উন্নয়ন বলতে আসলে কী বুঝি!
সাজ্জাদ হোসেন
🕐 ১১:৫৪ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৪, ২০২০
বেশ কিছুদিন আগে চায়ের কাপে তুমুল তর্ক চলছিল এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে। প্রসঙ্গটা দেশের উন্নয়ন নিয়ে। তার ভাষ্য, দেশের উন্নয়ন বিগত এক যুগে তুঙ্গে। আমিও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলেছিলাম কাঠামোগত উন্নয়নের বিষয়েÑ তবে পুরোপুরি দ্বিমত পোষণ করেছিলাম মান উন্নয়নের ব্যাপারে। বেশ কিছুদিন আগে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার দুই দিন অবস্থানের অভিজ্ঞতার কথা- দেশের কাঠামোগত উন্নয়ন এবং মান উন্নয়নের বিষয়ে উল্লেখ করা যেতে পারে। আমরা জানি বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় শয্যার চাইতে রোগীদের সংখ্যা ঢের বেশি। রোগীর আত্মীয়দের জন্য ব্যবস্থা তো অনেক দূরের কথা! ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তিদের থাকা নিয়ে যতটুকু না আপত্তি তার চাইতে বেশি অভিযোগ আসে ডাক্তার-কর্মকর্তা এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে। সিনিয়র ডাক্তারদের কেবল সকাল বেলাই পাওয়া যায়। অপরদিকে কর্তব্যরত যেসব ইন্টার্ন ডাক্তার থাকেনÑ তারা কেবল সিনিয়রদের প্রেসক্রিপশন দেখে চিকিৎসা দেওয়া ছাড়া জরুরি অবস্থায় রোগীদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, সে সম্পর্কে অনেকেই অজ্ঞাত। বিভিন্ন পরীক্ষা করার ব্যবস্থাও চরমভাবে সীমাবদ্ধ। যেসব যন্ত্রাংশ সংরক্ষণ করা রয়েছে; সেগুলো হয় অচল নয়তোবা পরীক্ষা করা বন্ধ রয়েছে। এখানেই আরম্ভ হয় ভোগান্তির!
টেস্টগুলো করার জন্য দৌড়াতে হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, যেখানে প্রত্যেকটির ফি থাকে সুউচ্চ। পাশাপাশি ফলাফল কতটুকু নিরাপদ তা নিয়েও থাকে নানান সংশয়! এটি একটি মহানগরে অবস্থিত সরকারি হাসপাতালের ইতিবৃত্ত।
যদি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে আলোচনা করা হয়, সেখানে একটি রোগীর অবস্থান খুব বেশি ঘাবড়ানোর মতো না হলেও বিভাগীয় শহরে নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করা হয়। এসব হাসপাতালগুলো কেবল প্রাইমারি চিকিৎসা দেওয়ার মতোই কাজ করে। অথচ সেসব জায়গায় যদি পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ এবং প্রয়োজনীয় সকল সরঞ্জাম সরবরাহ করা থাকত, তাহলে সাধারণ মানুষকে বিভাগীয় শহরের হাসপাতালগুলোতে ভিড় জমাতে হতো না। যানবাহন ও অর্থের জোগান দিয়ে তবেই শহরের হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হয়। ফলশ্রুতিতে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। এমন বিশ্লেষণ করার একমাত্র উদ্দেশ্য আমাদের কাঠামোগত উন্নয়ন হলেও মান উন্নয়ন তেমন হচ্ছে না।
যদি কৃষিখাত নিয়ে সূক্ষ্ম পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে আমাদের প্রতি বছর বিভিন্ন কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ভারত থেকে পেঁয়াজ আনা কোনো নতুন ঘটনা নয়। কয়েক মাস আগে পেঁয়াজ সমাচার নিয়ে কেমন লঙ্কাকাণ্ড হয়ে দাঁড়াল- এটাও সবার জানা। পাশাপাশি, বাজারে আলুর সংকট ও উচ্চদাম নিয়েও জনগণ ভুগছে দীর্ঘ একটা সময় ধরে। সরকার কর্তৃক দাম নির্ধারণ করার পরেও এটা আয়ত্তে আসেনি। এর অন্যতম কারণ কৃষকরা কী পরিমাণ উৎপাদন করলে চাহিদার তুলনায় বেশি কিংবা কম হবে সে সম্পর্কে ধারণা না থাকা। এটি জানিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসকের। সেটির জন্য সঠিক জায়গায় উপযুক্ত লোক বসানোও জরুরি। এখন উপজেলা পরিসংখ্যান অধিদফতরের দায়িত্বে যদি পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থীকে না দিয়ে বাংলা বিভাগের অনভিজ্ঞ শিক্ষার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয় যিনি পদটি সম্পর্কে অনভিজ্ঞ- সেক্ষেত্রে উৎপাদনে সুষম বণ্টন সম্ভব নয়। সুতরাং যতটুকু সম্পদ অথবা দখলদারি আমাদের রয়েছে তার যথাযথ ব্যবহার করা এবং তার মান উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। নইলে প্রসঙ্গটা অনেকাংশে কাঠ মঞ্চের মতো হয়ে উঠবে; মঞ্চ বৃদ্ধি করা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কলাকুশলী নেই অথবা তারা অভিনয় পারেন না।
সরকারের প্রত্যেকটি বিভাগ বা অধিদফতরে এমন অগণিত উদাহরণ দেওয়া যাবে। যদি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কে বলতে হয়Ñ তাহলে বোর্ড পরীক্ষা, মেডিকেল-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস বহু পুরাতন সমালোচনার বিষয়। এর মধ্যে গণহারে মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পাওয়ার নজির এ দেশে রয়েছে। কোনো কিছু যদি ‘বিসমিল্লায় গলদ’ হয় তাহলে সুদূর ভবিষ্যতে কী হবে তা আসলেই চিন্তার বিষয়। একজন অযোগ্য শিক্ষার্থী যখন দুর্নীতি করে ডিগ্রি নিয়ে ডাক্তার কিংবা প্রশাসনের বড় কর্মকর্তা হবেন- তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই তার দ্বারা অনিয়ম, অপকর্ম হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনকি জাতির জন্যও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। মেডিকেল কলেজে অযোগ্য শিক্ষার্থী গ্রহণের উপলক্ষটি ভাবলে যে কেউ সেটি ধারণা করতে পারবেন।
যেহেতু শিক্ষা খাত নিয়ে প্রসঙ্গ এসেছে সেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করতেই হয়। বর্তমানে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক দলের কতটা আশ্রয় নিতে হয় এ নিয়ে ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকা, গোলটেবিলে অনেক পর্যালোচনা হয়েছে। চাকরি গ্রহণের পর সেই শিক্ষকের যখন শিক্ষা প্রদান কাজটি মুখ্য না হয়ে, রাজনীতি চর্চাই প্রধান হয় তখন তার অনুসারী অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের মাঝেও এমন বিরূপ প্রভাব ফেলে। তারাও আগামীতে তাদের জায়গায় পদার্পণের উদ্দেশ্যে অমন পথ অনুসরণ করবে; কল্পনা করাই যায়। সুতরাং এই নিয়মে চললে শিক্ষক বাড়িয়ে যতটুকু না প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন করা যায়Ñ তার চাইতে যারা আছেন তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব। এর মানে এই নয় আমি নতুন শিক্ষক বাড়ানোর বিপক্ষে। এটি গেল একটি প্রতিষ্ঠানের জনবলের ব্যাপারে। এখন যদি গবেষণা নিয়ে বর্ণনা করি তাহলে একই সুরে বলতে হয় মান উন্নয়ন জরুরি। গত বছরে লন্ডনভিত্তিক শিক্ষা বিষয়ক সাময়িকী, ‘টাইমস হায়ার অ্যাডুকেশন’-এ বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে র্যাংকিং প্রকাশ করে তাতে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এক হাজারের পরে। তারা পাঁচটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে এই সূচক নির্ধারণ করে থাকে। প্রথমত, খ্যাতি জরিপ। যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকে সমসাময়িক গবেষকরা কীভাবে মূল্যায়ন করেন তা নির্ধারণ করা হয়। দ্বিতীয়ত, গবেষণা আয়। যার মাধ্যমে গবেষণার গুরুত্ব ও মান নির্ধারণ করা হয় এবং গবেষণার পরিমাণ অর্থাৎ ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কী পরিমাণ উন্নত মানের গবেষণাপত্র প্রকাশ করছে তার ওপর। কিন্তু গবেষণার উন্নতকরণ নিয়ে বিগত বছরগুলোতে নানান বিতর্ক হলেও তেমন কোনো পরিবর্তন এখন পর্যন্ত আসেনি। এর পেছনের কারণ প্রয়োজনীয় তহবিলের অভাব নয়তোবা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। অথচ একটি বিশ^বিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক গবেষণা বৃদ্ধি পেলে শুধু সেই প্রতিষ্ঠানের মানেই উন্নয়ন হবে না বরং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও ব্যাপক অবদান সাধন হবে। আমরা কেবল বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাবনা দিচ্ছি, কিন্তু অভ্যন্তরীণ কলকব্জা শক্ত করার জন্য তেমন জোর দিচ্ছি না। চিকিৎসা, কৃষি ও শিক্ষা এই তিন সেক্টর মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে হলে সেসবের মাপকাঠি বিবেচনার বিকল্প নেই। খুব নিগূঢ়ভাবে পর্যালোচনা করলে অন্যান্য শাখাতেও এমন সূক্ষ্মতর সীমাবদ্ধতা বেরিয়ে আসবে।
এ কথা অনস্বীকার্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে অতীতের চেয়ে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। অনেক দেরিতে হলেও একাত্তরের যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশ, বিশ্বে এখন অন্যতম মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। সামনে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ ভারতকে পেছনে ফেলবে, এমন প্রত্যাশাও করছেন অর্থনীতিবিদরা। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ, পাকা রাস্তাঘাট, সেতুসহ সামাজিক অগ্রগতির দিক থেকে প্রশংসিত হচ্ছি আন্তর্জাতিক মহলে। নারীদের কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষায় প্রবেশ আমাদের অন্যতম অর্জন। কিন্তু চিরাচরিত ব্যবস্থায় সমাজের উন্নয়নে যেভাবে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন হয়ে আসছে, এতে করে এর ফল খুব বেশি টেকসই হয় না। আমাদের বিকল্প চিন্তা করাও জরুরি। অর্থনীতির ভাষায় যাকে ‘বিকল্প পরিকল্পনা’ বলা হয়ে থাকে। সঠিক কর্ম-পদ্ধতিই পারে দেশের কাঠামোগত ও মান উন্নয়ন উভয়ই সুনিশ্চিত করতে।
সাজ্জাদ হোসেন : শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া