ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

করোনাকালে নারী ও শিশু

মোতাহার হোসেন
🕐 ১১:২৯ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২০, ২০২০

বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালে অধিকাংশ সময় ঘরে থাকায় মানুষের স্বভাব, আচার-আচরণ এবং দৈনন্দিন কর্মসূচিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ঘরে বসে কর্মহীন থাকার ফলে পুরুষরা হয়ে উঠেছে অনেকটা খিটখিটে, অসহিষ্ণু, অধৈর্য। ফলে তাদের ক্ষোভ, অসন্তোষ, অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে ঘরের নারী ও শিশুর ওপর। একদিকে মানবসভ্যতার বিকাশ ঘটছে, অন্যদিকে নানা অসভ্য কর্মকাণ্ডও থেমে নেই। কিছু কিছু কর্মকাকণ্ড এতটাই ঘৃণ্য, নিকৃষ্ট, যা সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রশ্নবিদ্ধ করছে প্রতিটি সচেতন মানুষের বিবেককে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক জরিপে জানা গেছে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেড়েছে বাল্যবিবাহও। গত নয় মাসে ৯৭৫ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে ৪৩ জনকে।

এছাড়াও এই সময়ে যৌতুক নিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৬৮ জন এবং অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে ২১ জন নারী। এদিকে, করোনাকালীন সংশ্লিষ্টদের কাছে অভিযোগ করতে না পারায় সহিংসতা আরও বাড়ছে বলেও জানিয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে শিশুদের বিভিন্ন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধী টিকাদান বন্ধ ছিল। ফলে অদূর ভবিষ্যতে শিশুমৃত্যুর হার ভয়ানকভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

সম্প্রতি বিশ্বের ৮০টি দেশে জাতিসংঘ পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, তিন-চতুর্থাংশ দেশেই টিকাদান কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে, প্রায় তিন দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ডিপথেরিয়া, টিটেনাস ও হুপিং কাশি প্রতিরোধী টিকাদানের হার কম দেখা গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গ্যাব্রিয়েসুস বলেছেন, টিকা না পাওয়ায় শিশুদের মধ্যে রোগ সংক্রমণ ও মৃত্যুহার অনেকটাই বেড়ে যেতে পারে।

ইউনিসেফ ও ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ (পিপিই) না থাকা, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, স্বাস্থ্যকর্মী সংকটের কারণে চলতি বছর শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত অন্তত ৩০টি হাম প্রতিরোধী টিকাদান অভিযান বাতিল বা স্থগিত করা হয়েছে।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, করোনা মহামারীর আগে থেকেই হামের ভয়াবহ সংক্রমণের মুখে ছিল বিশ্ব। ২০১৮ সালে এতে আক্রান্ত হয়েছিলেন অন্তত এক কোটি মানুষ, এর মধ্যে মারা গেছেন কমপক্ষে ১ লাখ ৪০ হাজার। মৃতদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল শিশু। ইউনিসেফের হিসাবে, প্রতিবছর সময়মতো টিকাদানের কারণে জীবন বেঁচে যায় অন্তত ৩০ লাখ মানুষ, বিশেষ করে শিশুদের। তারপরও বহু জায়গা এ কার্যক্রমের বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে প্রতিবছর এমন ১৫ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছেন, যাদের টিকা দিতে পারলে হয়তো জীবনরক্ষা করা সম্ভব হতো। জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থাটির হিসাবে, ২০১৯ সালে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ শিশু হাম-ডিপথেরিয়ার মতো রোগের টিকা পায়নি। এদের অধিকাংশই আফ্রিকা অঞ্চলের এবং দুই-তৃতীয়াংশ হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, ব্রাজিল, কঙ্গো, ইথিওপিয়াসহ ১০ দেশের বাসিন্দা।ইউনিসেফ প্রধান হেনরিয়েট ফোরের মতে, করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্বব্যাপী নিয়মিত টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনাকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। অবশ্যই টিকাদান কার্যক্রমকে আরও জোরদার করতে হবে, যেন অন্যান্য রোগের মাধ্যমে শিশুদের জীবন হুমকিতে না পড়ে। একটি স্বাস্থ্য সংকটের সঙ্গে আরেকটির বিনিময় করা যায় না।

মহিলা পরিষদের উদ্যোগে ‘কোভিড-১৯ ক্রান্তিকালে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংস পরিস্থিতি এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা সংকটকালীন নারীর প্রতি সকল ধরনের সহিংসতা, বিশেষ করে পারিবারিক সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নির্যাতনের এক ভিন্ন মাত্রা ধারণ করেছে। গণধর্ষণ, শিশু ও নারী এমনকি প্রতিবন্ধী ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, বৈবাহিক ধর্ষণ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সাইবার ক্রাইম ও পাচারসহ শিশু ও প্রতিবন্ধী নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। কোভিড পরিস্থিতিতে নারীর প্রতি সৃষ্ট চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করে দূর করতে হলে আলাদাভাবে বিনিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। এ ধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হবে। একই সঙ্গে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য চলমান কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। বাল্যবিবাহ নিরসনে প্রশাসনের ভূমিকা আরও কার্যকর ও জোরদার করতে হবে। নারী শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বিদ্যমান হটলাইনগুলোর কার্যক্রম আরও জোরদার করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে নারী শিক্ষার হার বাড়াতে বিদ্যমান উপবৃত্তির আত্মতা বৃদ্ধিসহ অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম মেয়েদের নাগালে নিতে হবে, নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য নিশ্চিতের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় ভার্চুয়াল কোর্টের এখতিয়ার বৃদ্ধি করতে হবে। সীমিত পরিসরে হলেও গুরুত্বপূর্ণ পুরনো মামলার শুনানি ভার্চুয়াল কোর্টে হতে হবে। মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধে ১৫ দফা সুপারিশ করা হয়।

নারীর প্রতি মানসিক নির্যাতনের প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী, যা একটি দেশের উন্নয়নের পথে অন্তরায়। এ মানসিক নির্যাতন প্রতিরোধে ব্যক্তি পর্যায় এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। নারীর আইনগত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জাতীয় মহিলা সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে একটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল রয়েছে। নির্যাতিত নারীরা এ সেলের মাধ্যমে বিনা খরচে আইনগত সহায়তা পেয়ে থাকেন। এছাড়া দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে, দক্ষ বিচারক দ্বারা ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। নির্যাতিত নারীরা নিজ জেলা থেকে বিনা খরচে আইনগত সহায়তা পেতে পারেন। জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাওয়া যায়।

নির্যাতিত নারীদের আইনি সুরক্ষা দিতে ২০০০ সালে সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করে। সে আইনকে ২০১৩ সালে সংশোধন করে অধিকতর কঠোর করা হয়। আইনি প্রতিকার চাইলে বিচারপ্রার্থীদের কোথায় সুবিচার পেতে পারেন, কীভাবে আইনি সুবিধা পাবেন তাও সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ আইনে নারী নির্যাতনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। নারী নির্যাতন রোধে সরকার তৎপর রয়েছে। নারী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে এবং সাজা নিশ্চিত করা হচ্ছে।

আমাদের প্রত্যাশা, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র নারী এবং শিশুদের জীবনের নিরাপত্তার পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আরও মনোযোগী এবং শক্ত অবস্থান গ্রহণ করবে। একই সঙ্গে শিশু ও নারীর জন্য পরিবার, সমাজ হবে শান্তি, সুরক্ষার বিশ্বস্ত ঠিকানা। কারণ নারী ও শিশুর জীবন বিপন্ন করে, তাদের জীবন ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রেখে একটি সুন্দর পরিবার, সমাজ গঠন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ, অগ্রগতি, উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাও সম্ভব নয়। দেশের মোট জনসংখার অর্ধেক নারী, তাদের সুরক্ষা দেওয়া সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

(পিআইডি : শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)

মোতাহার হোসেন : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম
[email protected]

 
Electronic Paper