ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পরিবার থেকেই সুন্দরের পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়

এনাম রাজু
🕐 ১১:৩৮ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৫, ২০২০

‘পরিবার হলো প্রকৃতির একটা সেরা শিল্পকর্ম’ বাক্যটি উচ্চারিত হয়েছে জর্জ সান্তায়ানার কণ্ঠে। সত্যি তাই, পরিবার হলো- এমন একটা নিরাপদ আশ্রয়, যেটা রূপকথার বাইরে আর কোথাও পাওয়া যাবে না। পরিবার আপনি জন্মসূত্রে পেতে পারেন, কর্মসূত্রে পেতে পারেন আবার বন্ধুসূত্রেও পেতে পারেন! শুধু আপনার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক থাকলেই আপনি তাকে নিজের পরিবারের অন্তর্গত মনে করবেন, এমনটা নয়। আত্মিক সম্পর্কটাই আসল। কিন্তু সকল সম্পর্ক ছাপিয়ে জন্মসূত্রে পাওয়া পরিবারই হচ্ছে একটি মানুষের প্রকৃত আয়না। যে আয়নায় একই সঙ্গে অনেকগুলো মানুষের অবয়ব মুখস্ত করে একটি মানুষ পূর্ণাঙ্গ জীবনে পা রাখে। অর্থাৎ একটি শিশু জন্মের পর মৃত্যু অবধি যে শিক্ষা পায় তা পরিবার থেকেই প্রভাবিত। এজন্য অনেক মনীষী বলে থাকেন, যে পরিবারের আচরণ যত সহজ ও সুন্দর হয় সেই পরিবারে নৈতিক জ্ঞানসমৃদ্ধ মানুষের জন্ম হয়। আসলে জন্ম কিভাবে হলো আর কোন পরিবারে হলো সেটা খুব বেশি পারিবারিক বন্ধন তৈরি ও সুসন্তান গঠনে মুখ্য নয়। মূল বিষয় হলো, সন্তানটি জন্মের পর পরিবারের মানুষের কাছ থেকে কি দেখছে। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জেমস বেডউইন বলেছেন, ‘বড়দের কথা শোনার ক্ষেত্রে শিশুরা খুব দক্ষ নয়, তবে বড়দের অনুসরণ করার ক্ষেত্রে তারা কখনো ব্যর্থ হয় না।’ তাই পরিবারকে অবশ্যই এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেটা অনুসরণ করে শিশু তার আগামীর পথকে সহজ ও সুন্দরভাবে গঠন করতে পারে।

অনেক সময় দেখা যায়, পরিবারে নানাবিধ জটিলতা সৃষ্টি হয়। পারিবারিক বন্ধনে ছেদ পড়ে। সন্তানের সামনেই বাবা-মা একে অপরের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করে। এই বিরুদ্ধচারণের ঘটনাগুলো খুব ছোট ছোট মনে হলেও সন্তানের ওপর তার প্রভাব স্থায়ীভাবেই হয়ে থাকে।

একটি সুন্দর সমাজ গঠনে এক একটি পরিবারের গুরুত্ব অসীম। সেজন্য অবশ্যই পরিবারকে কিছু বিধিনিষেধ মেনেই চলতে হবে। যাতে আগামী প্রজন্ম পরিবার থেকে মন্দ কিছু আয়ত্ব না করে। শিশুদের উপদেশ দিতে নেই। এমনকি কোনো মানুষকেই নয়। বরং উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে। পরিবারের সকল মন্দের দায়ভারও যেন শুধু নারীর ওপর না পড়ে। সেটাও খেয়াল রাখা জরুরি। কেননা পরিবারের সবচেয়ে ত্যাগী মানুষটি নারী। সে মা হোক, বোন হোক আর অন্য কেউ হোক। একটি পরিবার নৈতিকতাসম্পন্ন হলে, একটি সমাজের একাংশে সুন্দরের পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়। গ্রামে একটি প্রচলিত বাক্য ব্যবহার হয়Ñ কাঠ গুণে নাও, মা গুণে ছাও।

বাক্যটি শুনতে খুবই সাদামাটা মনে হলেও সমাজ ও সুসন্তান গঠনে মায়ের দায়িত্বের কথা খুব সহজে স্পষ্ট হয়। বলা চলে, একটি সুন্দর সমাজ ও সংসার গঠনে নারীর ভূমিকা বেশ শক্তিশালী ও কৌশলী শিক্ষকের মতোই। কৌশলী শব্দটি খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করতে বাধ্য হলাম এজন্য যে, পরিবারের প্রয়োজনে নারীকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নরূপে আবির্ভূত হতে হয়। এই একটি কারণেই বলা হয়, পরিবার থেকেই সুন্দরের পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়। কিন্তু সচরাচর দেখা যায় এই মানুষটিই পরিবারে সবচেয়ে অবহেলিত। তবুও নারীর ভূমিকা সর্বক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে। তাই হয়তো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,
“কোনোকালে একা হয়নিকো জয়ী,
পুরুষের তরবারী;
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়াছে
বিজয়লক্ষী নারী”
যাবতীয় প্রতিকূলতা পেরিয়ে যে নারীকে সবকিছু সামলিয়ে উঠতে হয়, তাকে কৌশলী শিক্ষক বলাই শ্রেয়। এজন্য পরিবারের সকলের উচিত নারীর গুরুত্ব অনুধাবন করা। যে পরিবারে নারীর কদর যত বেশি, সেই পরিবারে কলহ ও সহিংসতা ততই কম। পারিবারিক সহিংসতা মূলত নারীর প্রতি অবিচার, অনাচার ও অত্যাচার থেকেই শুরু হয়। ব্যতিক্রম যে হয় না, তা নয়। নবাগত বা পরিবারে নতুন নারীর আগমনেও পারিবারিক কলহ হতে পারে। কিন্তু সেসব বাদ দিয়ে আমাদের অবশ্যই নারীর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।

পারিবারিক মূল্যবোধ বলুন আর সামাজিক মূল্যবোধই বলুন, এসব থেকে মানুষ যে দূরে সরে যাচ্ছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা অনেক পুরনো কথাও বটে। শিশুর জন্মের পর থেকে পরিবার যে শিক্ষা দিয়ে থাকে বা যা দেখে দেখে শিশু বেড়ে ওঠে, তারই প্রতিচ্ছবি সমাজ পরবর্তীতে পেয়ে থাকে। তাই আপনি বা আমি সন্তানের অসদাচরণের জন্য সঙ্গদোষ বা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, খারাপ হয়েছে বলতে পারব না। মানবিক গুণাবলি তৈরিতে নিশ্চয়ই সৎ সঙ্গের প্রয়োজনীয়তা অতুলনীয়। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ‘ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে’। অর্থাৎ যে মানুষটি যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে তার সঙ্গীও সেই পরিবেশের হয়।

সর্বোপরি মনে করি, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বোঝানোর দায়িত্ব পরিবারের পাশাপাশি সমাজ তথা রাষ্ট্রেরও কম নয়। কেননা পরিবারের পরই ব্যক্তির সকল অপরাধের মূল নিরামক রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রের আইনি শক্তি যত সক্রিয় হবে, দ্রুততার সঙ্গে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসবে সেই দেশে অপরাধের মাত্রাও তত কম হবে। তাই রাষ্ট্রের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা খুবই জরুরি। রাষ্ট্রে সুশাসন থাকলে খুব দ্রুত সুন্দরের প্রভাব সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাই পরিবারের পাশাপাশি রাষ্ট্রকেও সচেতন হতে হবে। সকল স্তরে সুষ্ঠু আইনি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে বিদ্যালয়গুলোকেও খুব ব্যবসায়িক চিন্তায় না ভেবে পাঠ্যশিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। তবে সমাজ সুন্দর হবে, নদী পাবে ছুটে চলার স্বাধীনতা, পাখি পাবে অভয়ারণ্য। কেননা পৃথিবীর সবকিছুই সুন্দর পাবে বাঁচতে পারবে যদি মানুষগুলো সুন্দর হয়।

এনাম রাজু: কবি ও গল্পকার
[email protected]

 
Electronic Paper