ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাল্যবিয়ে রোধে প্রতিবাদ সচল থাকুক

মোহাম্মদ নজাবত আলী
🕐 ১২:০২ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২০

মানুষ সামাজিক জীব; কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থা একেবারে সুখকর নয়। বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে আমাদের বাস করতে হয়। কিন্তু কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে যা একটু সচেতন হলে প্রতিবাদী হলে, সাহসী হলে তা থেকে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু কথায় আছে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? কে বা কারা এগিয়ে আসবে সমাজের যৌতুক, বাল্যবিয়ের মতো কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।

তবে আমাদের সমাজে এমন কিছু শিক্ষিত তরুণ-তরুণী আছেন যারা ইতিবাচক কর্মের দ্বারা বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার ও সমস্যা সমাধানে আত্মনিয়োগ করে সবার দৃষ্টি ও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এদের মধ্যে দোলা আকতার নামে ষোল বছরের একজন মেয়ে গত দু’বছরে ৬ শতাধিক বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন। সম্প্রতি খোলা কাগজের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দোলার বয়স যখন ১২ বছর তখন তার নিজ এলাকার অনেকেই মায়ের কাছে তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বাল্যবিয়েসহ সামাজিক অসঙ্গতি দূর করার জন্য দোলার সঙ্গে অনেকেই কাজ করছেন। গত বছর জেনেভায় জাতিসংঘের একটি সম্মেলনে যোগদান করে দেশের মেয়েদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সফলতার কথা তুলে ধরেন। এর আগে যখন তার বয়স ১০ বছর তখন ওয়ার্ল্ড ভিশনে যোগ দেন। দোলার মতো সাহসী উদ্যোগী প্রতিবাদী মেয়ে আমাদের অহংকার। 

যৌতুক, বাল্যবিয়ে আমাদের সমাজের ভয়াবহ ব্যাধি। মরণব্যাধি ক্যানসারের মতো এগুলো আমাদের সমাজকে ঘিরে ধরেছে। দেশে কন্যাশিশুকে নিয়ে অভিভাবকের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কেন শঙ্কা ও ভীতি! তারও কারণ রয়েছে। দারিদ্র্যপীড়িত সমাজের বখাটের উৎপাত, সন্ত্রাসী দুর্বৃত্ত চক্রের হিংস্রতা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি। এসবের কারণে অভিভাবকরা তাদের কন্যাশিশুদের নিয়ে একধরনের বাড়তি চাপের মধ্যে থাকেন। দরিদ্রতার কারণে অনেক অভিভাবক যৌতুকের টাকাও পরিশোধ করতে পারেন না। ফলে নেমে আসে স্বামীগৃহে তার আদরের কন্যাসন্তানের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। সহ্য করতে না পেরে অনেক মেয়ে আত্মহত্যাও করে এমন নজির রয়েছে। ঠিক একইভাবে বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রেও মেয়ের অমতে জোর করে বিয়ে দিতে গিয়ে অথবা বিয়ের পর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

অসচেতনতার কারণে অনেক অভিভাবক নিজ হাতে তার কন্যাশিশুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। দারিদ্র্য, অসচেতনতা, অশিক্ষা, নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাল্যবিয়ে হয় বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এর প্রবণতা বেশি। বিয়ের প্রকৃত বয়স হওয়ার আগেই অভিভাবকরা কন্যাসন্তানকে বিয়ে দিয়ে একটু স্বস্তি পেতে চান। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে অল্পবয়স্ক কন্যা শিশু নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। ফলে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন সইতে না পেরে গলাই দড়ি, বিষ বা অন্যভাবে আত্মহত্যার চেষ্টা করে, আবার কখনো আত্মহত্যা করে। আবার দেখা যায় বিয়ে ঠিক হওয়ার পরপরই কন্যা শিশু কোনো কিছু না বুঝেই আত্মহত্যা করে।

কন্যাশিশুর প্রতি মায়ের ভালোবাসা স্নেহ মমতা একটু বেশি। কিন্তু তাই বলে যে একজন পিতা কন্যাশিশুকে ভালোবাসেন না বিষয়টি তা নয়। বরাবরই মেয়ের প্রতি মায়ের একটু টান বেশি থাকে। এর প্রধান কারণ মায়ের উদরেই সন্তান জন্ম নেয়। তাই তার শিশুসন্তানটি যদি কন্যা হয় তাহলে মা ভাবেন একদিন এ কন্যাশিশু আমার মতো মা হবে। তাই কন্যাশিশুর প্রতি মায়ের ভালোবাসা একটু বেশিই থাকে।

পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রেই সমাজের প্রধান ব্যক্তিই হচ্ছে পুরুষ। অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার আধিক্য বেশি। তবে বাংলাদেশের কিছু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মাঝে এর ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। যা হোক আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষরা সব সময় নারীদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। নারীদের একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন। তাদের স্বাধীনতা মতামতকে মূল্যায়ন করতে চায় না। সর্বোপরি নারীদের পথচলা এখনো সুগম হয়নি। অথচ নারীশিক্ষা প্রসার ঘটেছে তবুও তারা হত্যা, খুন, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে অহরহ। বলা যেতে পারে ঘরে বাইরে কোথাও নারীরা আজ নিরাপদ নয়। একজন অভিভাবক কখনো চায় না তার মেয়ে লাঞ্ছিত হোক, অপমানিত হোক। তাই বিয়ের উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দেন। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র্য এর বড় কারণ। ক্রমান্বয়ে আমাদের সমাজটা নষ্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমাদের নারীদের মূল্যায়ন করতে চায় না।

আমরা মুখে নারী স্বাধীনতা, নারীমুক্তির কথা বলি। নারী দিবস পালন করি। নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক সভা সেমিনার আয়োজন করা হয়। গলা ফাটিয়ে বিবৃতি দিই। প্রকৃতপক্ষে কি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের পথচলা সুগম করতে পেরেছে? নারীর স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছে। ক’জন তাদের বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে এসেছে! যৌতুক বা বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।

সরকার বাল্যবিয়ের হাত থেকে কন্যাশিশুকে রক্ষা ও শিক্ষাসহ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’-২০১৭ নামে একটি বিধান প্রণয়ন করে যা ইতোমধ্যে আইনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আইনটির কিছু ফাঁকফোকর রয়েছে। যা বাল্যবিয়ে রোধে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখবে না বলে নারীবাদী লেখক, বিজ্ঞ মহল মনে করেন। কিন্তু আইন দিয়ে সব কিছু হয় না। দেশে বিভিন্ন বিষয়ে অনেক আইন রয়েছে। কিন্তু আইনই সব কিছু নয়। আইনের ঊর্ধ্বে বিবেক, সচেতনতা বোধ, সৎ সাহস ইত্যাদি কিছু দিক রয়েছে।

কিন্তু আইন ছাড়াও যে সমাজের ভালো কিছু করা যায়, যৌতুক বাল্যবিয়ে রোধ করা হয় এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন অতীতে ফারজানা, শাহিদা আক্তার স্বর্ণা, শারমিন আক্তার। ফারজানা নামের মেয়েটি বিয়ের আসরে যৌতুক চাওয়ার অপরাধে বরকে তালাক দিয়ে উপস্থিত সবাইকে হতবাক করে প্রতিবাদী সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। স্বর্ণা বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন সৎ সাহস, প্রকৃত শিক্ষা, প্রতিবাদী মন থাকলে মেয়েরাও ভালো কিছু করতে পারে। শেষে শারমিন আক্তার নামে মেয়েটি নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে দেয়। ২০১৫ সালে ঝালকাঠির শারমিন আক্তার নিজের বিয়ে ঠেকিয়ে দিয়ে দেশ বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাহসী নারী সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের হাত থেকে তিনি এ পুরস্কার গ্রহণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ এখনো বাল্যবিয়ের হারে অন্যতম শীর্ষে। এ ধরনের বিয়ে লাখো শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও শিক্ষার জন্য হুমকিস্বরূপ। যা দেশগুলোর উন্নতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। নিজের চেয়ে অনেক বেশি বয়সের একজনকে বিয়ে করতে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে অসাধারণ সাহস ও আত্মবিশ্বাসের প্রশংসা করে দূতাবাস। বিশ্বব্যাপী শান্তি, ন্যায় বিচার, মানবাধিকার, লিঙ্গ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে জোরাল ভূমিকা ও সাহসী পদক্ষেপের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৭ সাল থেকে এ পুরস্কার দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর। সমাজের ক্ষতিগ্রস্ত ভয়ঙ্কর কথা, বাল্যবিয়ে ও জোরপূর্বক বিয়ের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে ভবিষ্যতে একজন আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন শারমিনের। পুরস্কার প্রাপ্তির পর তিনি বলেন, অনেক অত্যাচার, নির্যাতন, সহ্য করেও আমি প্রতিবাদ করেছি। আমি চাই আমার মতো বাংলাদেশের মেয়েরা প্রতিবাদ করুক, প্রতিবাদী হোক।

ঝালকাঠির কিশোরী শারমিন আক্তার যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেক্রেটারি অব স্ট্রেট, ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব ক্যারেজ’ পুরস্কার লাভ বাংলাদেশের জন্য সম্মান বয়ে আনে। আমরা তাকে অবশ্যই অভিনন্দন জানাই। এ স্বীকৃতি অবশ্য বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে রোধকল্পে কিশোরীদের সাহস ও উৎসাহ জোগাবে। নিজের বিয়ে ঠেকাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া তার বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতা অবশ্যই প্রশংসনীয়।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর তার সাহসিকতার পুরস্কার ও সম্মান দিয়েছে। কারণ এমন সাহসিকতার প্রয়োজন রয়েছে। দোলা, ফারজানা, স্বর্ণা, শারমিন এক ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টান্ত। এমন দৃষ্টান্ত সবাই দেখাতে পারবে কি? সব কিশোরী তো দোলা, ফারজানা, স্বর্ণা বা শারমিনের মতো নয় যে যৌতুক, বাল্যবিয়ের হাত থেকে নিজেকে ও সমাজকে রক্ষা করবে। শুরুতে উল্লেখ করেছি, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? তবে আশার কথা এই, তা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। ময়মনসিংহের সাত সাহসী অদম্য ছাত্রী বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে তখন রুখে দাঁড়িয়েছিল।

গড়ে তুলেছে ঘাসফুল নামে এক সামাজিক সংগঠন। যেখানে বাল্যবিয়ে সেখানে ওরা সাতজন। অভিভাবকদের বলে-কয়ে বুঝিয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধ করছে। ওরা সাহসী হয়ে শপথ নিয়েছে বাল্যবিয়ে বন্ধ করার। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেটা করতে পারছে না সেখানে নারী হয়ে তারা প্রতিবাদ, সাহসী হয়ে এগিয়ে এসেছে। দোলা, শারমিনের পাশাপাশি ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই তাদের সহচরদের যারা ইভটিজিং, বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সাহসী ভূমিকা নিয়ে দাঁড়াচ্ছে মেয়েদের পাশে। দোলার সঙ্গেও রয়েছে বেশ কয়েকজন মেয়ে যারা বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে।

একটু সাহস, প্রতিবাদী উদ্যোগী হলে বিড়ালের গলায়ও ঘণ্টা বাঁধা যায় এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে দোলা, শারমিনরা। বলতে ইচ্ছে হয়- ওহে কন্যা, তোমরা একা নও, তোমাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে কয়েকজন সাহসী অদম্য ছাত্রী। বাংলার ঘরে ঘরে এমন সৎ সাহসী প্রতিবাদী নারীর জন্ম হোক। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পরিবর্তন আসুক। অভিবাদন জানাই।

মোহাম্মদ নজাবত আলী : শিক্ষক ও লেখক

 
Electronic Paper