হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী: ক্ষণজন্মা সাংবাদিক
মুহাম্মদ তাফহীমুল ইসলাম
🕐 ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৯, ২০২০
জন্ম নিলে মৃত্যু অবধারিত। এই চিরন্তন সত্য কথা সব মানুষ বিশ্বাস করে। এই স্বাভাবিক পরিণতির কথা যদিও ভুলে থাকে কর্মব্যস্ত মানুষ। মৃত্যুর ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলেও কিছু মানুষের মৃত্যু নাড়া দিয়ে যায়, হৃদয়ে দাগ কেটে যায়। মৃত্যুর সময়কে উপলব্ধি করতে শিখিয়ে দিয়ে যায়। তেমনিভাবে কোনো পূর্ব ইঙ্গিত ছাড়া আকস্মিকভাবে চলে গেলেন বরেণ্য সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী। তিনি গত ২৬ নভেম্বর করোনা উপসর্গ নিয়ে স্থায়ী গন্তব্যে পাড়ি জমান।
হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী ১৯৬০ সালের ৪ মার্চ চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বৈলছড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটকাল থেকেই বইয়ের প্রতি তার বেশ সখ্যতা ছিল। সেই সূত্রে লেখালেখির প্রতি আকৃষ্ট হন। মাধ্যমিকের গন্ডি পার না হতেই তিনি চমকে দেওয়া লেখা আবিষ্কার করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯৭৬ সালে তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়।
তিনি লেখার চেয়ে পড়াকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। যার কারণে তার প্রথম বই ‘এক কিশোরের মন’ প্রকাশিত হয় লেখালেখি শুরুর তিন দশকেরও বেশি সময় পর ২০০৯ সালে। হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী ছিলেন মূলত শিশুসাহিত্যিক। শিশুসাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার বিচরণ ছিল। তবে ছড়ার রাজ্য ছিল তার প্রধান পদচারণাস্থল।
পরে সাংবাদিকতা থেকে আহরিত নানা উপাত্ত নিয়ে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় বই ‘অচেনা মানুষ অজানা কথা’। এই বইয়ে গবেষণালব্ধ নানা তথ্য রয়েছে। এরপর প্রকাশিত হয় তার কিশোর গল্পের বই ‘সারপ্রাইজ’। এই তিন বইয়ের সমন্বয়েই হুমায়ুন সাদেক চৌধুরীর লেখক জীবন। প্রায় ৪ যুগ সময় লেখালেখির সঙ্গে ছিলেন কিন্তু প্রকাশিত বই মাত্র তিনটি! এছাড়াও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে তিনি লিখতেন। আন্তর্জাতিক বিষয়ে তার পর্যবেক্ষণ ও গবেষণামূলক অসংখ্য লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
হুমায়ুন সাদেক চৌধুরীর মূল পরিচয় সাংবাদিক। নানা ঝড়-তুফানের মাঝেও তিনি আজীবন সাংবাদিকতার সঙ্গে ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে গ্রামীণ ব্যাংকে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে তার কর্মজীবনে পদার্পণ। গ্রামীণ ব্যাংকে চাকরি নিলেও সেখানে বেশিদিন থাকেননি। ফিরে এসেছেন সাহিত্যের কাছে, সাংবাদিকতায়। তার মননজুড়ে সাহিত্য ও সাংবাদিকতার এতটাই আধিপত্য!
হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী সাব এডিটরদের সংগঠন সাব এডিটরস কাউন্সিলের দুবার নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। চট্টগ্রামের দৈনিক নয়া বাংলা, ঢাকার দৈনিক দিনকাল, দৈনিক আমার দেশ, পাক্ষিক পালাবদলসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে তিনি কাজ করেছেন। জীবদ্দশায় দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকার অতিরিক্ত বার্তা সম্পাদক ও অর্থনীতি প্রতিদিন পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ সাংবাদিক ইউনিয়ন ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের আজীবন সদস্য ছিলেন।
হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় খ্যাতি পেয়েছিলেন। লেখক হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি পেয়েছিলেন। খ্যাতি, পরিচিতির অহংকার কখনো তার মধ্যে দেখা যায়নি। প্রচারের জায়গায় থেকেও সবসময় প্রচারবিমুখ থাকতে চেয়েছেন, থেকেছেন। নির্লোভ, নিরহংকার, সাদাসিধা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন।
কয়েক বছর ধরে চাকরি হারিয়ে তিনি কঠিন সময় পার করছিলেন। এমনকি জীবনের শেষ সময়ে অর্থের টানাপোড়েনে ঠিকমতো চিকিৎসাটাও করতে পারেননি বলে আমরা শুনেছি। শরীরে করোনা উপসর্গ দেখা যাওয়ার এক সপ্তাহ পর ২৬ নভেম্বরে অবস্থার অবনতি হলে তাকে মেডিকেলে নেওয়া হয়। মেডিকেলে ভর্তির কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি চলে যান পরপারে।
হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী করোনা উপসর্গ নিয়ে জীবন দেওয়ার মাধ্যমে যেন প্রমাণ করে গেলেন কেউ কারও নয়! আমরা মহান আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করি, তিনি যেন আমাদের স্বজন হুমায়ুন সাদেক ভাইকে স্থায়ী গন্তব্যে শান্তিতে রাখেন।
মুহাম্মদ তাফহীমুল ইসলাম: লেখক, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম
[email protected]