ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ধর্ষণের বিরুদ্ধে জেগেছে দেশ

আব্দুল হাই রঞ্জু
🕐 ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১৮, ২০২০

প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, শিশু ধর্ষণের ঘটনা কম-বেশি ঘটছেই। তবে সম্প্রতি ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে অনেক। যখন বাবা-মায়ের সামনে, স্বামীর সামনে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে, তখন এটাকে আর যাই হোক, কোনোভাবেই স্বাভাবিক ঘটনা বলা যায় না। বেড়াতে যাওয়া স্বামীকে বেঁধে রেখে যখন স্ত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়, তখন নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। সম্প্রতি সিলেটে এমসি কলেজে নববধূকে গণধর্ষণ করা হয়। ওরা যে কত বড় ভয়ানক, কর্মকাণ্ডে প্রমাণ মিলেছে। ভুক্তভোগীর গাড়িতে করে কেনাকাটা করে স্বামীকে আটকে রেখে নববধূর ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। 

আমাদের সমাজে একজন সম্ভ্রম হারানো নারী কিংবা শিশুকে সারাটি জীবন এ অপবাদের বোঝা বয়ে বেড়াতে হয়। ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি মহান স্বাধীনতা। সেই সব বীরাঙ্গনা নারীকে আমরা সর্বোচ্চ সম্মান দিলেও তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি বললেই চলে। আর এখন স্বাধীন দেশে যেভাবে শিশুদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, এরা অপবাদ ছাড়া বাকি জীবনটা চলতে পারবে? এমনি হাজারো প্রশ্ন আমাদের বাবা-মাকে ভাবিয়ে তুলছে। অজানা কোনো শঙ্কা নিয়েই বাবা-মায়েদের সবসময় প্রহর গুনতে হচ্ছে। অথচ প্রতিটি পরিবারেই মা, বোন, ভাবি আছে।

যারা এসব অপকর্ম করছে, তাদের ঘরের মেয়েটির নিরাপত্তার কথা কি ওরা একবারের জন্য ভাববে? হয়তো না, কারণ যারা মাদকাসক্ত, উন্মাদ তাদের মধ্যে জ্ঞান, বিবেক, বিবেচনা একেবারেই থাকে না। ফলে, তারা সমাজের নিকৃষ্ট যেকোনো অপকর্ম করতেও দ্বিধা করে না। বাস্তবে আমাদের অধপতিত ঘুণেধরা সমাজব্যবস্থায় অনৈতিকতা দিনে দিনে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ইয়াবা, ফেনসিডিলের আগ্রাসনে গোটা তরুণ যুব সম্প্রদায় বিপথগামী হচ্ছে। যার পরিণতিতে কিশোর বয়সেই তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সংঘটিত করছে নানা অপকর্ম। এমনকি খুন-খারাবি পর্যন্ত করতে দ্বিধা করছে না। এখন পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধের নানা চিত্র।

সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নে অনৈতিক কাজের অপবাদ দিয়ে ৩৬ বছরের এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেছে একদল যুবক। নির্যাতনকারীদের কাছে বারবার মিনতি করেও শেষ রক্ষা হয়নি। এমনকি বাবা পর্যন্ত ডেকেও রেহাই পায়নি। ঘটনাটি প্রায় এক মাস আগে ঘটলেও ভয়ে তা প্রকাশ করেনি। বিবস্ত্র নির্যাতনের চিত্র ভিডিও করে রাখা হয়েছিল। যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরাধীরা ছড়িয়ে দিলে গোটা জাতি তা দেখে হতভম্ব! কীভাবে একজন অসহায় নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করতে পারে? শেষপর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও ঘুম ভাঙে।

শুরু হয় অপরাধী গ্রেফতারের তোড়জোড়। শেষপর্যন্ত অভিযুক্ত দেলওয়ার, কালামসহ একে একে সবাই আইনের জালে আটক হয়। প্রাথমিক পরিচয়ে তারা সরকার দলীয় লোক হিসেবে চিহ্নিত হলেও ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকে কোনো সহানুভূতি পায়নি। শেষপর্যন্ত অপরাধীদের কী সাজা হয়, তা দেখার জন্য হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

সিলেটের এমসি কলেজ ও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনায় গোটা জাতি স্তম্ভিত। একে একে প্রতিবাদে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিচ্ছে। বিশেষ করে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষকের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবিতে দেশের রাজপথ প্রকম্পিত করছে। আবার ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভ দমনে পুলিশি নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছে ভুক্তভোগীরা। এরপরও আন্দোলনকারীরা থেমে নেই।

সচিত্র প্রতিবেদনে দেখলাম পুলিশি নির্যাতনে নারী শিক্ষার্থী আহত অবস্থায় শাহাবাগের সমাবেশে স্লোগান দিচ্ছে। দেশের আইনে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- নির্ধারণের জন্য দাবি উঠলে গত ১২.১০.২০২০ তারিখে মন্ত্রিসভায় আইন সংশোধন করে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আইন পাস করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এরপর কি ধর্ষণ কমে আসবে? পুরোপুরি কমে আসবে তা হয়তো বলা যাবে না। তবে মানুষের মধ্যে মুত্যুদণ্ডের আইন কিছুটা হলেও ভীতি সৃষ্টি করবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, শুধু আইন করলেই হবে না, আইনের শাসন যথাযথভাবে প্রতিপালন করতে হবে। কারণ আমাদের দেশে আইন থাকলেও কার্যত আইনের প্রয়োগ সহসাই ঘটে না। এ জন্য আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধ করেও অনেকেই বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে এসে আবার অপকর্ম শুরু করে। যে কারণে ধর্ষণের মতো ঘটনা কমে না। উল্টো উপযুক্ত বিচার না হওয়ায় অন্যরাও এ ধরনের অপরাধ নির্বিঘ্নেই চালিয়ে যায়।

অর্থাৎ বিলম্বিত বিচারব্যবস্থা, বিচারহীনতা কিংবা উপযুক্ত সাক্ষীর অভাবে অপরাধীর ছাড় পাওয়ার ঘটনার কারণেই প্রতিনিয়ত ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছেই। বড় সমস্যা হচ্ছে, ভিকটিমকে প্রমাণ করতে হয়, সে ধর্ষিত। অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত সাক্ষী ও আলামতের অভাবে অপরাধীরা বড় কোনো সাজা ভোগ করে না, কিংবা কম সাজা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে ঘরের ভিতরে কিংবা নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশীদের দ্বারা ধর্ষিত হলেও মান-সম্মানের ভয়ে, কোর্ট কাছারির ঝামেলা এড়াতে, এমনকি মেয়েটির আজীবনের কলঙ্ক ঢাকতেই অনেক বাবা-মায়েই ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করেন না। এরপরও সম্প্রতি জাতীয় এক দৈনিকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এ বছর জানুয়ারি হতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নারী নির্যাতনের যে চিত্র তা ভয়াবহ। উল্লেখিত এ নয় মাসে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৯৭৬টি।

মূলত হিসাবটি দেখানো হয়েছে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও তথ্যের ভিত্তিতে। অথচ এর বাইরে অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা মিডিয়ায় কিংবা থানা পর্যন্ত যায়নি। তাহলে সহজেই অনুমেয়, ধর্ষণের মাত্রা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি। এ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের তরফে যতটুকু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ছিল, তারা তা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে গোটা দেশেই এখন তীব্র আন্দোলন দানা বাঁধছে। বৈশ্বিক মহামারী করোনার ছোবলে গোটা দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে আন্দোলনের তীব্রতা আরও বাড়ত। যা সামাল দেওয়া ক্ষমতাসীনদের পক্ষে অনেকটাই কঠিন হত। যদিও সরকারপ্রধান পর্যন্ত ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন। তারপরও একটার পর একটা ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলছে। মনে হয়, যেন ধর্ষণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে! যখন বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সভা থেকে প্রধানমন্ত্রী শিশুদের অধিকার রক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বক্তব্য রাখছিলেন, তখন দেশব্যাপী নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষের মানববন্ধন, বিক্ষোভ, সমাবেশ, মিছিল অব্যাহত ছিল।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আন্দোলনের দরকার কী, সরকার ধর্ষণকারীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করবে। বাস্তবে আমাদের দেশে কোনো কিছু আদায় করতে হলে আন্দোলন ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। ফলে মানুষ প্রতিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। যদিও দফায় ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। সরকার এটিকে ভালো চোখে নেয়নি। এটাও সত্য। কারণ ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন হয়তো শেষপর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিতে পারে, ক্ষমতাসীনদের মাঝে এমন আশঙ্কা থাকাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। যে কারণে অপরাধীদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হাজির করে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করেই জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনাই হবে সঠিক ও সময়োচিত পদক্ষেপ।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা এখন বিংশ শতাব্দীর সভ্য যুগে বসবাস করছি। অথচ আচরণ করছি বর্বর যুগের মতো। সাম্প্রতিক সময়ে বাবার হাতে মেয়ে ধর্ষণের মতো অপরাধের সচিত্র প্রতিবেদন ফেসবুকে দেখেছি। পুলিশ কর্মকর্তা দ্বারা সহকর্মীকে ধর্ষণের ঘটনাও দেদারসে ঘটছে। তাহলে মানুষ কার ওপর ভরসা করে বেঁচে থাকবে? বাবার হাতে যদি সন্তানের সম্ভ্রম নিরাপদ না থাকে, তাহলে কার কাছে আশ্রয় পাবে নারী! স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে যদি ধর্ষণের শিকার হতে হয়, তাহলে মানুষের শেষ আস্থার জায়গাটি কোথায়? দিনে দিনে অপসংস্কৃতি, সস্তা পর্নোগ্রাফি বাড়ছে।

এখন কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীসহ প্রায় সবার হাতের মুঠোয় স্মার্টফোন। ফলে অল্প বয়সে যৌনতা, ছেলে-মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক দৈহিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়াচ্ছে। ফলে অল্প বয়সেই ছেলেমেয়েরা বিপথগামী হচ্ছে। ফলে ধর্ষণ, কিশোর গ্যাংয়ের দ্বারা অপকর্ম সংঘটন, মাদকাসক্ত হওয়ার ঘটনা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কারণে পাশ্চাতের দেশগুলোর মতো যৌনতার বয়স, যৌনতার বিরূপ প্রভাব নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাউন্সিলিং করা উচিত। কারণ যৌনতাকে আর রাখঢাক দিয়ে ঢেকে রাখার সুযোগ আছে বলে মনে করি না। পাশাপাশি বাবা-মাকে ছেলে হোক আর মেয়েই হোক সবাইকে নজরে নজরে রাখতে হবে। হয়তো এটা কঠিন কাজ, তবুও উপায় কী? ওদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জীবনের লক্ষ্যেই বাবা-মা, ভাই-বোনকে মনোযোগী হতে হবে। স্মরণে রাখতে হবে, আজকের প্রজন্মই আমাদের ভবিষ্যৎ কা-ারি। এদের যথাযথভাবে সুশিক্ষায় গড়ে তুলতে না পারলে পরিবার এবং রাষ্ট্র কারওর জন্যই শুভ হবে না। এ ব্যাপারে সকলকেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

আব্দুল হাই রঞ্জু : সাবেক ছাত্রনেতা
[email protected]

 
Electronic Paper