‘নতুন স্বাভাবিকে’ দর্শনের ‘নব্য চর্চা’
জিনান বিনতে জামান
🕐 ১২:৩০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৯, ২০২০
২০২০ সাল, মহামারী করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী বদলে যাওয়া বিশ্বের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব সময়ের নাম। মূলত এ বছর আমরা সমগ্র বিশ্ববাসী এমন এক জীবনযাপন করছি যা একই সঙ্গে স্থবির ও অস্থির-উভয়ই। অদৃশ্য এক অণুজীবের কাছ থেকে বাঁচার জন্য আপ্রাণ এক সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে গোটা বিশ্ববাসী। এ অবস্থায় আমরা নতুন এক জীবন প্রক্রিয়ায় ধাবিত হয়েছি, যাকে বলা হচ্ছে ‘নতুন স্বাভাবিক’ বা New Normal. নব্য স্বাভাবিক এ বিশ্বের বরাবরের মতোই নভেম্বরের তৃতীয় বৃহস্পতিবার এবার কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে পালিত হচ্ছে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘বিশ্বদর্শন দিবস’। বদলে যাওয়া বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ‘নতুনভাবে দর্শনের অনুশীলন’ (New Philosophical Practices-NPP)-কে উপজীব্য করে এ বছর দিনটি পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আজকের দিনে প্রলয়ঙ্করী কোভিড-১৯ এমন এক স্থবিরতায় সারা বিশ্বকে আবদ্ধ করেছে, যেখানে আমরা পাশের বাড়িতে থাকা পড়শি বা স্বজন থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মরক্ষা করেছি, করেও যাচ্ছি। সারা দুনিয়ার সঙ্গে কার্যত এ বিচ্ছিন্নতা আমাদের বাধ্য করেছে নতুন করে সবকিছু নিয়ে ভাবতে। মানুষের মূল্য, সম্পদের ব্যবহার, মানবিক সম্পর্কের জটিলতা, প্রযুক্তির উৎকর্ষ, জনস্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক সংকট, প্রকৃতির বৈচিত্র্য— এসব বিষয় ভাবনার জগতে নতুনত্ব যোগ করে তুলেছে কৌতূহলী। আর যেখানেই মানব কৌতূহল সেখান থেকেই জন্ম দর্শনের। তাই আজকের ভাবনাগুলোর সঙ্গে দর্শনের এক নিবিড় সম্পর্কও আমরা লক্ষ্য করি।
২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘ যখন প্রশাসনিকভাবে বিশ্বদর্শন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন থেকেই সমসাময়িক বিষয়ে দার্শনিক ভাবনা তথা নতুন নতুন চিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়া শুরু হয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবে এবছরও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় দর্শনের তত্ত্বসমূহের প্রয়োগ ও কার্যকারিতার পাশাপাশি নতুন দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রও জ্ঞানের জগৎকে আন্দোলিত করে তুলেছে। দর্শন আলোচনার গোড়ার দিকে একে শুধু বিমূর্ত চিন্তার জ্ঞান হিসেবেই মনে করার একটি প্রবণতা দেখা যায়। যে কারণে সাধারণ মানুষের মাঝে দর্শন নিয়ে এক দুর্বোধ্যতার ধারণা ছিল। তবে দর্শনের শাখা হিসেবে নীতিবিদ্যার আলোচনা দর্শনকে সাধারণ মানুষের বোধগম্য ও জীবনঘনিষ্ঠ করে তুলেছে ক্রমান্বয়ে। দর্শনের সূতিকাগার খ্যাত প্রাচীন গ্রীসের পণ্ডিত সক্রেটিস বা প্লেটো থেকে শুরু করে অতি সাম্প্রতিককালের দার্শনিক আর চিন্তাবিদরাও মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে দার্শনিক বা নৈতিক তত্ত্বসমূহের প্রয়োগের মাধ্যমে একে প্রকৃত অর্থবহ করার প্রয়াস পেয়েছেন। সে ধারাবাহিকতায় বর্তমান প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে যেসব প্রাকৃতিক বা মানবিক সংকটের উদ্ভব হয়েছে বা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সেসবের দার্শনিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের এক তাগিদ দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জনস্বাস্থ্য ইস্যুতে নৈতিক তত্ত্বের প্রয়োগ সাম্প্রতিক সময়ে খুব আলোচিত এক চিন্তা। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের বেলায় কোনটি বেশি বিবেচ্য? এ জটিল প্রশ্নের জন্য নৈতিকতার মুখাপেক্ষী হতে হয়। যদি আমরা উপযোগবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখি, তবে সমাজের সর্বাধিক মানুষের জন্য সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গোষ্ঠীস্বার্থকেই প্রাধান্য দিতে হয়। আবার, কান্টীয় নৈতিকতার আলোকে ব্যাখ্যা করতে গেলে, মানুষের স্বতন্ত্র মর্যাদা সমুন্নত রাখার প্রশ্নে ব্যক্তিস্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষে সমর্থন করা হবে।
এক্ষেত্রে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ অনুসারে Do not harm নীতির আলোকে সংক্রামক ব্যাধি হিসেবে করোনার তথ্য একজন চিকিৎসক যেমন রোগীকে অবহিত করার দায়িত্ব রাখেন একইভাবে অন্যদের সতর্কতারও প্রয়োজন রয়েছে। তবে রোগীর ব্যক্তিত্বের মর্যাদার পাশাপাশি সমাজের সার্বিক স্বার্থের বিবেচনাটিও নৈতিকভাবেই উপলব্ধি হয়। জনস্বাস্থ্য প্রসঙ্গের বাইরেও করোনা আমাদের নানান বাস্তব অবস্থার প্রভূত পরিবর্তন সাধন করেছে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার এ সময়ের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। শিক্ষা, চিকিৎসা এমনকি দাফতরিক ক্ষেত্রেও তথ্যপ্রযুক্তির নানামুখী ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। তবে এর ব্যয় বা সহজসাধ্যতা সকলের কাছে কতটা উপযোগী? সে প্রশ্নটিও নৈতিক আলোচনার দাবি রাখে। কেননা, আমাদের মতো উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশের নাগরিকদের জীবিকা নির্বাহের স্বাভাবিক পথটি যখন অনেকাংশে জটিলতার সম্মুখীন তখন তথ্যপ্রযুক্তির বাড়তি ব্যয়ভার অনেক সময় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া তথ্য প্রযুক্তিগত নানামুখী অপব্যবহারে অপরাধ প্রবণতাকেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তাই ন্যায়নীতির প্রয়োগ এখানেও প্রাসঙ্গিক। করোনার জন্য কার্যত স্থবির এ বিশ্বে নানান নেতিবাচকতার মাঝেও প্রকৃতির স্বরূপে ফিরে আসার ইতিবাচক প্রকাশে আমাদের মাঝে নতুন আশা জাগ্রত হয়েছে। বেশ অনেকটা সময় কলকারখানা বা যান্ত্রিক বাহনের সীমিত ব্যবহারে প্রকৃতি যেন নিজেকে গুছিয়ে তুলেছে নিজের মতো করে। যেমন— সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের অনুপস্থিতিতে দেখা মিলেছে সাগরলতার, মোহনায় দেখা গেছে বিলুপ্তপ্রায় ডলফিন। এমনকি ব্যস্ত রাস্তার পাশে ফুটপাতেও ফুটেছে রঙিন ফুল। অতি সম্প্রতি দেশের পঞ্চগড় জেলা থেকে অনেকটা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া।
জিনান বিনতে জামান: সহকারী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা কলেজ
[email protected]