উন্নত জীবনের জন্য বই
রহিম ইবনে বাহাজ
🕐 ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৯, ২০২০
বই পড়ার নির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই। সকল মানুষকে বই পড়ার জোর তাগিদ দিয়ে লেখক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, দেশে যতগুলো হাসপাতাল আছে, তার চেয়ে বেশি দরকার লাইব্রেরি। বর্তমান সমাজে শিক্ষিত লোক ভুরিভুরি কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় শিক্ষার মান নিয়ে। আদৌ কি তারা শিক্ষিত! যারা কিনা পাঠ্যবইয়ের বাইরে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ পড়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। প্রমথ চৌধুরী আর একটি কথা বলেছেন। আমাদের শিক্ষিত সমাজ লোলুপ দৃষ্টি আজ অর্থের ওপরেই পড়ে রয়েছে।
সুতরাং সাহিত্যচর্চা সুফল নিয়ে আমরা অনেকেই সন্দিহান। যারা হাজারখানা ল-রিপোর্ট কেনেন তারা একটি কাব্যগ্রন্থও কিনতে প্রস্তুত নন। কেননা তাতে ব্যবসার কোনো লাভ নেই। উকিল কবিতা আবৃত্তি করলে মামলা যে দাঁড়িয়ে হারাতে হবে। কিন্তু যে কথা জজে শোনেন না তার যে কোনো মূল্য নেই! এটাই হচ্ছে মহাভ্রান্তি। সকলেই যদি পাঠ্যবইয়ে ডুবে থাকে, তাহলে বিশ্বের চারপাশের অজানা তথ্য কীভাবে জানব। পাঠ্যবইয়ের বাইরে উন্নতমানের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, ভ্রমণকাহিনি ও ধর্মীয় বই পড়তে পারেন। যুবসমাজ আজকে যে বিপদগ্রস্ত, মরণনেশায় আসক্ত, যুবক-যুবতীরা তাদের সঠিক গাইডলাইন না থাকার কারণে নেশার অর্থ জোগাড় করতে বেছে নিচ্ছে অনৈতিক পন্থা। সমাজে বাড়ছে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস। ত্রাস সৃষ্টি করে পাড়া মহল্লায় কিশোর গ্যাং সৃষ্টি করে অপরাধ কায়েম করছে। নিশ্চয়ই মনে আছে, রাজধানী ঢাকায় সেই পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ে ঐশী তার মা-বাবাকে খুনের কথা।
এদেশ, সমাজকে আর রসাতলে না ডুবিয়ে সঠিক পথে চলার অগ্রসর ভূমিকা পালন করবে কে? অবশ্যই অভিভাবকের ওপরই দায় বর্তায়। বাংলাদেশে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো পাঠাগার সৃষ্টি হয়নি। বাংলাদেশে প্রয়োজন এমন অসংখ্য সামাজিক সংগঠন যার মূল লক্ষ্য হবে কিশোর ও যুবসমাজকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। এ সংগঠনের মূল কৌশল হলো গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে তরুণদের সঠিক পথে পরিচালিত করা।
‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগানের ওপর ভিত্তি করে সংগঠনটি বাংলাদেশে বই পড়া ও সৎ চিন্তা বিকাশ ঘটানোর জন্য কাজ করে থাকে। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের উদ্যোগে ১৯৭৮ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ১৭ লক্ষাধিক ছাত্র-ছাত্রী বই পড়া কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত। সারা দেশে এ লাইব্রেরির ভ্রাম্যমাণ গাড়ি আছে। এ মহান উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। আমাদের সরকার একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে, পাঠাগার সব জায়গায় সৃষ্টি করা হবে। পাঠক রুটিনমাফিক বই পড়বে। পাঠাগার পরিচালনা করার জন্য একজন সাহিত্যমনা লোক নিয়োগ দেওয়া যাবে। শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতি সবার মনে টানে না। যে ছেলেটা সাহিত্যের প্রতি দুর্বল তাকে দিয়ে পাঠাগারটি পরিচালনা করা সম্ভব। যুবসমাজকে মাদক থেকে পরিত্রাণের এখনই সময়। আলোকিত সমাজ গঠনে পাঠাগারের বিকল্প নেই। ভালো মানুষ হতে হলে পড়তে হবে, জানতে হবে, জানার আগ্রহ থাকতে হবে। যুবক-যুবতীরা দামি মোবাইল ফোনে সারাক্ষণ চ্যাটিং, গেমস, পর্ন সাইট দেখে দেখে এলাকায় বাড়ছে ধর্ষণ। বাড়ছে বিভিন্ন অপকর্ম। এটাও একধরনের নেশার মতো। আমরা যতই ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্বারপ্রান্তে যাচ্ছি, অর্থ, সময় এবং চোখের সমস্যাও হচ্ছে। সব বিফলে যাচ্ছে। ভালোর চেয়ে মন্দের অঙ্কটা দীর্ঘ হচ্ছে। অভিভাবক তো নিজের কর্ম নিয়ে মহাব্যস্ত, ছেলেমেয়ে রাতের কয়টায় গৃহে ফেরে তার কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। বরগুনার আলোচিত ঘটনা রিফাত শরীফ হত্যা, মূল নায়ক নয়ন বন্ড নিজে মাদকাসক্ত এবং ব্যবসায়ী ছিল। নয়ন বন্ডের রাজত্ব অবশ্য বেশিদিন টেকেনি। সমাজে এরকম হাজারো নয়ন বন্ড মাথা উঁচু করে চলছে। অসাধু কিছু পুলিশ সদস্য অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কারণে বারবার পার পেয়ে যায়। সরকার মাদক জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও থেমে নেই মাদক ব্যবসা। যুবকরা অসৎ সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে। বিপদগামী হয়ে সম্মান, শ্রদ্ধা সব ভুলে রসাতলে ডুবছে সমাজ। মানুষের জন্য মানুষের যে মায়া, মমতা, সততা, নিষ্ঠা, আদর্শ ক’জন বুকে হাত রেখে বলতে পারবে, গুণগুলো তার ভিতরে আছে?
চারদিকে এত অপরাধের সমাহার, বাজে কাজের এত আয়োজন দেখে মনে হয় ভুবন বদলে গেছে। সত্যি পাল্টে গেছে। মানুষ পরিবর্তন হয়নি। বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে কী লাভ, দুর্নীতির দায়ে আটক কী লজ্জা, শুধু ডিগ্রি অর্জন, এ প্লাস, জিপিএ-৫ দিয়ে কী হবে। প্রথমে হতে হবে মানুষ। মানুষ না হয়ে জগতে বেঁচে থাকাটা বৃথা। মৃত্যুর পর মানুষ যদি আপনাকে স্মরণ না রাখে তবেই জীবন বৃথা। একটা মানুষ যদি ভালো বই পড়ে সে কখনো বিপথগামী, নেশাসক্ত হতে পারে না। জ্ঞানের মহাভা-ার হতে শিখুন, জানুন, এরপর মেনে চলুন সঠিক পথে। জাতিকে উন্নত করতে হলে সকলকেই বই পড়তে হবে। তবেই মানুষ হিসেবে আমরা এগিয়ে যাব।
রহিম ইবনে বাহাজ : কবি ও কলাম লেখক
[email protected]