ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নদী যেন স্নেহ মমতার প্রতীক

লিটন ঘোষ জয়
🕐 ১২:২২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২১, ২০২০

বাংলাদেশ নদীপ্রধান দেশ। পদ্ম, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলি, ধলেশ্বর, মধুমতি, কপোতাক্ষ, তিতাস, গড়াই, চিত্রা, ফটকি, কুমার, নবগঙ্গাসহ তের শ’ নদী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আর এ নদী নিয়ে রচিত হয়েছে অজস্র গান, গল্প, ছড়া-কবিতা ও নাটিকা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যান তো নদী নিয়ে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ শিরোনামের উপন্যাস লিখে রীতিমতো বিখ্যাত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে... কবিতাটি পড়েনি এমন মানুষ কমই আছে! আমাদের জাতীয় সঙ্গীতেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নদীর কথা এভাবেই বলেছেন— ‘কী শোভা, কী ছায়া গো, কী ¯স্নেহ, কী মায়া গো— কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।’ তাই তো কবির ভাষায় বলতে হয়— ‘যখন যেমন মনে করি, তাই হতে পাই যদি, আমি তবে এক্ষনি হই, ইচ্ছামতি নদী।’ আবার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার দগ্ধ হৃদয়ের ব্যথা প্রকাশ করতে গিয়ে কর্ণফুলি নদীর নিকট বলেছে— ওগো ও কর্ণফুলী, উজাড় করিয়া দিনু তব জলে আমার অশ্রুগুলি। যে লোনা জলের সিন্ধু-সৈকতে নিতি তব আনাগোনা, আমার অশ্রু লাগিবে না সখি তার চেয়ে বেশি লোনা! তুমি শুধু জল করো টলমল; নাই তব প্রয়োজন, আমার দু’ফোঁটা অশ্রুজলের এ গোপন আবেদন।’

আর কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার নিজ গ্রাম সাগরদাঁড়ির কপোতাক্ষ নদকে নিয়ে স্মৃতি বিজড়িত শৈশবের নানা কথা তিনি ‘কপোতাক্ষ নদ’ শিরোনামের কবিতায় লিখেছেন— ‘লইছে যে তব নাম বঙ্গের সংগীতে। সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে! সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে; সতত (যেমতি লোক নেশার স্বপনে শোনে মায়া মন্ত্রধনি) তব কলকলে জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে! বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে, কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে? দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে।’

সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় লিখেছেন ‘তের শত নদী শুধায় আমাকে কোথা থেকে তুমি এলে?’ কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে— বাংলাদেশে ঠিক কত নদী আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান, বাংলাদেশ নদী কোথায় অতিক্রম করেছে এসব যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ এখনো মানুষের অজানা। সে যাই হোক, বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদী আজ প্রায় মৃত; অনেক নদীর নাম এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটি আজকাল লোকমুখে তেমন আর শোনা যায় না। অথচ একদিন এটা গর্বের সঙ্গে বলতে শুনতাম। আমরা ভাতের চেয়ে মাছই বেশি পরিমাণে খেতাম। আমাদের গোলাভরা ধান আর নদীভরা ছিল মাছ। এক সময় জেলে পরিবারগুলো পুঁটি মাছের তেল দিয়ে রান্না ও কুপি জ্বালানোর কাজ করতেন। সে সব দিন এখন কেবলই রূপকথার মতো! আজ মাছের তেল তো দূরের কথা। মাছ পাওয়াই দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে গেছে। যেসব মাছ আমরা অবহেলা করে খেতাম না এখন সেই সব মাছগুলোই অনেক চড়া দামে বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে। দিনে দিনে পুকুর নদী-নালা খাল-বিল ও হাওড়-বাঁওর ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক দেশি প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে! আর সে কারণেই ভালো নেই জেলে পরিবারগুলো। নানা দুঃখ ও দরিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে দিন যাপন করছেন জেলে পরিবারগুলো। জাল ফেললেই এখন আর ঝাঁকে ঝাঁকে পাওয়া যায় না মাছ।

তবুও এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন অনেক জেলে পরিবার। কেননা মৎস্যজীবী এসব মানুষের কাছে নদী-নালা খাল-বিল জীবনেরই একটি অংশ। কেননা নদী হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাণ; জীবন জীবিকার অন্যতম উৎস। নদীর সঙ্গে আমাদের আত্মার সম্পর্ক; জীবনের সম্পর্ক। আর নদী না ভালো থাকলে আমরাও কোনোভাবে ভালো থাকব না। কারণ আগেই বলেছি— বাংলাদেশ হচ্ছে নদীপ্রধান দেশ; নদীমাতৃক দেশ। ধানের দেশ, গানের দেশ; নদীর দেশ বাংলাদেশ। আর এটাই বাস্তবতা। কেননা নদী স্নেহ মমতার প্রতীক! আমাদের শৈশব কৈশোর ঘিরে থাকা একটি বিরাট অংশ। বহমান নদী যেন ঢেউয়ে ঢেউয়ে জানিয়ে দেয় আবহমান বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা। নদীর কাছে এলে কলকল জলতরঙ্গের গান মুহূর্তের মধ্যে মনে করিয়ে দেয় ছোটবেলার ডুবসাঁতার খেলার কথা। মনে পড়ে যায় মধ্য দুপুরে লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপির সেই সব দিনগুলোর কথা। সেই সোনালি স্মৃতি যেন অমলিন। যা কখনো ভোলা যায় না। নদীর জল স্পর্শ করলে মন যেন শীতল হয়ে যায়! নদীর বুকে নৌকায় করে ভেসে বেড়ানোর কোন তুলনা হয় না।

ছোটবেলায় স্কুল ফাঁকি দিয়ে বারবার নৌকায় এপাড় ওপাড় করেই সময় কেটে যেত। কত সকাল, বিকেলে বড়শি নিয়ে মাছ ধরতে বসে গেছি, নদী পাড়ে দাঁড়িয়ে ছড়া কেটেছি— আমার বাড়ির পথটি দিয়ে/ বয়ে চলে যে নদী/ নাম যে তার নবগঙ্গা/ চলে এসো দেখবে যদি।

একবার মাছ ধরার জন্য সূর্য ও রাজীবের সাথে নৌকা নিয়ে বহুদূর গিয়েছিলাম। আমরা এত দূর গিয়েছিলাম যে, ভয়ে আমার গা ছমছম করছিল। যদি নৌকা ডুবে যায়! আর যদি বাড়ি ফিরে আসতে না পারি! বর্ষার নদী তখন পানিতে থৈ থৈ করছে। তার উপর আমরা ছিলাম বেশ ছোট। যে কারণে ভয়টা ছিল আরও বেশি। আজ সেকথা ভাবতে গেলে ভয়ে গা ছমছম করে ওঠে। কী দুঃসাহসিক অভিযান!

একসময় আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নবগঙ্গা নদীর বুকজুড়ে কতই না দৃশ্য চোখে পড়েছে। অথচ আজ সেই নদী পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। আগের মতো এখন আর এসব নদী দিয়ে চলে না কোনো নৌযান। মাগুরার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলো হচ্ছে— নবগঙ্গা, ফটকি, কুমার, মধুমতি, গড়াই, চিত্রাসহ অন্যান্য যে নদী রয়েছে সেগুলো দিন দিন পরিণত হতে যাচ্ছে মরা নদীতে। আমাদের নবগঙ্গা নদীও পলি জমে গভীরতা ও নাব্য হ্রাস পেয়ে হারাতে বসেছে ঐতিহ্য। দুরন্ত যৌবনে চঞ্চলা এ নদী বর্ষায় দু’কূল ছেপে উঠত। মাঝি গলা ছেড়ে গাইত ভাটিয়ালী গান। সারি সারি চলত কত নৌযান। দল বেঁধে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। এসব যেন আজ কেবলই ইতিহাস। ইতিহাস হয়ে গেছে মৎস্যকুমারীর সঙ্গে গল্প বলা, শিশুদের লুকোচুরি খেলা। এখন আর নবগঙ্গার দু’পাড়ে নেই মাঝি কিংবা জেলেপাড়া। এ পাড়ায় বসবাস করত আমাদের প্রিয় দাদু নির্মল। যার কাছে ছোটবেলায় নদী নিয়ে শুনেছি অনেক গল্প। আজ দাদু নেই। আছে তার ফেলে যাওয়া মধুময় স্মৃতি। এখন আর নবগঙ্গা নদী পার হতে লাগে না কোনো খেয়া নৌকা।

শুকনো মৌসুমে পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায় এ সব নদী। আজকাল মাঝ নদীতে শ্যালো দিয়ে করা হয় ইরি ধান চাষ। এখন এ মরা নদীতে জেলেদের জালে ওঠে না টাকি, চাপলে, বালে, মাগুর, শিং, বাইম, কৈ, মলা-ঢেলা, টেংরা, পুঁটি, খয়রা ইত্যাদি মাছ। কারণ পলি জমে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। জেগে উঠেছে মাইলের পর মাইল ছোট-বড় অনেক চর। আর সেই চরে কৃষকরা বিভিন্ন রকম ফসলের আবাদ করছেন। দীর্ঘ বছর খনন ও সংস্কার না করার ফলে নদীগুলোর এমন অবস্থা হয়েছে। একই রকম অবস্থা বাংলাদেশের সব নদীগুলোর। অথচ কার সেদিকে খেয়াল নেই। মাঝে মধ্যে শুধু শোনা যায় নদীকে বাঁচাও আন্দোলন। তারপর কিছুদিন চলে আংশিক কার্যক্রম। কিন্তু নদী আর তার ঐতিহ্য ফিরে পায় না। তবে আমরাই এর জন্য দায়ী। আমরা যদি এখনো একটু সতর্ক হই পরিবেশ দূষণ না করি। নদীতে নোংরা আবর্জনা না ফেলি। তাহলে নদী আবার গাইবে তার জলতরঙ্গের গান। তা না হলে হয়ত একদিন বাংলাদেশে নদী বলে আর কিছু থাকবে না! চিরতরে হারিয়ে যাবে নদী নামের স্নেহ মমতার প্রতীক। চরম অসহায় হয়ে যাবে নদীকে ঘিরে জীবিকা নির্বাহ করা জেলে পরিবারগুলো। কেননা- পলি ভরাট হয়ে, শিল্প বর্জ্যের দুষণে এবং অবৈধ দখলের শিকার হয়ে বাংলাদেশের বহু নদীর অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে।

লিটন ঘোষ জয়: গীতিকবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
[email protected]

 
Electronic Paper