ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বেপরোয়া তৃতীয় লিঙ্গ ও রাষ্ট্রের দায়

এনাম রাজু
🕐 ১:০৬ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ০১, ২০২০

তৃতীয় লিঙ্গ শব্দের সঙ্গে কম-বেশি সকলেই পরিচিত। নারী ও পুরুষের মাঝামাঝি একশ্রেণির মানুষকে আমরা তৃতীয় লিঙ্গ বলে থাকি। এই বিশেষ শ্রেণির মানুষগুলো জন্মের পরপরই স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। এর মূল কারণ হল—পরিবার সন্তানকে জন্ম দেওয়ার আগেই ধরে নেয় তাদের সন্তান মেয়ে অথবা ছেলে হবে। কিন্তু ব্যতিক্রম হলে, এটাকে অভিশাপ মনে করে। আর সমাজের কাছে নিজেকে অসম্মানি মানুষ হিসেবে ধরে নেয়। ফলে উভয়লিঙ্গের শিশুটি সমাজ থেকে ছিটকে পড়ে। পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়েও মানুষের সভ্য সমাজে বেড়ে ওঠে নানান সমস্যাকে সঙ্গী করে। আর ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে অপরাধী। বিশেষ করে চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের মতো কাজগুলো রপ্ত করে খুব অল্প সময়েই। আমরাই মূলত তাদের এমন ঘৃণিত কাজের দিকে ঠেলে দিই। অথচ জন্মসূত্রে তৃতীয় লিঙ্গদের মতো শারীরিক সমস্যা না নিয়ে জন্ম নিলেও একজন প্রতিবন্ধীর প্রতি আমাদের কত মায়া, ভালোবাসা, করুণা, স্নেহ থাকে। কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গের বেলায় হয় তার উল্টো।

পিতা-মাতা নিজেদের অভিশপ্ত মনে করে, সন্তানকে পারিবারিক বন্ধন থেকে দূরে ঠেলে দেয়। আর এই কারণে তারাও হয়ে ওঠে হিংস্র। ৮ নভেম্বর ২০২০। সকাল ছয়টা। আমি বনানী থেকে শ্রীপুর চৌরাস্তার উদ্দেশ্যে বাসে উঠি। আব্দুল্লাহপুরে বাসে ওঠে একদল হিজড়া। বরাবরই তৃতীয় লিঙ্গদের ভয় পাই। আমি বাসে তাদের ওঠা দেখেই পকেট থেকে দশ টাকার নোট বের করে রাখি। বাসে ওঠেই তারা প্রতিটি যাত্রীর কাছে টাকা চাওয়া শুরু করে। আমার কাছে আসতেই দশ টাকার নোটটি দিয়ে দিই। কিন্তু আমার পাশে বসা ছেলেটির কাছে টাকা চাওয়াতে সে অস্বীকৃতি জানালে শুরু হয় তার সঙ্গে বেহায়াপনা। ছোট্ট ছেলেটির স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিলে সে রেগে যায়। তার সেই রাগের কারণে আরও দুজন এসে ছেলেটির স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিয়ে বোলাতে থাকে। অসহায়ের মতো ছেলেটির চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি গড়াতে থাকে। একই অবস্থা পাশের সিটে বসা মা ও মেয়ের সঙ্গে। তারা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের নানান রকমের অভিশাপ দিতে থাকে। একপর্যায়ের মা ও মেয়ের মুখে থুথু দিয়ে নেমে যায়। আমরা গাড়িতে সাত আটজন যাত্রী। তাদের এমন আচরণে সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। কেউ মুখে কিছু বলতে পারিনি। আব্দুল্লাহপুর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত মা ও মেয়ে কান্না করতে থাকে। আমাদের সামনে তাদের লজ্জার শেষ নেই। একটা সময় আমি মা ও মেয়েকে বুঝিয়ে বললাম, তারা বাস থেকে নেমে আরেকটি বাসে গন্তব্যে যেতে। তাতে হয়তো তাদের লজ্জার বিষয়টি হালকা হবে। আজকে আরেকটি ঘটনার কথাও মনে পড়ে গেল। তখন বাড্ডায় থাকি। পাশের বাসায় পরিচিত এক বড় ভাইয়ের সন্তান জন্ম নেয়।

এই খবর হিজড়াদের কাছে গেলে তারা বিকেলের দিকে এসে ওই বাড়ির বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। টাকা না দিলে তার বাচ্চার ক্ষতি হবে বলে অভিশাপ দিতে থাকে। এমনকি তারা বাসা ছেড়ে যাবে না বলেও হুমকি দিতে থাকে। বাসার খুব কাছাকাছি থানা বলে, কেউ একজন থানায় গেলে পুলিশ বলে, টাকা দিয়ে দেন। কারণ, আজ না হয় আমরা এসে তাড়াব, কালকে কী করবেন? তাদের দরাদরির স্টাইল স্বাভাবিকের চেয়ে উল্টো। সাধারণত কেউ হয়তো প্রথমে বেশি চাইবে, পরে আস্তে আস্তে সেটার চেয়ে কম কোনো পরিমাণে রাজি হবে। কিন্তু ওরা প্রথমে এসে পাঁচ হাজার টাকা চেয়েছিল, দিতে রাজি না হওয়ায় তারা আট হাজার দাবি করে বসল। পুলিশের সাহায্য পাওয়া যাবে না বুঝে নিয়ে পরিচিত ভাইটি কোনোমতে চার হাজার দিয়েই বিদায় করলেন। তারা ইচ্ছেমতো মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরণ করছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুরুষ-মহিলা সবার গায়ে হাত দিচ্ছে, অনেকের যৌনাঙ্গেও হাত দিচ্ছে, চাপ দিচ্ছে; কিন্তু এদের কিচ্ছু বলার উপায় নেই। পাশেই পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকে, না দেখার ভান করে থাকে। যদি এমনভাবে চলতে থাকে তাহলে গ্রাম থেকে আসা মানুষগুলো শহরে কতটা নিরাপদহীনতায় ভুগবে।

কারণ আমরা যারা রাজধানীতে দীর্ঘকাল বসবাস করছি তারা হয়তো সহজভাবে নেব, নিতে বাধ্য হচ্ছিও। কিন্তু তারাও অনভ্যস্ত। শুনেছি এদের কাজে প্রতিবাদ করলে, এরা সংঘবদ্ধ হয়ে আক্রমণ করে। তখন সর্বস্ব হারাতে হয়, এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে। আর ধীরে ধীরে তারা যখন অপরাধ করেও পার পেয়ে যাবে আর যাচ্ছেও। তখন তারা আরও বেপরোয়া হবে। তাই সময়ক্ষেপণ না করে এখনই সরকার ও প্রশাসনকে হিজড়াদের বিষয়ে ভাবতে হবে। এই ভাবনা যেন শুধু ভাবনার জগতে হাবুডুবু না খায় সে দিকেও নজর রাখতে হবে। প্রয়োজনে প্রাপ্তবয়স্ক হিজড়াদের দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। অপ্রাপ্তবয়স্ক হিজড়াদের অন্যান্য শিশুর মতো একাডেমিক শিক্ষা, খেলাধুলা করার ব্যবস্থা, মানসিকভাবে শক্তি অর্জনের শিক্ষা দিতে হবে। সমাজে তৃতীয় লিঙ্গ কোনো অভিশাপ নয়, বিষয়টি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবারকেও বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে। তারা যেন অন্য দশজন মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে, শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ভোগ করতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সর্বোপরি, মনে রাখা দরকার তৃতীয় লিঙ্গ আপনার-আমার সকলের মতো একজন মানুষ।

এনাম রাজু : কবি ও গল্পকার
[email protected]

 
Electronic Paper