ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পানির অপচয় রোধ জরুরি

শাহীন চৌধুরী ডলি
🕐 ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৩, ২০২০

নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। নদীগুলোর তীর ঘিরেই গড়ে উঠেছে এই দেশের জনপদ, শহর, বন্দর, গ্রাম। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে নদীর রয়েছে অপরিসীম অবদান। মানুষের সভ্যতার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান পানির। দেশের জলাশয়গুলো এখন আর আগের অবস্থানে নেই। নদীকে শাসন-শোষণ করে মানুষ নদী তথা পানির উৎসগুলোকে ধ্বংসের আয়োজন করেছে। বালু উত্তোলন, নদী-খাল-বিল দখল করে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে আবাসন, কল-কারখানা ইত্যাদি। ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তা ব্যারেজ, টিপাইমুখ বাঁধের কারণে বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলো পড়েছে বিপর্যয়ের মুখে। এছাড়াও আছে নিত্যদিনের ব্যবহারে পানির নানামুখী অপচয়। ফলে পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে।

সব পানি পানের যোগ্য নয়, একমাত্র বিশুদ্ধ পানিই পানের যোগ্য। পানির অপর নাম জীবন। পানির অস্তিত্বের ওপর টিকে আছে সমগ্র প্রাণী ও উদ্ভিদকুল। প্রতিদিনের ব্যবহার্য পানি যদি দূষিত হয় এবং পানের অযোগ্য হয়, তাহলে জীবনে হুমকির সম্মুখীন হতে হয়। ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন, স্বাস্থ্য ও দারিদ্রের বিশ্লেষণ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দেশে বিভিন্ন উপায়ে সরবরাহ করা খাবার পানির ৪১ শতাংশ ডায়রিয়ার জীবাণু বহন করছে। পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা ৮০ শতাংশ পানিতে আছে ক্ষতিকর জীবাণু। শহরাঞ্চলে পাইপলাইনে সরবরাহ করা ট্যাপের ৮০ শতাংশ পানিতে ক্ষতিকর জীবাণু ইকোলাই রয়েছে। প্রতিবেদন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, পানির দূষণ ও নিম্নমান অনেক অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। কাজেই এই দূষিত ও মানহীন পানি ব্যবহার করে প্রস্তুত করা খাদ্যসামগ্রীও দূষিত হচ্ছে। আর সেই দূষিত খাবার আমরা প্রতিদিন গ্রহণ করছি। 

আমাদের জীবনের অতি প্রয়োজনীয় উপাদান পানি। সকল দৈনন্দিন কাজ, পান করা, রান্না করা, জমির ফসল ফলানো, মাছ চাষ, গবাদিপশু পালন, কল-কারখানা, হাসপাতাল মোটকথা সর্বত্রই পানির অপরিহার্যতা অসীম। পানিসম্পদ ছাড়া পৃথিবীর সভ্যতা ও মানুষের জীবনধারণ অসম্ভব। পানি ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব না। পানি আমাদের মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রয়োজনে যতটুকু পানি ব্যবহার করা উচিত তারচেয়ে অনেক বেশি আমরা অপচয় করি।

দ্রুত নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক কর্মকা-ের ফলে বিশ^ব্যাপী বর্জ্য পানির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বিশে^র বহু দেশে পানি নিয়ে হাহাকার আছে। ভবিষ্যতে বিশুদ্ধ পানির জন্য দেশে দেশে যুদ্ধ লাগার আশঙ্কার কথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমাদের পরিবার, সমাজ ও দেশে অপচয় করা একটা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সঠিকভাবে ব্যবহারবিধি না মেনে চলার কারণে অদূর ভবিষ্যতে পানি নিয়ে তীব্র সংকটের মুখোমুখি হতে হবে।

পানি সরবরাহের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ওয়াসা। ওয়াসার পানি ধনী ও নিম্নবিত্ত পরিবারকে একই দামে কিনতে হয় এবং উভয়ের ক্ষেত্রে সরকারের ভর্তুকিতে কম-বেশি নেই। সম্প্রতি ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশে^র ২০০ কোটি মানুষ পরিষ্কার ও নিরাপদ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জাতিসংঘের ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৯’ অনুযায়ী বিশে^র ২১০ কোটি মানুষ নিরাপদ ও পানযোগ্য পানি থেকে বঞ্চিত। ভবিষ্যতে পানির সংকট সৃষ্টি হবে এমন পূর্বাভাস দিয়ে বলা হয়েছে, বিশ^ অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পরিবেশগত বিপর্যয় ও পানির অভাবে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশে^র মোট দেশজ উৎপাদন ৪৫ ভাগ এবং বিশে^র শস্য উৎপাদন ৪০ ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে।

সরকারি সম্পদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা কম। আমরা যথেচ্ছভাবে সরকারি সম্পদের অপচয় করি, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ। ওয়াসার জরিপ অনুযায়ী, পুরান ঢাকায় পানির অপচয় হয় চোখের সামনে আর অভিজাত এলাকায় অপচয় হয় আড়ালে। ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির ব্যাপক অপচয় করেন সমাজের বিত্তবান শ্রেণির লোকজন। অভিজাত এলাকাগুলোতে বৈধ সংযোগের পাশাপাশি কোনো কোনো বাড়িতে অবৈধ সংযোগ রয়েছে। অবৈধ সংযোগের পানি অপচয়ের খাতেই পড়ে। অবৈধ সংযোগের জন্য গ্রাহক যেমন দায়ী, তারচেয়ে বেশি দায়ী ওয়াসার একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক লাভের জন্য অপচয়ে সহায়তা করে।

পানির চরম সংকটে আছেন নিম্নবিত্তরা। ঢাকার পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্রাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় প্রতিদিন জনপ্রতি পানির ব্যবহার হওয়া উচিত ১৫০ লিটার কিন্তু বস্তি এলাকার বাইরে যারা থাকেন তারা প্রতিদিন ৩১০ লিটার পানি ব্যবহার করেন। অন্যদিকে গুলশান-বনানীর মতোন অভিজাত এলাকার বাসিন্দারা ব্যবহার করেন ৫০৯ লিটার পানি। নিম্ন আয়ের মানুষ ব্যবহার করে প্রতিদিন মাত্র ৮৫ লিটার পানি। ৩২ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে পানির সংকটে ভোগেন। ঢাকায় সচ্ছল পরিবারে শুধু টয়লেটের কমোড ফ্ল্যাশ করে দিনে যতটুকু পানি খরচ হয় এই একই পরিমাণ পানি দিয়ে বস্তির বা নিম্ন আয়ের একটি পরিবার দৈনিক খাবার, রান্না, গোসলসহ সব কাজ চালাতে পারেন। ধনী-গরিব একই মূল্যে পানি কিনছে কিন্তু ব্যবহারের ক্ষেত্রে রয়েছে বৈষম্য, এটা অন্যায্য। পানি বিশেষজ্ঞের মতে, ধনী পরিবারে একবার কমোড ফ্ল্যাশ করতে ১৫ লিটার পানি খরচ হয়। সরকার যদি ৫ লিটার ক্ষমতার লোডাউন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে, তাহলে পানির অপচয় অনেক কমে যাবে।

পানির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বেশিরভাগ মানুষ অবহেলায়, অসচেতনতায় বিপুল পরিমাণ পানির অপচয় করছে। ইচ্ছে করলেই এই অপচয় রোধ করে কোটি কোটি লিটার পানির অপচয় কমানো যায়। সচেতনতার সঙ্গে কিছু ব্যাপার অবলম্বন করলে পানির অপচয় রোধ করা সম্ভব। করোনায় আমরা ঘনঘন হাত ধুচ্ছি। হাত ধোয়ার সময় পানি দিয়ে হাত ভিজিয়ে সাবান দিয়ে পরিষ্কারের সময় কল বা ট্যাপ বন্ধ রাখি। এতে সাশ্রয় হবে দেড় থেকে দুই লিটার পানি। রান্নাঘরের বেসিনে কম পানি বের হয় এমন ট্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে সাধারণ একটি পানির ট্যাপের তুলনায় মিনিটে তিন গ্যালন পর্যন্ত পানি বাঁচানো সম্ভব। শাকসবজি ধোয়ার জন্য ট্যাপ ছেড়ে না রেখে বড় গামলা বা পাতিল ব্যবহার করলে পানির অপচয় রোধ সম্ভব। হাতে থালা-বাসন ধুতে ২০ গ্যালন পানির প্রয়োজন হয়। এই ক্ষেত্রে সম্ভব হলে ডিশওয়াশার ব্যবহার করা যেতে পারে। ডিশওয়াশারে প্রয়োজন হয় মাত্র ৪.৫ গ্যালন পানি।

থালা-বাসন হাতে পরিষ্কার করতে হলে প্রথমে স্পঞ্জ ভিজিয়ে লিকুইড সাবান বা ডিটারজেন্ট লাগিয়ে বাসনকোসন মেজে নিয়ে পানিতে ডুবিয়ে ধুয়ে নিলে পানির বাড়তি ব্যবহার থেকে বিরত থাকা সম্ভব। হাত-মুখ ধোয়া, দাঁত ব্রাশ করা বা অজু করার সময় কল খোলা রাখলে অব্যাহতভাবে পানি পড়তে থাকে। সচেতনতার সঙ্গে ট্যাপ খুলে আবার বন্ধ করে অথবা একটি পাত্রে প্রয়োজনীয় পানি নিয়ে ব্যবহার করলে অপচয় রোধ করা যায়। কাপড় পরিষ্কারে ওয়াশিং মেশিনের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। পুরোপুরি ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত মেশিন ব্যবহারে বিরত থাকুন। অনেকেই যখন তখন টয়লেট ফ্ল্যাশ করি। এতে প্রচুর পানির অপচয় হয়।

একান্ত প্রয়োজন না হলে ফ্ল্যাশ করা থেকে বিরত থাকি। পুকুর বা খালে ময়লা ফেলে পানি দূষিত না করি। অনেক সময় পানির পাইপে থাকা বিভিন্ন জোড়া হালকা হয়ে চুইয়ে চুইয়ে পানি বাইরে পরে। পানির পাইপগুলো ঠিক রেখে অপচয় রোধ করা যায়। নষ্ট পানির ট্যাপ বদলে ফেলতে হবে। গোসলে ঝরনা বা বালতি ভরে মগের সাহায্যে গোসল করার সময় কমিয়ে আনি। দীর্ঘক্ষণ ধরে গোসল করলে অতিরিক্ত পানি খরচ হয়। আজকাল বাজারে পানি সাশ্রয়ী ঝরনা কিনতে পাওয়া যায়। সেগুলো ব্যবহার করে পানির অপচয় রোধ সম্ভব। পানির ট্যাংক ভরে যাওয়ার পরই মোটর বন্ধ করতে হবে যেন অতিরিক্ত পানি পড়ে অপচয় না হয়।

খাওয়ার পর গ্লাসে পানি অবশিষ্ট থাকলে সেই পানি ফেলে না দিয়ে টবের গাছে দিতে পারি। বৃষ্টির পানি জমিয়ে রেখে গৃহস্থালি কাজসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। একটা জলাধারে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করলে, পরবর্তীকালে সেই পানি অনেক কাজে ব্যবহার করা যাবে। বর্জ্যপানির ব্যবস্থাপনা পানি সংকট মোকাবিলায় একটি উপায় হতে পারে। পানির ক্রমবর্ধমান সংকট রোধে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত পানির পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পানির পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বিদ্যমান পানির সংকট ও অপচয় বহুলাংশে হ্রাস পাবে।

শাহীন চৌধুরী ডলি : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper