ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বইয়ের ফেরিওয়ালা আতিফ

রেজাউল ইসলাম রেজা
🕐 ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২৪, ২০২০

ইন্টারনেটের বদৌলতে বিশ্ব যখন হাতের মুঠোয়, যখন তরুণসমাজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে মুখ লুকিয়ে রাখে গেমস কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, ঠিক তখনই জামালপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে এক সম্ভাবনাময় তরুণ তাকিয়ে থাকে তার নিজ হাতে গড়া পাঠাগারের দিকে। পাটশোলার বেড়া হয়তো প্রবল বাতাসে উড়ে যেতে পারে কিন্তু তার অদম্য ইচ্ছাকে কি কেউ দমাতে পারবে? বলছি জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের হাসড়া মাজালিয়া গ্রামে বসবাসরত আতিফ আজাদের কথা। অভাবি সংসারে সাত ভাই-বোনের মধ্যে আতিফ সবার ছোট। ছোটবেলা থেকেই আতিফকে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে অন্য ভাই-বোনদের মতো সংসারের হাল ধরতে হয়। নকশিকাঁথা থেকে শুরু করে দিনমজুরি, রঙ বার্নিশ, রাজমিস্ত্রি কিংবা রডমিস্ত্রি সকল কাজেই তার অভিজ্ঞতা রয়েছে।

টানাপোড়েনের সংসারে যেখানে খেয়ে-পরে টিকে থাকাই কঠিন, সেখানে পড়াশোনা বিলাসিতার নামান্তর। তবুুও আতিফের প্রবল ইচ্ছা, যে করেই হোক তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। দারিদ্র্যকে খুব কাছ থেকে দেখার কারণে আতিফ শুধু নিজের জন্যই ভাবেনি, বরং ছোটবেলায় বই, গাইডের অভাবে পড়তে না পারা, টাকার অভাবে শিক্ষকদের নিকট প্রাইভেট পড়তে না পারার দুঃখ সবসময় আতিফকে নাড়া দিত। তখন থেকেই আতিফের পাঠাগার তৈরির পরিকল্পনা মাথায় আসে। প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় আশপাশে এমন অনেকেই আছে যারা বইয়ের অভাবে পড়তে পারে না। আর টাকা দিয়ে বই কিনে পড়ার সামর্থ্যও নেই। ছেলেমেয়েরা অবসর সময় যাতে বিনামূল্যে বই পড়তে পারে, সেজন্য আতিফ ও তার বড় ভাই মিলনের সহযোগিতায় প্রথমে ২০টি বই দিয়ে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে একটি পাঠাগারের যাত্রা শুরু করে। ঘর ভাড়ার টাকা না থাকায়, নিজ ঘরের বারান্দায় পাটশোলা দিয়ে বেড়া দিয়ে কোনো রকম পাঠাগার স্থাপন করে, স্বপ্নের পথে হাঁটা শুরু করে আতিফ। তার এ অদম্য ইচ্ছার কাছে অবকাঠামো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বরং ঘরে রাখা পুরনো কাঠের টুকরো দিয়ে বাবার সহযোগিতায় বানিয়ে ফেলে বুক শেলফ। নানা রকমের বাধা-বিপত্তির মধ্যেও আতিফ তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছিল অনড়।

শুরুতে পাঠকদের কাছ থেকে পাঁচ-দশটা বই নিয়ে পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলেও, বর্তমানে আতিফের পাঠাগারের সদস্য সংখ্যা ১০০-এর বেশি। বইয়ের সংখ্যা ২ হাজারের বেশি। ছাত্র, শিক্ষক, চাকরিজীবী, প্রবাসী ও অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের সহযোগিতায় সময়ের অপেক্ষায় আতিফের পাঠাগার আজ অনেকটা পথ এগিয়েছে। সপ্তাহে ২/৩ দিন আতিফ নিজে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসে। তার পাঠাগারের জন্য কুরিয়ারে যদি কেউ বই পাঠায়, তাহলে তাকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে জেলা সদরে গিয়ে বই আনতে হয়। কারণ গাড়িতে করে যাওয়ার খরচ বহন করা তার পক্ষে সম্ভব না।

আড়াই বছরের এ যাত্রা আতিফের জন্য খুব একটা সুখকর ও মসৃণ ছিল না। নানান রকম বাধা বিপত্তিতে জর্জরিত হয়েও আতিফ কখনো ইচ্ছাশক্তির কাছে পরাজয় বরণ করেনি। শুরুতে পাঠাগার বানানোর জায়গা না থাকা, বই রাখার সংকট, ঠাট্টা, উপহাস, এ যুগে কেউ বই পড়ে, লেখাপড়া না করে যত সব অকাজ ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতামূলক মনোভাব আতিফকে দমাতে পারেনি। একটা সময় গ্রামে তাকে পাগল বলা হলেও আতিফ কিংবা তার পরিবার কখনো পিছপা হয়নি। বরং তার কর্মস্পৃহাকে আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বইপাগল আতিফকে এখন তার গ্রামে ‘বইয়ের ফেরিওয়ালা’ নামেই সবাই চেনেন। তবে আতিফের স্বপ্নের অংশীদার, তার প্রেরণা ছিল তার বড় ভাই রবিউল ইসলাম মিলন। পাঠাগার স্থাপনের এক মাস যেতে না যেতেই ২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে দুষ্কৃতকারীরা তার ভাইকে হত্যা করে।

ভাই হারানোর শোকে একটা সময় আতিফ পাগলের মতো হয়ে যায়। শত কষ্ট বুকে চেপে আতিফ তার ভাইকে খুঁজে তার পাঠাগারের মধ্যে। যে মানুষটিই সবসময় তাকে উৎসাহ দিত, তার কাজে সহযোগিতা করত, তাকে যে এভাবে জীবন দিতে হবে তা কে জানত। আতিফ মনে করে, তার ভাই এ পাঠাগারের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবে আজীবন। আর তার ভাইয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে পাঠাগারটির নাম দেওয়া হয় ‘মিলন স্মৃতি পাঠাগার’। তার ভাইকে এ পাঠাগারের মধ্যেই সে খুঁজে পায়।

আতিফ বর্তমানে জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞানে প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত। পড়াশোনা ও বিনামূল্যে বই পড়ানোর পাশাপাশি, সে বাউল গানও করে। একটা সময় সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পরেও রাত হলে গ্রামের মানুষজন সবাই একত্রিত হয়ে গান বাজনা করত। যুগের পরিক্রমায় গ্রামীণ সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্তির পথে। পুরনো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য আতিফ নিজেও বাউল গান করে। তার আশপাশের মানুষজন ও পাড়াপ্রতিবেশীদের নিয়ে গানের আসর বসায়। নিজে একাধারে গান লেখে, আবার সেই গান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গায়। তার ভাই মিলনের ইচ্ছা ছিল আতিফ বড় হয়ে সঙ্গীত শিল্পী হবে। কিন্তু ভাইয়ের মৃত্যুতে আতিফ অনেকটাই ভেঙে পড়ে। পরবর্তীকালে বইগুলো আঁকড়ে ধরেই সে বেঁচে আছে। ভাই মিলনকে যে রাতে হত্যা করা হয়, সে রাতেও আতিফ মঞ্চে গান গাইছিল, ওই রাতে যদি সে বাড়ি থাকত তাহলে হয়তো ভাইকে বাঁচাতে পারত বলেই তার বিশ^াস। এমন ভাবনা সবসময় তাকে তাড়া দেয়। নিজেকে তার বড় দোষী মনে হয়।

বাসা থেকে কলেজ দূরবর্তী হওয়ায়, প্রতিদিন অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় কলেজে। বৃদ্ধ বাবার একার পক্ষে পরিবারের সকলের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা কঠিন হওয়ায়, আতিফ নিজেই পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের কাজ করে সংসারের ব্যয় বহন করে। একদিকে নিজের পড়াশোনা, পাঠাগারের কাজ অন্যদিকে সংসারের খরচ, সব মিলিয়ে কষ্টের মধ্য দিয়েই জীবন পার করছে। করোনা মহামারীর মধ্যেও থেমে নেই তার পাঠাগারের কাজকর্ম। কলেজ বন্ধ থাকায়, বেশি সময় পাচ্ছে সে। তবে তার ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিল বইমেলা করার। যদিও ইতোমধ্যে তার নিজ উদ্যোগে ও অনেকের সহযোগিতায় এ বছরের শুরুর দিকে ১৭, ১৮, ১৯ জানুয়ারি অবশেষে বইমেলার সফল আয়োজন সম্পন্ন হয়। তার বইমেলায় অসংখ্য গুণী মানুষ আসে। তাকে তার কাজের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করে।

তবে এ সফলতার পেছনেও ছিল অজানা কিছু কথা। বইমেলা আয়োজন করতে প্রায় ৪০ হাজারের মতো টাকার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বইমেলার আগের দিনও তার হাতে ছিল মাত্র ৩ হাজার টাকা। কাউকে পাশে না পেয়ে দুইটা ছোট ভাইকে নিয়ে সে রাতে নিজেই গাছে গাছে ব্যানার আর মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুখে বলে প্রচারণা চালায়। বইমেলা চলাকালে তিন রাত পর্যন্ত মুখে খাবার দেওয়ার সাহস হয়নি তার। কোথা থেকে আসবে এত টাকা! এত কিছুর পরও আতিফ তার মনোবল হারাননি। কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাকে দমাতে পারেনি। বরং স্রষ্টা তার অদম্য ইচ্ছাকে আরও শক্তিশালী করে দিয়েছে। আতিফের মতে তার ইচ্ছাশক্তি আর আত্মবিশ্বাসই তাকে এত দূর নিয়ে এসেছে। তার স্বপ্ন ভবিষ্যতে তার পাঠাগার আরও বড় হবে, বিনামূল্যে বই পড়ার এই আন্দোলন ছড়িয়ে যাবে গ্রাম থেকে সারা দেশে। প্রত্যেকটি গ্রামেই একটি করে পাঠাগার গড়ে উঠুক, লক্ষ লক্ষ পাঠাগারে ভরে উঠুক আমাদের দেশ। জামালপুরের আতিফের মতো এদেশে জন্ম হোক হাজারো বইয়ের ফেরিওয়ালার।

রেজাউল ইসলাম রেজা: শিক্ষার্থী, কৃষি অনুষদ
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 
Electronic Paper