ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাল্যবিয়ে, যৌতুক ও নারীর ক্ষমতায়ন

অলোক আচার্য
🕐 ১২:৫৭ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৯, ২০২০

দেশ হিসেবে আজ আমাদের বহু অর্জন। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে আমরা আজ রোল মডেল। এতসব অর্জনের মাঝেও কিছু খবর ভাবতে বাধ্য করে। টাঙ্গাইলের অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোরীর বাল্যবিয়ের বলি হওয়ার মতো খবর বিবেকের যাত্রাকে স্তব্ধ করে দেয়। যখন নারীরা সমানতালে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সামিল হচ্ছে তখন বাল্যবিয়ে আমাদের অভিশাপ হয়ে ঘাড়ে চেপে বসেছে। কোনোভাবেই এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। আর সেই কিশোরীর মতো পরিণতি না হলেও বাল্যবিয়ের ফলে এক কিশোরীর স্বপ্নের যে মৃত্যু ঘটে তাও তো মৃত্যুই। আধুনিক সভ্যতার অগ্রযাত্রায় নারীর অবদান অনস্বীকার্য। আর এ অগ্রযাত্রায় এখন প্রধান বাধা হলো বাধ্যবিয়ের মতো বাধা। যার জন্য সেই হতভাগ্য কিশোরীর পরিবার দায়ী থাকে। মাঝে মধ্যেই পত্রিকায় বাল্যবিয়ের অপরাধে শাস্তিও হচ্ছে। কিন্তু সামাজিক সচেতনতা গড়ে না ওঠার দরুণ তা রোধ করা যাচ্ছে না। আজও সেই একই মানসিকতা রয়েছে বহু পরিবারে। মেয়েকে যত দ্রুত বিয়ে দেওয়া যায় ততই মঙ্গল! এ ধরনের আদি মনমানসিকতা থেকে আমরা আজও অনেকেই বের হতে পারিনি। সেই চেষ্টাও করছি না। আবার মহামারীর সময় বাল্যবিয়ের হার বেড়েছে। এটা কেবল আমাদের দেশের চিত্র নয়।

সম্প্রতি সেভ দ্য চিলড্রেনের এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস আগামী পাঁচ বছরে বিশ^ব্যাপী অতিরিক্ত ২৫ লাখ কিশোরীকে বাল্যবিয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। মহামারীর কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় এবং দরিদ্র পরিবারগুলো আরও দরিদ্র হয়ে পড়ায় বাল্যবিয়ের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে পারে। বাল্যবিয়েও আসলে এক ধরনের ক্যান্সার। যা সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। এসবের মধ্যে কিছু সাহসী কিশোরী নিজেদের বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। পাশাপাশি সমাজের আরও অনেক বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে। কিন্তু ক’জন কিশোরীর এত সাহস হতে পারে? তাও আবার এই সমাজে। প্রতিরোধ গড়া সত্যিই খুব কঠিন একটা বিষয়। ঝালকাঠির মেয়ে শারমিন আক্তারের সাহসিকতার কথাও আমরা জেনেছি। ২০১৫ সালে নিজের বিয়ে ঠেকিয়ে দিয়ে দেশ-বিদেশে উদাহরণ সৃষ্টি করে। যুক্তরাষ্ট্রের সাহসী নারী সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন। আবার দোলা আক্তার নামে এক সাহসী কিশোরীর কথাও আমরা জানি। এ দোলা, শারমিনের মতো সাহসী মেয়ে এদেশের প্রতিটি গ্রামে, ইউনিয়নে থাকা প্রয়োজন। তাদের ভিতরে এ বিশ^াস আনা প্রয়োজন যে তারা নিজেরাই বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। কেউ তাদের জোর করে ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পারে না। আমরা একজন শিশুর কাছ থেকে তার শৈশব, একজন কিশোরীর কাছ থেকে তার কৈশোর কেড়ে নিচ্ছি। তাকে মুক্ত পরিবেশে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ দিচ্ছি না। তার আগেই তার ওপর সংসার নামের এক গুরু দায়িত্ব চাপিয়ে তাকে ভারে ন্যুব্জ করে দিচ্ছি।

প্রকৃতপক্ষে সেই প্রাচীনকালে ‘কন্যাদায়’ বলে যে শব্দ প্রচলিত ছিল এখনো অনেক অভিভাবক সেই কন্যাকে আশীর্বাদ হিসেবে না চিন্তা করে দায় হিসেবেই গ্রহণ করছে। ফলে সেই কন্যাদায় থেকে মুক্ত হতে আইনের তোয়াক্কা না করে, নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে নিজেকে দায় থেকে মুক্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। আর তখনি সর্বনাশ ঘটে। যদিও বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার কমছে কিন্তু আমাদের লক্ষ্য বাল্যবিয়েমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) গৃহীত হওয়ার সময় বাংলাদেশসহ বিশে^র ১৯০টিরও বেশি দেশ বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী আর অর্ধেক তার নর। নারীর মেধা এবং পারদর্শিতার স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করা ব্যক্তির এ সমাজে অভাব নেই। বাল্যবিয়ে নামক ব্যাধি গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে আছে। জেএসসি পরীক্ষার সময় দেখা যায় পত্রিকায় অনুপস্থিত মেয়েদের বেশিরভাগই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এমনকি পিইসি পরীক্ষায় অনুপস্থিত অনেকে মেয়ের ক্ষেত্রেও ভাগ্যের এই নির্মম পরিহাসটি ঘটে। যেখানে একজন ছেলেসন্তানের পরিবার থেকে লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হয় লেখাপড়া করে চাকরি করা। সেখানে মেয়ের ক্ষেত্রে ঠিক বিপরীত। স্বামী-সন্তান নিয়ে যত তাড়াতাড়ি ঘর কন্যার কাজে লেগে পড়া যায় ততই মঙ্গল! এটাই বিপরীত চিত্র।

এবং আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিত্য ঘটনা। কিন্তু উন্নয়ন করতে হলে এসব অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে। আবার বিয়ের পর যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হওয়ার চিত্রও প্রায়ই দেখা যায়। যদিও এসব অপরাধ প্রতিরোধে আইন আছে এবং অনেকের ক্ষেত্রে শাস্তির ঘটনাও ঘটছে কিন্তু সমস্যা কমছে না। আমরা চাই সমাজে প্রতিটি ক্ষেত্রই নারীদের চলাচল এবং বসবাসের জন্য হবে নির্বিঘ্ন। যার নিশ্চিত পরিবেশ আমাদেরই সৃষ্টি করতে হবে। একটা শিশুর শৈশব নষ্ট করে তার ওপর সংসার চাপিয়ে দেওয়া হয় যা তার জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে তা একটি বড় অপরাধ। অনেক সময় সবার অগোচরেই বিয়ের কাজটি সমাধা হয়ে যাচ্ছে। বাল্যবিয়ে আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। ফলে এর লাগাম টেনে ধরতেই হবে।

নারীর মেধা এবং পারদর্শিতার স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করা ব্যক্তির এ সমাজে অভাব নেই। অধিকার ফলানোতেই যেন তাদের আনন্দ সীমাবদ্ধ। নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে আমাদের আরও সুদৃঢ় হতে হবে। অথচ কেবল বাল্যবিয়ে নয় যৌতুক, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নিগ্রহ, পরিবারে অনিশ্চয়তা সবকিছু মিলিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রই যেন নারীদের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। পরিবার এবং পরিবারের বাইরে নারীর নিরাপত্তা যেন কোথাও নেই। যৌতুকের আগুনে আজও আমাদের সমাজে বহু নারীর জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শহর বা গ্রাম, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত সব প্রকারের পরিবারেই যৌতুক নামের একটি কাঁটা রয়েছে। মূলত বাল্যবিয়ে এবং যৌতুক নামক এক ভয়ঙ্কর প্রাচীন কিন্তু আধুনিক জীবনের আদিমতা থেকে আজও এ বিশ^ বের হতে পারেনি। কারণ কেবল বাংলাদেশ নয় ভারত, পাকিস্তানসহ অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের প্রধান বাধা এ বাল্যবিবাহ এবং যৌতুক প্রথা।
কিছু অমানুষের বর্বরতায় কলুষিত হচ্ছে সমাজ জাতি দেশ। ধর্ষণ নামক এক নোংরা মানসিকতায় সমাজের কিছু মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে। তারা ধর্ষণ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। সেখানে কোনো মায়া নেই, মানবিকতা নেই। তিন বছর থেকে শুরু করে সব বয়সী নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এটা এমনভাবে বেড়ে চলেছে যে প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই কয়েকটি করে ধর্ষণের খবর মিলছে। এটা তো গেল পত্রিকায় যা আসছে তার কথা। তার বাইরেও তো নারীদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। যেগুলো অনেক সময় লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যাচ্ছে। সেসব যোগ করলে অনেকটা ভয়ঙ্কর শোনায়। প্রতিদিন প্রতি মাস এমনকি প্রতিবছর এ সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ধিক্কার উঠছে তাদের ঘিরে তবে সেই সব নপুংসকদের মানসিকতায় পরিবর্তন ঘটানো যাচ্ছে না। তাদের কর্ণকুহরে আমাদের ঘৃণার বাণী পৌঁছানো যাচ্ছে না। তাদের মনে ঘৃণ্য দরজায় শুধু অন্ধকার। নপুংসকদের কামনার আগুনে দাউদাউ করে জ¦লছে বিবেকপূর্ণ সমাজ। নিরাপদ করতে চেয়েও পারছি না।

বাসযোগ্য করতে গিয়ে বারবার এসব বোধহীন, রুচিহীন মানুষ মুখোশ খুলে বেরিয়ে আসছে। জানি না আর কত দূর সে পথ যেখানে কেবল সভ্য সমাজের সভ্য মানুষরাই থাকবে কঠোর আইন রয়েছে, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা জোরদার হয়েছে তবুও যেন এই ধরনের বিকৃত মানুষদের হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না নারীদের। বারবার বিবেকের দংশনে দগ্ধ হতে হচ্ছে আমাদের। তবে আমরাও হেরে যাব না। একদিন না একদিন এ পৃথিবী নারী পুরুষ সবার জন্য সমান সুযোগ সুবিধা দিয়ে বাসযোগ্য করে যাব। আমরা ততদিন প্রতিবাদ করে যাব যতদিন পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে নারীর ওপর নির্যাতন বন্ধ না হয়। নারীর ওপর নির্যাতন করার আগে ভাবতে হবে নারীর প্রতি আমার দায়িত্ব নির্যাতন নয় বরং অধিকার নিশ্চিত করা। পেশিশক্তির যুগে নারীর ওপর পেশিশক্তি দেখানোর ভিতর কোনো বীরত্ব নেই।

দয়া নয়, অধিকারের দৃষ্টিতে দেখার অভ্যাস করতে হবে নারীদের। সেই অভ্যাসটা পরিবার থেকেই সৃষ্টি করতে হবে। পরিবারেই যদি মেয়েদের নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় বা কোনো পুরুষ সদস্যের সঙ্গে তুলনায় খাটো করা হয় তাহলে সমাজেও তার প্রভাব পরে। বাসে, অফিসে, রাস্তায় সবসময় যদি নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং তাদের নিরাপত্তা পেতে আলাদা কোনো সাহায্য প্রয়োজন হবে ততদিন পার্থক্য সুস্পষ্ট থেকে যাবে। আমরা চাই সমাজে প্রতিটি ক্ষেত্রই নারীদের চলাচল এবং বসবাসের জন্য হবে নির্বিঘ্ন। যার নিশ্চিত পরিবেশ আমাদেরই সৃষ্টি করতে হবে। বাল্যবিয়ে, যৌতুক নামক কুপ্রথা, ধর্ষণ, নির্যাতন এসব আসলে কেবল নারীদের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে না বরং পুরো জাতিকেই পিছিয়ে দিচ্ছে। আমরা পিছিয়ে পড়ছি অর্থাৎ অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের মেয়েরা শিক্ষায় এগিয়ে চলেছে, চাকরিসহ সব ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে তারপরও কেন এসব আমাদের দেখতে হবে? নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে এসব ক্যান্সারের মোকাবিলা করতে হবে। সমাজের যে ক্ষত আজ দৃশ্যমান তা নিবারণ করতে হবে। একটি সুস্থ সমাজ উপহার দিতে হলে নারী-পুরুষ সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। আর তাহলেই কেবল স্বপ্নের বাংলাদেশ গঠনে আমরা সফল হতে পারব।

অলোক আচার্য: কলাম লেখক, পাবনা
[email protected]

 
Electronic Paper