কার্তিক মাস যেন অভিশাপ!
রনি সরকার
🕐 ৩:৪২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২০, ২০২০
উত্তরবঙ্গকে একসময় মানুষ চিনত মঙ্গাপীড়িত এলাকা হিসেবে। কুড়িগ্রাম, রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও গাইবান্ধা- পাঁচটি জেলার সঙ্গে মঙ্গা শব্দটি ছিল একেবারে পরিপূরক। আশ্বিন-কার্তিকে ওইসব অঞ্চলে কোনো ধরনের কাজ থাকত না। আবার বন্যাকবলিত এলাকা হওয়ায় আমন সেচের ওপর প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ তেমন নির্ভরও করতে পারে না।
ফলে, একেবারে বন্ধ হয়ে যায় পরিবারের আয়-রোজগার। মানুষকে না খেয়ে থাকতে হয় দিনের পর দিন। করোনাভাইরাসের প্রভাব এখনো বিস্তার করায় আমরা দ্রুত অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হচ্ছি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক মহামন্দা-পরবর্তী বিশ্বে এ প্রথম আবারও আমরা আরেকটি মহামন্দার সম্মুখীন হতে যাচ্ছি। শুধু বাংলাদেশ পরিমণ্ডলে নয়, বহির্বিশ্বকে সামনে অত্যন্ত কঠিন এক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তবে সৌভাগ্যের বিষয়, উত্তরাঞ্চলকে বলা হয় বাংলাদেশের শস্যভাণ্ডার। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের খাদ্যের জোগান হয় উত্তরাঞ্চলের ভূমি থেকে। একটা সময় এ অঞ্চলের কৃষিনির্ভর ও ভূমিকেন্দ্রিক মানুষের শস্যের কিংবা কর্মের বিকল্পের বড় অভাব ছিল।
কর্মের বিকল্পের অভাব এখনো বর্তমান কিন্তু শস্যের বিকল্প ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে, বিভিন্ন মৌসুমে উৎপাদনশীল শস্যের আবিষ্কারের কারণে কৃষিনির্ভর মানুষ কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের এ সময়ে অনেক শ্রমজীবী মানুষ বাড়িতে বেকার হয়ে বসে আছেন। তেমনি প্রবাসী শ্রমিকরাও দেশে ফেরত আসছেন পর্যাপ্ত কর্মের অভাবে। তাই এখন শুধু কৃষির ওপর নির্ভর করা ছাড়া গ্রামবাংলার মানুষের বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে পুনঃপুন ভয়াবহ বন্যার বলয়গ্রাসে আমন খেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
নিম্নাঞ্চলের অনেক আবাদি জমি পড়ে আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবছর ভরা কার্তিকেও ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছে যার কারণে, শীতকালীন সবজি চাষে মানুষ হোঁচট খাচ্ছে। আবার অল্প কিছু অঞ্চলে শীতকালীন সবজি চাষ হয়েছে। যার ফলে এখন শীতের মৌসুমে বাজার ভরা শীতের সবজি থাকার কথা থাকলেও তা দেখা যাচ্ছে না। তাই এখন শীতকালীন সবজি অত্যন্ত চড়া দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। একদিকে মানুষের যেমন আয়-রোজগার কমে গেছে, অন্যদিকে বাজারে নিত্যপণ্যের দামও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কার্তিক মাসেও কাজের অভাবে কৃষি শ্রমিক কিংবা কৃষিজীবী মানুষরা সম্পূর্ণ বেকার হয়ে বসে আছে। এভাবে তাদের ঘরে সঞ্চিত খাদ্য শেষ হয়ে এলে তারা মহাজন, জোতদার কিংবা সুদ ব্যবসায়ীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াবে নগদ অর্থের জন্য। আর একবার মহাজন, জোতদার বা সুদ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ করলে দীর্ঘসময় ধরে শারীরিক শ্রম বা ফসলের ভাগ দিয়ে তাদের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ফলে এ কৃষিনির্ভর দরিদ্র মানুষরা ক্রমাগত দুর্বিষহ অবস্থায় পতিত হবে। উত্তরাঞ্চলের এ নীরব দুর্ভিক্ষই হচ্ছে মঙ্গা।
এখন ফসলের বেশ কিছু বিকল্প কিংবা বছরের বিভিন্ন সময়ে উৎপাদনশীল শস্য থাকার কারণে সারা বছর তারা কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত থাকে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, মঙ্গা না থাকলেও উত্তরাঞ্চলের এসব কৃষিজীবী মানুষ দিনের পর দিন বা মাসের পর মাস উৎপাদনের পেছনে যে শ্রম দিচ্ছে, সে তুলনায় তাদের অর্থনৈতিক জীবন কতটা সচ্ছল হয়েছে? অথবা মঙ্গা থেকে উত্তরণের পর কি তাদের জীবনে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে? উত্তর- না, হয়নি। বরং আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন থেকে শুরু করে মৌলিক চাহিদাগুলোও পূরণ হয়নি কখনো। বর্ষায় উত্তরের জনপদ পানিতে ডুবে থাকে, বন্যা নিয়ে যায় সর্বস্ব, শীতের রাতে ঠাণ্ডায় কাতরায়। এসব কষ্ট এখন উত্তরের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। কার্তিক মাসে গ্রামবাংলার মানুষ যেমন খাদ্যকষ্টে ভোগে তদ্রুপ গবাদি পশুরও চরম খাদ্য সংকট দেখা দেয়। বিশেষত, গ্রামাঞ্চলে এই কার্তিক মাসে রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর আইএমএফের ভাষ্যের চরম প্রতিফলন ঘটতে চলছে।
সেই সঙ্গে লক্ষণীয়, বঙ্গবন্ধু সেতু উত্তরাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে খুবই গুরুত্ববহ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হয়েছিল। সেতু চালুর পর তাদের অর্থনৈতিক জীবনে পরিবর্তনও কিছুটা এসেছে। তবে এর পুরো সুফল উত্তরাঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পাচ্ছে না। আগে যেখানে তাদের উৎপাদিত শস্য ও সবজির বেশিরভাগ ক্রেতা ছিল শুধু উত্তরাঞ্চলের মানুষই, এখন সেখানে তাদের উৎপাদিত শস্য ও সবজির ক্রেতা পুরো দেশের মানুষ। সেতু চালু হওয়ায় এখন উত্তরাঞ্চলের মানুষ অনায়াসে ঢাকায় বিভিন্ন কাজে যাচ্ছে। অতি সহজে তাদের উৎপাদিত ফসল ঢাকায় বিক্রি করছে, পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত হয়ে যাচ্ছে। সড়কপথের উন্নয়ন শুধু রাজধানীর সঙ্গেই মঙ্গা এলাকার মানুষের যোগাযোগ বাড়ায়নি বরং এসব এলাকার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগও বেড়েছে। মঙ্গা নিরসনে সড়ক যোগাযোগ বাড়াতে সরকারের কৌশল ছিল পল্লী সড়ক এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন। সড়ক ও সেতু বিভাগে উন্নয়নের পরও উত্তরাঞ্চলের মানুষের কাছে রংপুর-ঢাকা অনেকদূর! তাই নিজেদের উৎপাদিত শস্যগুলো স্বল্পমূল্যে স্থানীয় বাজারে পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে।
ফলে তারা শস্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। কিন্তু তথাকথিত পাইকাররা এসব শস্য ঢাকায় নিয়ে এসে চড়া মূল্যে বিক্রি করে নিজেরাই ফায়দা লুটছে। এসবের পরেও উত্তরাঞ্চলের মানুষ দিনের পর দিন হাড়ভাঙা খাটুনি করে চলছে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শস্যাদি উৎপাদন করছে। কিন্তু ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেনি। আমরা জোর গলায় এখন বলিÑ মঙ্গার দিন শেষ। কিন্তু বজ্রকণ্ঠে বলতে পারি না দৈন্যদশা ঘুচেছে। জোর গলায় বলতে পারি না তারা অর্থনৈতিক সচ্ছলতা অর্জন করেছে! পারতপক্ষে এটাও বলতে পারি না, তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হয়েছে। সুতরাং, এ মরা কার্তিক যেন বারবার গ্রামবাংলার অভিশাপ হয়ে না দাঁড়ায় সেজন্য এখনই অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। তন্মধ্যে, বাংলাদেশে এ বছর করোনাকালে বন্যা, এ যেন মড়ার উপর দেশে খাঁড়ার ঘা। বিশেষ করে, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিলেট, জামালপুর জেলায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছিল। তবে এই পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশেই না বরং করোনাকালে সারা পৃথিবীতে দুর্যোগ লেগেই আছে। উত্তরাঞ্চলের এসব জেলা বন্যাকবলিত হওয়ায় প্রতিবছর বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও সঠিক বাস্তবায়ন দরকার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নদীগুলোর নাব্য বাড়ানো। নদীর গতিপথ পরিষ্কারের জন্য উন্নত প্রযুক্তিতে ড্রেজিং করে নদীর গতিপথে জমে থাকা পলি অপসারণ করে নদীর নাব্য ও পানির ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা দরকার। নদীর নাব্য বাড়ানো কোথায় হবে ও কীভাবে হবে তা সঠিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে করতে হবে।
রনি সরকার : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর