আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়
এস এম মুকুল
🕐 ৯:৪৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৮
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় ২ কোটি নারী-পুরুষ আত্মহননের চেষ্টা করে। এর মধ্যে প্রায় ১০ লাখ নারী-পুরুষ আত্মহননের মাধ্যমে মারা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যারা আত্মহত্যা করেন তাদের তিনজনের মধ্যে একজন মাদকাসক্ত এবং আর ৭৫ শতাংশ মাদকাসক্তই আত্মহত্যাপ্রবণ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এবং জাপানে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। গত ৫০ বছরে সারা পৃথিবীতে, মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার শতকরা ৬০ শতাংশ বেড়েছে।
সারা পৃথিবীর যত মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করে, তার মধ্যে ২.০৬ শতাংশ বাংলাদেশি। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রতি লাখে ১২৮.০৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতিবছর এ সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মহসিন আলী শাহ? বিবৃতিতে বলেন, আত্মহত্যা মানে নিজেকে হত্যা করা ঠিকই কিন্তু পাশাপাশি এর সঙ্গে থাকতে হবে নিজেকে খুন করার প্রগাঢ় ইচ্ছাশক্তি। তিনি বলেছেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবার আগে যা করণীয় তা হলো এর কারণগুলো খুঁজে বের করা। শুধু চিকিৎসক নয়, পাশাপাশি আত্মহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব পরিবার এবং সমাজ থেকেই।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ধনী দেশগুলোয় সাধারণত বেশি বয়সী মানুষ আত্মহত্যা করেন অন্যদিকে দরিদ্র দেশগুলোয় অল্প বয়সের মানুষ আত্মঘাতী হন বেশি। ৭৫ শতাংশেরও বেশি আত্মহননের ঘটনা ঘটে দরিদ্র দেশগুলোতে। বেশিরভাগ দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। আর ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীরা ঝুঁকির মধ্যে থাকেন।
বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী, পৃথিবী থেকে চিরবিদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেও সেটি দ্রুত কার্যকর না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। যদিও আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের পেছনে থাকে চরম মানসিক যন্ত্রণা, হতাশা বা গ্লানি। যা কষ্টের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেলে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়। মনে রাখা দরকার, এ জীবন শুধু নিজেকে নিয়ে নয়। নিজের দুঃখ, কষ্ট, কঠিন সমস্যার গণ্ডির বাইরেও আছে এক বড় পৃথিবী। যেখানে অন্যরাও পুরোপুরি সুখী নয়। নিঃসঙ্গতা, চরম একাকিত্ববোধ থেকেও আত্মহত্যার চিন্তা মনে আসে। নিজেকে নিঃশেষ করার আগে একটু ভেবেচিন্তে চারদিকে তাকান, দেখবেন বেঁচে থাকার মতো অনেক কারণ আছে। আছে অনেক প্রয়োজন।
পৃথিবী থেকে অনেক কিছু উপভোগের আনন্দের উৎস আছে। আবার পৃথিবীকে অনেক কিছুই দেওয়ার আছে আপনার। কেন আপনি শূন্যতায় ঝাঁপ দেবেন। আপনার জীবনের অনেক মূল্য। অবারিত সম্ভাবনা আছে আপনার মাঝেও। মন হালকা করুন, দেখবেন আত্মহত্যার হাতছানিও উধাও হয়ে যাবে। আবেগ নয়, যুক্তি দিয়ে ভাবুন, পৃথিবীতে আপনি একাকী নন। আবার আমরা সবাই একা। সবাইকেই চলে যেতে হয়। জীবন চলার পথে বাধা, ব্যর্থতা, পরাজয় আছেই। তারপরও আছে জয়ের অমিত সম্ভাবনা।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে আত্মহত্যার পরিমাণ বেড়ে গেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে আত্মহত্যার দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যাই বেশি, যাদের বয়স ১৪ থেকে ৩০ বছর। বাংলাদেশ পুলিশ এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যানও প্রায় কাছাকাছি। ২০১০ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ কর্তৃক প্রকাশিত এবং প্রফেসর এ এম এম ফিরোজ ও প্রফেসর এস এম নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যাপ্রবণ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের আত্মহত্যার প্রবণতা মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ। আরও বলা হয়, বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি আত্মহত্যা করেন, যার মধ্যে বিষপানে আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি। বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে দেশে আত্মহত্যা করেন ১০ হাজার ৭৪৯ জন। আর ২০১৭ সালে নভেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ২৫৬ জন। দুই বছরের এ হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৯ জনের বেশি আত্মহত্যা করেছে।
এসব আত্মহত্যা ঘটনার বেশিরভাগই ফাঁসিতে ঝুলে, বিষপান অথবা আগুনে পুড়ে ঘটছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন ও এনজিওর বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজারেরও বেশি নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেন।
আত্মহত্যাকে অনেক ধর্মেই পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানুষ কেন আত্মহত্যা করে তার নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ আছে। বিভিন্ন বিশ্লেষণ দেখে জানা যায়, মানুষ তখনই আত্মহত্যা করে যখন তার জ্ঞান, বুদ্ধি, উপলব্ধি এমনকি অনুধাবন শক্তি পর্যন্ত লোপ পায়। সে তখন নিজেকে অসহায় এবং ভরসাহীন মনে করে। বিশ্বে বর্তমানে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি হলো আত্মহত্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক চাপ, হতাশা, অবসাদ ও হেনস্তার শিকার হয়ে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। আবার আর্থসামাজিক সমস্যা ও পারিবারিক সংকটের কারণেও অনেকে আত্মহত্যা করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রিভেনটিং সুইসাইড এ বলা হয়েছে, প্রতিবছর বিশ্বে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। সারা বিশ্বে প্রতি ২ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে এবং প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন সফলভাবে আত্মহত্যা করেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে এ সংখ্যা প্রতি ২০ সেকেন্ডে একজনে পৌঁছবে।
আমরা মনে করি, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে আত্মহত্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে এমন মানুষকে যদি চিহ্নিত করা যায় তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কথা বলার সুযোগ পেলে সেই পথ থেকে তার ফিরে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে।
এস এম মুকুল : কলামিস্ট
[email protected]