ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ট্রাম্পের ভাঁওতাবাজি

শেখ আনোয়ার
🕐 ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৮, ২০২০

বিশ্বশাসন করা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববাসীর কৌতূহলের অন্ত নেই। আগামী নির্বাচনে কে বিজয়ী হবেন? বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি জো বাইডেন? এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। হোয়াইট হাউসে সাংবাদিক সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগে ভাগেই হুঁশিয়ার করেছেন, ‘ব্যালট ভোট মানেই কারচুপির রাস্তা স্পষ্ট। কোনোভাবেই ব্যালট পেপারে নির্বাচনে পরাজয় মেনে নেওয়া হবে না।’ এমনও বলেন, ‘সে রকম ভালো পরিস্থিতি তার সামনে থাকবে না। তাই দেশ ছাড়তে বাধ্য হবেন তিনি।’

আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এখন পর্যন্ত যতগুলো জরিপ হয়েছে তাতে ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেনের দিকে ঝুলে রয়েছে জয়। প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে তিনি এগিয়ে রয়েছেন। গত নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে রাজ্যগুলোতে হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়েছিলেন এখন সেসব রাজ্যে জো বাইডেন ট্রাম্প থেকে অনেকটা এগিয়ে। এভাবে চলতে থাকলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়া কিছুটা কঠিন হয়ে যাবে। কারণ জো বাইডেনকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

তিনি বয়সে যেমন প্রবীণ রাজনীতিতেও তেমন। বারাক ওবামা যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যদি তিনি নির্বাচিত হন তাহলে তিনিই হবেন আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রবীণ প্রেসিডেন্ট। চলতি সমীক্ষাগুলো বলে দিচ্ছে, এবারের নির্বাচন মোটেও সহজ হবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে তাই বিশ্ববাসীর এত আগ্রহ, ট্রল, পোস্ট ও মন্তব্য আগে কখনো দেখা যায়নি। প্রশ্ন উঠেছে, ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা তবে কি কমে গেল?

জী হ্যাঁ। কমেছে বৈকি! কারণ, করোনাভাইরাস সঙ্কট মোকাবিলায় ব্যর্থতা তার পিছু নেয় আগে থেকেই। একেক সময় হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, মিডিয়ার সামনে উল্টোপাল্টা কথা বলা। যার ফলে সবার কাছে হাসি তামাশার পাত্রে পরিণত হয়েছেন। ফলে জনমত সমীক্ষাতেও তার জনসমর্থন কিছুতেই ৪২ শতাংশের ওপরে উঠছিল না। এবার সঙ্গে যোগ হয়েছে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার বোমা ফাটানো ঘটনা ও ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের সঙ্গে বিতর্কে গো-হার। এসব ছিল সেপ্টেম্বরের ঘটনা। অক্টোবরের প্রথম দিনেই জানা গেল তিনি ও ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প করোনায় আক্রান্ত। সঙ্গে দুই ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা, তিন সিনেটরসহ আরও ডজনখানেক ছা?য়াসঙ্গী। ঘটনার আকস্মিকতা ট্রাম্পের সব নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ রীতিমতো ওলট-পালট করে দিয়েছে। সিএনএন-র মতো মার্কিন মিডিয়াও বলতে বাধ্য হয়েছে, ‘ট্রাম্পের জনসমর্থন তলানিতে। সাময়িকভাবে হলেও তার প্রচার শিবির যেন নাবিকবিহীন জাহাজ।’

ট্রাম্পের জন্য প্রধান সমস্যা বিশ্বাসযোগ্যতা। গত ক’মাস করোনাভাইরাসকে হালকা ফ্লু বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। বারবার বলেন, ‘ম্যাজিকের মতো এই ভাইরাস উধাও হবে।’ এ প্রশ্নে দেশের সেরা বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করেন। তাদের লিখিত পরামর্শ তার চাপে বদলে যায়। করোনার ভয়াবহতা খাটো করে দেখানোর জন্য তিনি প্রতিরোধক মাস্ক পরার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেন। মাস্ক পরলে তাদের দুর্বল দেখা যাবে। এ যুক্তিতে ট্রাম্প শুধু নিজে নন, হোয়াইট হাউসের কর্মচারীদেরও মাস্ক পরতে নিরুৎসাহিত করেন। ট্রাম্প এমন কথাও বলেন, ‘বাইডেন যেভাবে নিজের মুখ কাপড়ে ঢেকে রাখেন, তাতে মনে হয় নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা রয়েছে। তাকে একজন মনোবিশারদকে দিয়ে দেখানো উচিত।’ এখন অবশ্য সব পরিহাসের লক্ষ্য ট্রাম্প নিজেই। একজন রিপাবলিকান নির্বাচনী কৌশলবিদ তো বলেই ফেলেছেন, নজর যত বেশি করোনার ওপর পড়বে, ট্রাম্পের জন্য ততই বিপদ। তিনি চান আলোচনা হোক আগামীকাল নিয়ে। কিন্তু করোনার ওপর নজর থাকা মানে সকলের দৃষ্টি থাকবে ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতার ওপর।

ভবিষ্যৎই বলে দেবে, প্রেসিডেন্টের অসুস্থতা শেষ পর্যন্ত কতদূর গড়াবে? করোনাভাইরাস ট্রাম্পের আর কোনো সহকর্মীর মধ্যে সংক্রমিত হবে কী না, তার ওপর নির্বাচনী প্রচারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এটা নিশ্চিত যে ট্রাম্প তার করোনা সংক্রমণ নিয়ে আসন্ন নির্বাচনে আরও অনেক নাটক করবেন। তার হাসপাতালে থাকার দ্বিতীয় দিনে চিকিৎসকদের চরম উদ্বেগ সত্ত্বেও ট্রাম্প বেরিয়ে যান হাসপাতাল থেকে। হাসপাতালের সামনে সমবেত অনুগ্রাহীদের অভিনন্দন জানান। তিনি দেখাতে চান তিনি সুস্থ। তাকে নিয়ে সমর্থকদের কোনো চিন্তা করতে হবে না। শুধু তাই নয়, দুদিনের মধ্যে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে হোয়াইট হাউসে চলে আসেন। হোয়াইট হাউসে ঢোকার আগে ছুঁড়ে ফেলে দেন মুখের মাস্কও। তিনি দেখাতে চান তিনি বীর। তাকে কোনো রোগই দাবিয়ে রাখতে পারবে না। অনেকে মনে করেন, ট্রাম্প যদি করোনা থেকে সেরে ওঠেন, তাহলে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে হয়তো বলবেন, এ ভাইরাসকে যতটা খারাপ বলে প্রচার করা হচ্ছে, আসলে ততটা নয়। প্রেসিডেন্ট যা কিছুই বলুন না কেন, তার সে বক্তব্য আমেরিকানদের মৃত স্বজনদের ফিরিয়ে আনতে বা কাজ হারানো ব্যক্তির কাজ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। ট্রাম্প যদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে হয়তো কট্টর ডানপন্থীদের পক্ষ থেকে নির্বাচন বাতিল কিংবা পিছিয়ে দেওয়ার দাবি উঠতে পারে। নির্বাচন পেছাতে হলে কংগ্রেসের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে এবং সে অনুমোদন অসম্ভব।

ট্রাম্পপন্থী সংবাদ মাধ্যমগুলো ইতোমধ্যে ডাকযোগে ভোট দেওয়ার বিষয় নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার শুরু করে দিয়েছে এবং ট্রাম্প হারলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা অস্বীকার করার জন্য জনমত গঠনের কাজও তারা চালিয়ে যাচ্ছে। যদি ট্রাম্প একটা বড় সময় ধরে নির্বাচনী প্রচার করতে না পারেন এবং শেষে হেরে যান, তবে তিনি নির্বাচনের ফলাফলের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অজুহাত পাবেন। ভয়ের কথাটা শুনিয়ে রেখেছেন আমেরিকার লেইডেন ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক অ্যান্ড্রু গথোর্প। বলেছেন, ‘যে প্রেসিডেন্ট অতিমাত্রায় আত্মপ্রেমে মগ্ন এবং মিথ্যাচারে আসক্ত, তিনি প্রতিকূল অবস্থায় পড়লে কী করে বসবেন, তা হয়তো আমরা এমন এক সময়ে টের পাব, যখন আর করার কিছুই থাকবে না।’

মার্কিন রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবির্ভাব হয়েছিল একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে। দেশের অর্থনীতিকে সঠিক পথে ফেরাতে নিজেকেই সবচেয়ে যোগ্য লোক হিসেবে প্রচার করেন। আগের নির্বাচনে তিনি স্লোগান তুলেছিলেন ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’। সে সেøাগানেই আটকে রয়েছেন এবারও। মার্কিন অর্থনীতির ক্ষত সারাতে তিনি যেসব রক্ষণশীল পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার ভরকেন্দ্র ছিল আয়করদাতাদের অর্থের সফল ব্যবহারের বিষয়টা। কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমসের সদ্য ফাঁস করা তথ্যে দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতি পুনর্গঠন ও ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে আমেরিকাকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াইয়ের স্বঘোষিত সেনাপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। আয়করদাতাদের অর্থের অপব্যয় বন্ধের দোহাই দিয়ে সকলের জন্য স্বাস্থ্য পরিসেবা প্রকল্প বা ওবামাকেয়ার ও তরুণ অভিবাসীদের জন্য থাকা ‘ড্রিমারস’ প্রকল্প বন্ধের কথা বলে গেছেন তিনি। আর সে প্রেসিডেন্টই আবার অবাধে আয়কর ফাঁকি দেন। এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে? ভোটের আগে নিউইয়র্ক টাইমস নিঃসন্দেহে এক বড় অস্ত্র তুলে দিয়েছে ডেমোক্রেটদের হাতে। আয়কর ফাঁকি দিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে রাস্তায় হেঁটেছেন, তা চিরপরিচিত। নিজের ব্যবসায়িক ক্ষতি দেখিয়ে তিনি আয়কর পরিশোধের হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন বরাবর। এ অজুহাতকেই সত্যি হিসেবে মেনে নিলে বলতে হয়, সফল ব্যবসায়ী হিসেবে নিজের যে ভাবমূর্তি তিনি গড়েছিলেন, তা এক বড় ভাঁওতাবাজি। ফলে তার নিজেকে ‘গ্রেট ম্যানেজার’ দাবি করাটা ঠিক ধোপে টেকে না।

নিউইয়র্ক টাইমস যে তথ্য প্রকাশ্যে এনেছে, তাতে আঁতকে উঠতে হয়। তারা জানিয়েছে, গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছর ও প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্প মাত্র ৭৫০ ডলার করে আয়কর পরিশোধ করেছেন। পরের দু’বছরে তিনি কোনো আয়করই পরিশোধ করেননি। আইনের মারপ্যাঁচে এই আয়কর পরিশোধ না করার দায়টা হয়তো শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প এড়াতে পারবেন। কিন্তু এর মাধ্যমে সেই বড় প্রশ্নটা সামনে চলে এসেছে। তা হলো, আমেরিকার আয়কর পরিকাঠামোয় ধনীরাই সুবিধা পান বেশি। আর কাটা হচ্ছে পরিশ্রমী আমেরিকানদের পকেট। যার কথা বিরোধীরা বহুদিন ধরে বলে এসেছেন। ডেমোক্রেটরা এ ব্যবস্থার বদল চায়। শুনলে অবাক হতে হয়, এই আয়কর ব্যবস্থা পাল্টানোর কথা ডোনাল্ড ট্রাম্পও বলেছেন।

এ বদলের কথা বলেই তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভোটারদের নিজের দলে টেনেছেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ধনীদের জন্য থাকা সব সুযোগ সুবিধা নিয়ে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার কাজটাও করেছেন। আর সেসব খেটে খাওয়া মানুষের পকেট কেটেছেন, যাদের ভোটে আজ তার ঠিকানা হোয়াইট হাউস। প্রশ্ন হচ্ছে, এই আয়কর ফাঁকি দেওয়ার তথ্য আসন্ন নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে? কিন্তু এর আগেও তো কম কেলেঙ্কারির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম যুক্ত হয়নি। যৌন নির্যাতন, পর্নো তারকার সঙ্গে সম্পর্ক, গত নির্বাচনে রাশিয়ার নেপথ্য যোগসাজশ ইত্যাদি বহু অভিযোগ উঠেছে। যার জন্য গত চার বছর কম পানি ঘোলা হয়নি। এক সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট হবে বলে শোরগোল উঠেছিল। কিন্তু এখনো তিনি বহাল তবিয়তেই রয়েছেন।

আয়কর এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ, আমেরিকার মতো দেশে অনেক বড় অপরাধ। কিন্তু মুশকিল হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা কট্টর সমর্থক হিসেবেই পরিচিত। যা কিছুই হোক, তারা ট্রাম্পের সঙ্গেই রয়েছেন। বিভিন্ন জনমত সমীক্ষাতেও ট্রাম্প সমর্থকদের এমন প্রবণতাই উঠে আসছে। সঙ্গে উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের নিজের সঙ্গে লেপ্টে রাখতে এবং বিভিন্নভাবে তাদের উসকে দিতে, যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমন অবস্থান তিনি স্পষ্ট করেছেন বিভিন্ন ঘটনায়। নির্বাচনে হেরে ধুরন্ধর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশ ছাড়ার ঘোষণা এক চূড়ান্ত ভাঁওতাবাজি ছাড়া কিছু না। তিনি তার চেনা পথেই হাঁটবেন, এতে সন্দেহ নেই।

শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 
Electronic Paper