী রাখতে প্রবলেমটা কি! সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্যতম প্রি-কন্ডিশন হচ্ছে অবশ্যই ভোটের আগে থেকে রেজাল্ট ঘোষণা পর্যন্ত সেনাবাহিনী থাকতে হবে। তৃতীয়ত, পোলিং এজেন্টদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। পোলিং এজেন্টদের মামলা দেখিয়ে গ্রেপ্তার করতে পারবেন না। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অবাধে এখানে আসতে দিতে হবে। ইভিএম চালাকি চলবে না। নির্বাচন চলাকালে প্রচারমাধ্যমে নির্দিষ্ট স্লটের সময় সবাইকে সমান ভাগ দিতে হবে। যদি সত্যিই অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চান তাহলে অবশ্যই খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে।

জাতীয় ঐক্য রাজনীতিতে কতটুকু প্রভাব ফেলবে?
দুটি জিনিস হতে পারে। একটি হচ্ছে, ইলেকশন অ্যালায়েন্স। যেমন- ড. কামাল  হোসেন, বি চৌধুরী, আ স ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না এদের সঙ্গে বিএনপির যদি ঐক্য হয় সেটা একটা ইলেকশন অ্যালায়েন্স হিসেবে কাজ করবে। একটা ইমিডিয়েট ইমপ্যাক্ট হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের বাংলাদেশের লোকজন পুনরায় নির্বাচিত করে না।
এরা হলো দুবার ইলেক্টেড। তাও একটা ইলেকশন নিয়া জনগণের মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ রয়েছে। আমি মনে করি আওয়ামী লীগ হারবে তো হারবে এমনকি তাদের ভরাডুবিও হতে পারে। তবুও বড় চ্যালেঞ্জ সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করা। তা সম্ভব করার ক্ষেত্রে ঐক্য হলে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় মহলে অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে।

ইভিএমের বিরোধিতা কেন?
ইভিএম পদ্ধতিতে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নেই। জার্মানির সাংবিধানিক আদালত ইভিএম বাতিল করে দিয়েছেন এবং বলেছেন এটিতে কোনো স্বচ্ছতা নেই। কেউ যদি কারচুপি করে, মেশিনের আড়ালের মানুষগুলো যদি শয়তান এবং দুষ্টু প্রকৃতির হয়, তারা এটা দিয়ে দিনকে রাত করে দিতে পারবে।
আর ইভিএমের মেশিনের অন্তরালের মানুষগুলো যদি সৎ হয়, নিরপেক্ষ হয় তাহলে ইভিএম ভালো। বাংলাদেশে যারা ইভিএমের পক্ষে কথা বলে, আমি মনে করি তারা অত্যন্ত বড় ধরনের নির্বোধ। তারা বাংলাদেশের বাস্তবতা বোঝে না, বাংলাদেশকে চেনে না। তারা হয় নির্বোধ অথবা কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে। ইভিএমের মেশিন কেনার বিষয়েও বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে।

বিএনপি নিরপেক্ষ সরকার চায়। সরকার বলছে সম্ভব না, সংবিধানে নেই। সংকট উত্তরণের উপায় কী?
আইনে সম্ভব না, এরকম জিনিস তো আওয়ামী লীগ বহুবার চেয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি আইনে ছিল? মূল কথা হচ্ছে, জনকল্যাণ কোনটা। যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন আওয়ামী লীগ চায় তাহলে তত্ত্বাবধায়ক ছাড়াও সম্ভব। যদি ২০-২২ সদস্যবিশিষ্ট একটা সরকার হয় সেখানে দুজনকে বিএনপি থেকে স্বরাষ্ট্র আর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে দেওয়া যেতে পারে।

মানুষ এমন কোনো পরিবর্তন চাচ্ছে?
কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট চান কি না প্রশ্নে এই মুহূর্তে গণভোট করলে ৮০ ভাগ লোক ভোট দেবে, হ্যাঁ, কেয়ারটেকার সরকার চাই। বেশিও হতে পারে।

কখনো নির্বাচন করার ইচ্ছে আছে?
প্রশ্নই আসে না। ভবিষ্যতে কোনোদিন কোনো দলের হয়ে কখনো আমার এরকম ইচ্ছে নেই। আমি আন্তর্জাতিক নদী আইনে পিএইচডি করেছি। কোনো গভর্নমেন্ট যদি আমাকে একটি টাকা না দিয়েও সহায়তা চায়, পরামর্শ চায় যে কোনো গভর্নমেন্ট, তা দিতে তৈরি আছি। কোনো গভর্নমেন্ট আমাকে জয়েন্ট রিভার কমিশন বা অন্য কোথাও রাখে নাই।

টকশোতে আগের মতো দেখা যায় না কেন?
এক নম্বর কারণ, আগের মতো ডাকা হয় না। দুই নম্বর হচ্ছে, যখন ডাকাও হয় আমার যেতে ইচ্ছে করে না। কারণ যাওয়ার পর দেখি যে অনুষ্ঠানে হোস্ট যিনি আছেন বা যারা সহ-আলোচক আছেন মানে পরিবেশটা এমন, আমাকে যেন একটা মেসেজ দেওয়া হয় যে আমি যেন একটু বুঝে কথা বলি। ওই ফ্রিডমটা নেই।
কোনো কোনো চ্যানেল তো একেবারে রিকোয়েস্টই করে, একটু বুঝেশুনে যেন বলি। এমনকি যেটা লাইভ না, সেখান থেকে অনেক কিছু বাদও দিয়ে দিয়েছে।
তৃতীয় কারণ হচ্ছে, এক ধরনের একটা অরুচি চলে আসছে। যেমন- আমরা যখন প্রথম টকশো করি, তখন যারা আলোচনা করত তারা অনেকটা যুক্তি দিয়ে কথা বলত। এখন টকশোতে নতুন যারা আসছে তাদের একটা বড় অংশ তারা পার্টিজান! আগের আলোচকদের অন্যরকম কোয়ালিটি ছিল। ন্যাশনাল আলোচনা হতো।

খোলা কাগজ : মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আসিফ নজরুল : আপনাকেও ধন্যবাদ।

 
Electronic Paper