ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

প্রাথমিক স্তরের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া

রিপন আহসান ঋতু
🕐 ১২:২১ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৫, ২০২০

শিক্ষা শুধু একটি জাতির মেরুদ-ই নয়, এটি মৌলিক মানবাধিকার এবং মানব সক্ষমতা বিনির্মাণের প্রধান হাতিয়ারও। করোনা মহামারীর কারণে শিক্ষায় যে ক্ষতি হচ্ছে তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য সব রকম কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত থাকার কথা! মাধ্যমিক স্তরে কিছু কিছু পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখা গেলেও সে অর্থে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কি ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা এখনো তা দৃশ্যমান হয়নি কারও কাছেই। অথচ প্রাথমিক স্তরে দেশে বর্তমানে শিক্ষার্থী আছে ২ কোটি ৯ লাখ। কিন্তু তারা কেউ জানে না পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে কিভাবে তাদের মূল্যায়ন করা হবে?

করোনার কারণে পৃথিবীর অনেক দেশেই এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ১৬০ কোটি শিক্ষার্থীর ওপর এ মহামারীর প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত আমাদের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী ১৮ মার্চ থেকে শ্রেণিকক্ষের বাইরে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে একধরনের উদ্বেগ আমরা দেখছি। এসব বিষয় নিয়ে প্রশাসনিকভাবে আলোচনা হচ্ছে। তারাও চিন্তাভাবনা করছেন খুলে দেওয়া যায় কিনা। স্কুল খোলার পরিকল্পনার বিষয়টি গণমাধ্যমেও ক্রমাগত আসছে। তবে এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া সঙ্গত হবে বলে অনেকে মনে করছেন না। বিশ্বজুড়ে করোনার যে পরিস্থিতি আমরা এখনো দেখছি তাতে শিক্ষার্থীদের কোনোভাবেই ঝুঁকির মুখে ফেলা ঠিক হবে না। করোনায় সম্মুখযোদ্ধা চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরাও কিন্তু উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কথাই বলছেন এখনো। কারণ করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা আসলে সবারই অজানা।

তবে এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যেও শর্তসাপেক্ষে কওমি মাদ্রাসাগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে বেশ আগেই। আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরাসরি লেখাপড়া করানোর অনুমতি পায়নি এখন পর্যন্ত। সেই হিসাবে দীর্ঘ ৯ মাস ধরে বন্ধ আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনাভাইরাসে শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকায় মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা অটোপাস পেলেও প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা পরের ক্লাসে কোন পদ্ধতিতে পদোন্নতি পাবে সে বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি আজও। অন্যদিকে উভয় স্তরের শিক্ষার্থীদের চলছে অনানুষ্ঠানিক লেখাপড়া।

তাদের মধ্যে শিখন ঘাটতি ঘোচাতে পরিকল্পনামাফিক মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের ওপর নেওয়া হচ্ছে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’। কিন্তু প্রাথমিক স্তরের জন্য এ ধরনেরও বিশেষ কোনো কর্মসূচি এখনো ঘোষণা করা হয়নি। ফলে অনেকটা দিক নির্দেশনাহীনভাবেই চলছে এ স্তরের শিক্ষা। এখন সবার প্রশ্ন প্রাথমিকের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া তাহলে কবে জানা যাবে?

আমরা দেখলাম বিদ্যমান বাস্তবতায় কেবল বছরের প্রথম আড়াই মাসের শ্রেণি কার্যক্রমই শিক্ষার্থীদের চলতি বছরের সরাসরি প্রাপ্ত পাঠ। এতে শিক্ষার্থীর বয়স ও শ্রেণি অনুযায়ী শিখন ও প্রশিক্ষণে নিশ্চিত করেই বলা যায় এতে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যদিও পাঠদানের বিষয়ের নীতি-নির্ধারকরা দাবি করছেন, সংসদ টিভি ও বেতারের মাধ্যমে পাঠদান চলছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের দাবি অনুযায়ী, ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে এই পাঠ পৌঁছাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ও দাবি করছেন, ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছাচ্ছে টিভির পাঠ। তবে এটা ঠিক আকর্ষণহীনতার কারণে টিভি-রেডিওর পাঠ যাদের কাছে পৌঁছেছে তারাও এখন অনেকেই তা দেখছে না।

বিকল্প হিসেবে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকরা বাড়িতে গিয়ে বা মোবাইলে শিক্ষার্থীর পাঠ গ্রহণ করছেন বলে দাবি করলেও বাস্তবতার কিন্তু ভিন্ন। আমার নিজ এলাকা সিরাজগঞ্জ কাজিপুরের কথাই যদি বলি সেখানে দেখলাম, শিক্ষার্থীদের পড়া বুঝে নিতে হলে যেতে হচ্ছে শিক্ষকদের বাড়িতে। যেখানে স্কুলের দূরত্বই অনেক, সেখানে কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এসব শিক্ষার্থীরা কিভাবে শিক্ষকের বাড়িতে যাবে বিষয়টা কারও কাছে বোধগম্য নয়।

শিক্ষকদের দায়িত্ব শুধু শ্রেণিকক্ষে ক্লাস পরিচালনা করা আর খাতা দেখাই নয়, বরং যেকোনো পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা। বর্তমান এই অস্থির সময়ে প্রতিটি শিক্ষকের উচিত শিক্ষার্থীদের নিয়ে চিন্তা করা এবং ব্যক্তি উদ্যোগে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক কার্যাবলিতে ব্যস্ত থাকতে পারে। যদিও আমরা দেখেছি শিক্ষাক্ষেত্রের প্রায় প্রতিটি সংকটেই প্রথম এগিয়ে আসেন আমাদের শিক্ষকরাই। কিন্তু নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে দিকনির্দেশনা না আসাতে হয়তো তাদের মধ্যে সেই ফোর্সটা এখনো সেভাবে তৈরি হয়নি।

এত এত সংকট আর প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও আমাদের অভিভাবকরা বিকল্প নানা মাধ্যমে তাদের শিশুদের লেখাপড়া চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই যে আনুষ্ঠানিক পাঠদানের অভাব, এটার কারণে শিখনের একটা বড় গ্যাপ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কিভাবে এই গ্যাপ পূরণ হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। শিক্ষা গবেষকরা মনে করছেন শহরাঞ্চলে এর প্রভাবটা কম পড়বে। কিন্তু মূল প্রভাবটা পড়বে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ওপর। এজন্য মাধ্যমিক স্তরে যে ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ পদ্ধতি শুরু হয়েছে সেটা অনেকটা কাজে লাগবে। তবে এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও বলছেন বিশ্লেষকরা। এগুলো হচ্ছে, ১. সবার কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করা। ২. যারা (গ্রামাঞ্চলের) পিছিয়ে গেছে তাদের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে কাজ করা। ৩. যাদের বাড়িতে লেখাপড়া জানা বাবা-মা-ভাইবোন নেই তাদের অ্যাসাইনমেন্ট সম্পন্ন করা।

তাদের অভিমত প্রথম দুটি প্রশাসনিক পদক্ষেপের বিষয় হলেও শেষেরটির জন্য প্রশাসনিক নির্দেশনার পাশাপাশি শিক্ষককে আন্তরিক হতে হবে। অ্যাসাইনমেন্ট দিতে গিয়ে বা পরে মোবাইল ফোনে পাঠ বুঝিয়ে দিলে এসব শিক্ষার্থীর জন্য তা উপকার হবে। বিদ্যমান ঘাটতি পূরণে শিক্ষকরাই শেষ ভরসা।

শিক্ষায় আমাদের অনেক বড় বড় অর্জন রয়েছে। করোনার কারণে এসব অর্জন ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে দুটি অর্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো, ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যায় সমতা। অন্যটি প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ ভর্তির হার। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ঝরে পড়ার হারও বাড়তে পারে। প্রস্তুতির জায়গা থেকে শতভাগ ভর্তি ও ছেলেমেয়ের সমতা ধরে রাখার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। আরেকটি ঝুঁকি রয়েছে।

করোনার সময়ে খাদ্য ও আয় নিরাপত্তাহীনতার কারণে অপুষ্টির হারও বাড়বে। এমনিতেই নানা কারণে আমাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী অপুষ্টির শিকার। এ জন্য মিড-ডে মিল কর্মসূচিকেই সর্বজনীন করার ব্যবস্থা নেওয়াও প্রয়োজন। সব শেষে প্রাথমিকের এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের নিয়ে সংশ্লিষ্টদের আগামীর ভাবনা দ্রুতই প্রকাশ করা উচিত।

রিপন আহসান ঋতু: কথাসাহিত্যিক ও সংগঠক
[email protected]

 
Electronic Paper