ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

উত্তর-রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন কবে

মো. জামাত খান
🕐 ৩:৪৫ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২০, ২০২০

রাজশাহীর ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সমাজব্যবস্থা, ধর্ম, লোকাচার, আবহাওয়া, প্রকৃতি, অর্থনীতি- সব কিছুতেই জড়িয়ে আছে পদ্মা। পদ্মার আশীর্বাদে রাজশাহীর উত্থান। হজরত শাহ মখদুমের মতো মহান পুরুষ রাজশাহীতে এসেছিলেন পদ্মা নদীর পথ ধরেই। তার মাজার (১৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ) পদ্মা নদীর তীর এখনো স্বমহিমায় মহিমান্বিত করে রেখেছে। ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে পর্তুগিজ, ইংরেজ, ওলন্দাজ, ফরাসি তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজশাহীতে আগমন ঘটেছিল পদ্মার নদীপথ দিয়ে। যার ফলে রাজশাহী আধুনিক হয়েছে, রাজশাহী রেশমের বিশ্বজুড়ে যে খ্যাতি ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীদের কারণেই। তাদের ব্যবসা ক্ষেত্রের অন্যতম নিদর্শন বড় কুঠি আজও পদ্মার তীরে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা জানি, রাজশাহী অঞ্চলের প্রশাসনিক শহর ছিল নাটোর। পদ্মার তীরে রাজশাহীর মনোরম স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও নদীপথে সহজ যোগাযোগের বিষয় বিবেচনা করে ১৮২৫ সালে রাজশাহী অঞ্চলের জেলা সদর রাজশাহীতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। এভাবে রাজশাহীর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করলে রাজশাহীর ওপর পদ্মা নদীর প্রভাব অনেক।

রাজশাহী উষর, লালমাটি-খ্যাত ইতিহাস প্রসিদ্ধ বরেন্দ্র ভূমির অন্তর্গত। বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-উপরিস্থিত পানির প্রাচুর্য নেই। তাই বরেন্দ্রের পূর্ব-পুরুষগণ অসংখ্য পুকুর, দীঘি খনন করে ভূ-উপরিস্থিত পানির অভাব দূর করার প্রয়াস নিয়েছিল। বরেন্দ্রের আবহাওয়া অস্বাভাবিক। খরার তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়, আবার শীতে ৪ ডিগ্রি নেমে আসে। বৃষ্টি কম। বনভূমি নাই। গাছপালার সংখ্যা কম। ধূ-ধূ অবারিত মাঠ। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে। ২০০-৩০০ ফুট নিচেই শক্ত পাথরের স্তর। সব কিছু মিলিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলের আবহাওয়া, পরিবেশ, প্রকৃতি একটু অস্বাভাবিক। বন্যামুক্ত বরেন্দ্র বছরে ৩টি ফসল উৎপন্ন করা সম্ভব হলেও সেচের অভাবে মাত্র একটি ফসল-আমন ধান হতো। এসব বিবেচনায় এনে বন্যামুক্ত বরেন্দ্র বছরে ২/৩টা ফসল ফলানোর জন্য সত্তর দশকে পদ্মার পানি দিয়ে সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি প্রকল্প হাতে নেয়। ভূ-উপরিস্থিত পানি দিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে জাপানের ঔঅওঈঅ প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ১৯৮৮ সালে প্রণয়ন করে। ঔঅওঈঅ তার প্রকল্প সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় পদ্মা থেকে পাম্পের সাহায্যে ৮০ ঘনমিটার/ সেকেন্ড (২৮২৫ কিউসেক) পদ্মার পানি উত্তোলন করে ৫২.৫০ কিলোমিটার প্রধান খাল ও ২৩৯ কিলোমিটার শাখা খালের মাধ্যমে আবাদযোগ্য ১,৩৩,৭০০ হেক্টর জমির মধ্যে ৭৪,৮০০ হেক্টর জমিতে সেচ ব্যবস্থার প্রস্তাবনা করে। প্রকল্পের সেচ ব্যবস্থাপনায় পবা, গোদাগাড়ী, তানোর চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গোমস্তাপুর, নাচোল, নিয়ামতপুর, পোরশা ও মান্দা মোট ৯টি উপজেলা অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবনা রয়েছে। 

এরপর থেকে উত্তর-রাজশাহী সেচ প্রকল্পটির ফাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড, পরিকল্পনা কমিশন, অর্থ-মন্ত্রণালয়সহ সরকারের নানা মন্ত্রণালয়ে চালাচালি হতে থাকে। বেশ কয়েকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে প্রকল্পটির রিভিউ করা হয়, প্রকল্প ব্যয় কম-বেশি করা হয়। সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা ও দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে বন্যামুক্ত কিন্তু মরু প্রক্রিয়াধীন বরেন্দ্রে সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ১৯৯২ সালে ‘বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ সৃষ্টি নলকূপ স্থাপন করে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। প্রকল্প এলাকার সেচযোগ্য জমির মাত্র ২৬ শতাংশ জমিতে বিএমডিএ সেচ করতে পারছে। বিপুল সংখ্যক গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে মরুপ্রক্রিয়াধীন বরেন্দ্রে প্রয়োজনীয় পুনঃভরণ না হওয়ার ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর নিচে নেমে যাচ্ছে। জমিতে রাসায়নিক দূষণ, পদার্থ, ব্যাপক আয়রন, আর্সেনিক দেখা দিচ্ছে। রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাড়ছে। বরেন্দ্রের রুক্ষ জমি আরও রুক্ষ হচ্ছে। পুকুর, খাল-বিল শুকিয়ে যাচ্ছে, টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। গাছ-পালার বৃদ্ধি কমছে, গাছের সবুজাভ রঙ লালচে হয়ে যাচ্ছে। ফলে মানুষ, পশুপাখির ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়তে আরম্ভ হয়েছে। মরুভূমির পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এ বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য উত্তর-রাজশাহী সেচ প্রকল্প আশু বাস্তবায়ন অতীব জরুরি। এ সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন লক্ষ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড গোদাগাড়ীতে বছর চার পূর্বে জনসাধারণের মধ্যে মতবিনিময় সভা করে। উপস্থিত জনগণ এক বাক্যে উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের পক্ষে মত প্রকাশ করে। তার পরেও প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ উত্তর-রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবিতে মানববন্ধন, সমাবেশ, আলোচনা সভা, সেমিনার, মিছিল, এমনকি সফল হরতালও পালন করে। রাজশাহীর আপামর জনগণ পদ্মা থেকে পানি উত্তোলন করে উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প আশু বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে আসছে। সর্বশেষ ১ মে ২০০৮ তারিখে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী, বিএমডিএর ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলী, রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়সমূহের পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক, স্থানীয় বিশেষজ্ঞ, এনজিও ব্যক্তিত্ব, ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা, বরেন্দ্র অঞ্চলের ভুক্তভোগীদের সমন্বয়ে এক সেমিনার আয়োজন করে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, রাজশাহী। উক্ত সেমিনারে বক্তাগণ পদ্মার ভূ-উপরিস্থিত পানি ব্যবহারে উত্তর রাজশাহী সেচব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। বক্তাগণ বলেন, গঙ্গার পানি চুক্তির ফলে সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার কিউসেক প্রাপ্ত পানির মধ্যে কুষ্টিয়া-যশোরের জি. কে. প্রজেক্টে মাত্র ৭,০০০ কিউসেক পানি ব্যবহার হয়। আর কোথাও পদ্মার পানি ব্যবহার হয় না। বাকি গঙ্গার পানি বঙ্গোপসাগরে মিশে যাচ্ছে।

এমতাবস্থায়, উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্পে ২৮২৫ কিউসেক পানি ব্যবহার করলে প্রকল্পের পানির অভাব হবে না। সেমিনারে বিশেষজ্ঞগণ উদ্বেগ প্রকাশ করেন, চুক্তি মোতাবেক প্রাপ্ত পানি বাংলাদেশ যথোপযুক্ত ব্যবহার করতে না পারলে পরবর্তী সময়ে ভারত পানি প্রদানে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। সেমিনারে উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নে বরেন্দ্রের উপকারিতা হিসাবে উল্লিখিত হয় ভূ-উপরিস্থিত পানি ব্যবহারে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন হ্রাস পাবে, ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক হয়ে আসবে। মরু প্রক্রিয়ার উদ্বেগ কেটে যাবে। জমিতে রাসায়নিক দূষণ, আয়রণ, আর্সেনিক ও পরিবেশের অবক্ষয় আশঙ্কা থাকবে না। সারের ব্যবহার কমে যাবে।

৭৪,৮৫০ হেক্টর জমিতে ৩টি ফসল প্রাপ্তি নিশ্চিত করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়ে বেকার সমস্যা কমবে। রুক্ষ বরেন্দ্র অঞ্চলে জলীয় বাষ্পের প্রভাবে আবহাওয়া শীতল থাকবে। ব্যাপকভাবে গরু, ছাগল, মুরগি, মাছ চাষ বৃদ্ধি পাবে। রুক্ষ বরেন্দ্র সবুজ হয়ে উঠবে। বরেন্দ্রের মানুষ গভীর নলকূপের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে ভূ-উপরিস্থিত পদ্মার পানি দিয়ে সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখতে চায়। কিন্তু রাজশাহীবাসীর পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণে ব্যক্তি, সংগঠন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে এখন পর্যন্ত রাজশাহীর আশা আকাক্সক্ষা পূরণে কাউকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। আমরা উত্তরাঞ্চলের গণমানুষ বর্তমান সরকারের দিকে উত্তর-রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের আশা নিয়ে অধীর অপেক্ষায় আছি।

দেশের উত্তরবঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে তীব্র শীতে মানুষ যেমন কষ্ট পায়, ঠিক তেমনি খরার সময়ে তীব্র উষ্ণতা অনুভূত হয়। আবার বর্ষা-বন্যায় ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়ে আর্থিকভাবে ও মানসিকভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ঠিক তেমনিভাবে বসতবাড়ি ও ফসলি জমি, আমবাগানসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে এ অঞ্চলের মানুষ সর্বস্বান্ত হয়। এ সমস্যা আর কতকাল দেখবে মানুষ? এ সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও রাজশাহীসহ ৩ জেলার জনপ্রতিনিধি, রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, নাট্যকর্মী, সমাজসেবক, জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, সাংবাদিক, নারী সংগঠক, ছাত্র, যুবক, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনসহ আপামর জনগণ, দেশের রাজধানী ঢাকাস্থ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে উপস্থিত হয়ে উত্তর-রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নসহ এ অঞ্চলের সকল সমস্যা সমাধানের জন্য বিশাল এক মানববন্ধন ও সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে। এরপর বিভিন্ন উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত গণসংযোগ, সভা-সমাবেশও করেছেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রয়াত মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, সাবেক মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন, সাবেক মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন, সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এ. কে. খোন্দকারসহ জাতীয় পর্যায়ের সরকারি ও বিরোধী দলের সকলের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শুধু মানুষ দেখানোই আশ্বাস আমলাতান্ত্রিক জটিলতা শেষে সম্ভাবনাময় উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে কি! আলোর মুখ কেউ দেখাবেন কি?

মো. জামাত খান : সাধারণ সম্পাদক
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ, রাজশাহী

 
Electronic Paper