ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বৈচিত্র্যময় রঙের ঋতু হেমন্ত

এহসান বিন মুজাহির
🕐 ৯:১৩ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৫, ২০২০

প্রত্যেক ঋতুর আগমনে বাংলাদেশের প্রকৃতি নবনব সাজে সজ্জিত হয়। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত— এ ছয় ঋতুতে প্রকৃতি সাজে ছয় রকম। হেমন্তের কুহেলী গুঞ্জন, শীতের শীর্ণ নদী ও কুয়াশার নেকাব আর বসন্তের দখিনা মৃদুমন্দ বাতাস, গ্রীষ্মের দুঃসহ দহন, বর্ষার মুষলধারে বৃষ্টি, শরতের কাশফুল ষড়ঋতুরই অবদান। শরতের শেষ প্রহর থেকেই বাতাসে মৃদু গুঞ্জন তোলে হেমন্তের রৌদ্রাঙ্কিত মোহনীয় নিবিড় তরঙ্গ। ঋতুচক্রের নিয়মে শরৎ বিদায় নিয়ে প্রকৃতিতে এসেছে হেমন্ত। বিস্তীর্ণ সবুজ আমন ধানের শিষে দানা বাঁধছে শিশিরবিন্দু। সবুজ-শ্যামল জমিনে এখন শোভা পাচ্ছে সোনালি বর্ণের উজ্জ্বলতর হেমন্তের আলোকরেখা। ধান ও ঘাসের ডগায় আলগোছে পা ফেলে নামছে কুয়াশা। শিশিরবিন্দু ঝরার টুপটাপ শব্দ আর মৃদু শীতলতা জানান দিচ্ছে ঋতু পরিবর্তনের খবর। এভাবেই প্রকৃতিতে হেমন্তের গহন উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়, হয় অনুভূত। রৌদ্রোজ্জ্বল আভার প্রকৃতি মানেই হেমন্ত। হেমন্তকে বলা হয় বিচিত্র রঙের ঋতু। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল। শিশিরস্নাত সকাল, কাঁচাসোনা রোদমাখা স্নিগ্ধ সৌম্য দুপুর, পাখির কলকাকলী ভরা ভেজা সন্ধ্যা আর মেঘমুক্ত আকাশে জোছনা ডোবানো আলোকিত রাত হেমন্তকালকে যেন আরও রহস্যময় করে তোলে সবার চোখে; প্রকৃতিতে এনে দেয় ভিন্নমাত্রা।

 

শরৎ প্রকৃতিতে যে সৌন্দর্যের সূচনা করে হেমন্ত সে সৌন্দর্যের পূর্ণতা দান করে। হেমন্তের এ মৌনতাকে ছাপিয়ে বাংলার মানুষের জীবনে নবান্ন প্রবেশ করে জাগরণের গান হয়ে, মানুষের জীবনে এনে দেয় সর্বজনীন উৎসবের ছোঁয়া। হেমন্তকে বলা হয় বিচিত্র রঙের ঋতু। হেমন্তের শিশিরঝরা নিশিতে ফোটে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি আর কামিনী। হেমন্তেই দিঘির জলে, বিলে, ঝিলে ফোটে কত না রঙের পদ্ম। হেমন্তের চরিত্র আর তার বাইরের রূপ নিয়ে জগৎজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে শত শত গল্প, শিল্প, গান ও কবিতা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসীম উদদীন, জীবনানন্দ দাশ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে কবি আল মাহমুদসহ পরবর্তীকালের অনেক কবিই লিখেছেন এই হেমন্ত নিয়ে।

অসাধারণ সৌন্দর্যচেতনায় ভাবুক হৃদয়ের বিলাসিতায় এ ঋতুকে নিজের প্রিয়তমারূপে কল্পনা করেছিলেন বিখ্যাত ইংরেজ কবি জর্জ এলিয়ট। বলেছিলেন, ‘হে অপরূপা সুন্দরী ঋতু হেমন্ত/ তোমার সঙ্গে আমার অন্তরাত্মা এখন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ/ যদি ডানাওয়ালা পাখির মতো পৃথিবীজুড়ে উড়ে বেড়াতে পারতাম/ তোমার মনোলোভা রূপের এ সৌন্দর্যের বিস্তারে, তাহলে উপভোগ করতাম সর্বত্র’। ‘অঘ্রানের সওগাত’ কবিতায় হেমন্তের আগমনী, এর প্রকৃতি ও স্বভাবের এক চঞ্চলরূপ এঁকেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। হেমন্ত নিয়ে কবি লেখেন— ‘চাঁদের প্রদীপ জ্বালাইয়া নিশি জাগিছে একা নিশিথ/ নতুনের পথ চেয়ে চেয়ে হলো হরিত পাতারা পীত’। ষড়ঋতুর নানা পর্যায়ে কবি নজরুল হেমন্তকে দেখেন ধরণির ওপর স্রষ্টার গোপন আবির্ভাব হিসেবে— ‘হেথা খেতভরা ধান নিয়ে আসে অঘ্রান/ হেথা প্রাণে ফোটে ফুল, হেথা ফলে ফোটে প্রাণ/ ওরে রাখাল সাজিয়া হেথা আসে ভগবান,/ নারায়ণ-সাথে খেলা-খেলি অনুক্ষণ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন— ‘হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে/ হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে/ ঘরে ঘরে ডাক পাঠাল/ দীপালিকায় জ্বালাও আলো/ জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে’।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি আল মাহমুদের কবিতায় হেমন্ত এসেছে মানুষের প্রেমে-কামে প্রকৃতির সৌন্দর্যে। তার কাছে হেমন্ত এক ধরনের পরিপূর্ণতার নাম। ‘অঘ্রান’ কবিতায় লিখেছেন— ‘আজ এই হেমন্তের জলদ বাতাসে/ আমার হৃদয় মন মানসীর গন্ধে ভরে গেছে/ রমণীর প্রেম আর লবণ সৌরভে/ আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর/ বসায় মর্চের দাগ, লাল কালো/ কটূ ও কষায়’। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— ‘তোমার অশ্রুজলের করুণ রাগে, যাও, যাও গো এবার যাওয়ার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও’। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার প্রিয়তমার মধ্যে ষড়ঋতুর স্বভাব-সৌন্দর্য অবলোকন করেছেন, ‘শীতের প্রতাপে বহ্নি, তাপহীন হয়/ মানে তাই জ্যোতিহীন, তব নেত্রদ্বয়’। সুফিয়া কামাল হেমন্তের বন্দনায় লিখেছেন— ‘এই তো হেমন্ত দিন, দিল নব ফসল সম্ভার/ অঙ্গনে অঙ্গনে ভরি/ এই রূপ আমার বাংলার/ রিক্তের অঞ্চল ভরি/ হাসি ভরি, ক্ষুধার্তের মুখে/ ভবিষ্যৎ সুখের আশা ভরি দিল কৃষকের বুকে/ শিশিরের সিক্ত দ্বারা বুকে তৃণাঞ্চল জাগে/ সোনালি ধানের খেতে ঈষৎ শীতার্ত হাওয়া লাগে।

জসীম উদদীন লেখেন— ‘আশ্বিন গেল কার্তিক মাসে পাকিল খেতের ধান/ সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি কোটার গান/ ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়ায় বায়ু/ কলমি লতায় লেন লেগেছে, ফুরাল ফুলের আয়ু’। হেমন্তের অন্য নাম নবান্ন। একসময় বাংলায় বছর শুরু হত হেমন্ত দিয়ে। কারণ, ধান উৎপাদনের ঋতু হলো এ হেমন্ত নবান্ন মানেই চারদিকে পাকা ধানের ম ম গন্ধ, নতুন অন্ন, গ্রামের মাঠে মাঠে চলে ধান কাটার ধুম, হেমন্তে এ ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই ঘরে ঘরে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। গৃহস্থবাড়িতে নতুন ধানে তৈরি পিঠাপুলির সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পরিপক্ব হয়। নতুন ধানের আগমনে কৃষকের গলায় ধরে আনন্দের গান। আর ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা। বাংলার কৃষকের আঙিনা ভরে দেয় সোনালি শস্যে। তাই বলা যায়, ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি নিয়ে আসে হেমন্ত বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব। কৃষকের সচ্ছলতার হাসি নিয়ে আসে এই হেমন্ত। হেমন্ত শুধু সোনালি শস্যে কৃষকের ঘর ভরে দেয় না; সঙ্গে সঙ্গে ভরে দেয় কৃষাণ-কৃষাণির স্বপ্নের কুঁরেঘর।

এহসান বিন মুজাহির : প্রিন্সিপাল, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মৌলভীবাজার

 
Electronic Paper