ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পর্যটন দিবসে প্রত্যাশা

ফারহান ইশরাক
🕐 ১১:৫৭ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২০

অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। এ দেশের দক্ষিণে রয়েছে সুবিশাল বঙ্গোপসাগর, কক্সবাজারে রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। রয়েছে হাজারো প্রজাতির গাছ, লতা, পাতা, পশু, পাখি, জীবজন্তুতে পরিপূর্ণ সুন্দরবন। পার্বত্য অঞ্চলে রয়েছে সারি সারি পাহাড়, ঝরনা, পাহাড়ি ঢল থেকে নেমে আসা জলপ্রপাত; তা থেকে সৃষ্ট নদী। এমন অসংখ্য প্রাকৃতিক নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশ নামের ছোট্ট দেশটির বুকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনেরও বিশাল সমাহার রয়েছে দেশটিতে। কয়েক হাজার বছর ধরে বিভিন্ন জাতি, পরিবার, শাসকগোষ্ঠী এ অঞ্চল শাসন করেছে। নিজেদের স্বার্থেই তারা গড়ে তুলেছে সুরম্য প্রাসাদ, কাছারি ঘর, মসজিদ, মন্দির, মঠ, বিহারসহ অসংখ্য স্থাপত্য। সেন, পাল, মৌর্য, মোঘল কিংবা ইংরেজ আমলের হাজারো প্রাচীন নিদর্শন আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রয়েছে স্থানীয় ভূপতি, জমিদারদের তৈরি বিশালাকার সব দালানকোঠা। হাজার বছর পূর্বের সভ্যতার এইসব নিদর্শন আর অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মিশেলে পর্যটকদের নিকট বাংলাদেশ বরাবরই এক দারুণ বিচরণক্ষেত্র। বিভিন্ন প্রতিকূলতা ও সমস্যা সত্ত্বেও তাই প্রতিবছর বিশ্বের নানা প্রান্ত হতে লক্ষ লক্ষ পর্যটক এদেশে পাড়ি জমান। ঘুরে দেখেন বাংলার পথ, ঘাট, নদী, গ্রাম, প্রান্তর। পর্যটকদের কল্যাণে বাংলাদেশ যেমন বহির্বিশ্বে সুনাম অর্জন করে, পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও সমৃদ্ধি লাভ করে থাকে।

বাংলাদেশের পর্যটনের ইতিহাস সুপ্রাচীন। বহু বছর পূর্ব থেকেই অসংখ্য পর্যটক, পরিব্রাজক এ অঞ্চলে ছুটে এসেছেন। প্রাচীন বাংলার পর্যটকদের মুগ্ধ করার মতো অসংখ্য নিয়ামক ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বাংলার বিস্তৃত সবুজ জনপদ, পলিমাটি, জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নদ, নদী, খাল, বিল, জলাশয় ছিল পর্যটকদের আকর্ষণের মূল কারণ। বছরের ছয় ঋতুতে মোহনীয় সাজে সজ্জিত হয় সমগ্র বাংলাদেশ। এ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্যও বহু মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে এ অঞ্চলে বেড়াতে আসত। বাংলার প্রকৃতি, নদী, হাওয়া, জল, এদেশের আবহমান সংস্কৃতি, সাধারণ মানুষের জীবনাচরণ ভিনদেশি পর্যটকদের বিমোহিত করত। এ কারণেই বছরের পর বছর ধরে সৌন্দর্যপিপাসু অসংখ্য পর্যটকের সমাগম ঘটেছে এ বাংলায়। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, খ্রিস্টের জন্মের পূর্ব থেকেই পর্যটকরা বাংলাদেশ ভ্রমণে আসতে থাকেন। পরবর্তী সময়েও তাদের এ রীতি বজায় ছিল। প্রাচীন আমলে বাংলা ভ্রমণে এসেছিলেন এমন হাজারো পর্যটকের মধ্যে প্রসিদ্ধ অর্থনীতিবিদ চাণক্যের নাম উল্লেখযোগ্য। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে তিনি বাংলা ভ্রমণে এসেছিলেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বর্ণনায় সে সময়ের মানুষদের জীবন, পেশা, শখের কাজ সম্পর্কে তিনি ধারণা দিয়েছেন। এছাড়াও চীনের পর্যটক ফা হিয়েন, বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হিউয়েন সাং, চীনের ই সিং, মা হুয়াং, ফেই সিন, ইতালির মানুচ্চি, বিখ্যাত বিজ্ঞানী টলেমিসহ অসংখ্য পর্যটক বাংলা ভ্রমণে এসেছিলেন। এসেছিলেন বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা। তাদের লিখিত গ্রন্থ ও বর্ণনা থেকে প্রাচীন বাংলার পর্যটনের সমৃদ্ধ ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। বাংলাদেশ যে সুপ্রাচীন কাল থেকেই পর্যটনভূমি হিসেবে পরিচিত, হাজার বছরের ইতিহাস সে সাক্ষ্যই দেয়।

বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের সুদীর্ঘকালের এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হলে পর্যটনকে ঘিরে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। সমগ্র বাংলাদেশে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবনের পাশাপাশি প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থান হিসেবে কুয়াকাটা, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত; সেন্টমার্টিন, ছেঁড়া দ্বীপ, মনপুরা, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপের মতো নয়নাভিরাম দ্বীপ; পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙামাটি, চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল; মধুপুর, ভাওয়াল, লাউয়াছড়ার মতো অসংখ্য বন, বনানী, উদ্যান অন্যতম। প্রাকৃতিক দর্শনীয় এ স্থানগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনেও বাংলাদেশ সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ইউনেস্কো কর্তৃক ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ বা বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত। মসজিদের নগরী বাগেরহাটকেও ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এছাড়াও মহাস্থানগড়, নাটোরের দীঘাপতিয়ার রাজবাড়ি, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিলসহ অসংখ্য পুরাকীর্তি রয়েছে সারা দেশে। রয়েছে অজস্র ঐতিহাসিক নিদর্শন। এ নিদর্শনগুলোকে ঘিরে যদি পর্যটন শিল্পের প্রসার ও বিকাশ ঘটানো যায়, তবে তা থেকে দেশ লাভবান হবে, লাভবান হবে অর্থনীতি।

পর্যটন শিল্পকে পৃথিবীর বৃহত্তম শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও পর্যটন সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। এ দেশে যে সকল প্রাকৃতিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে, তৎসংলগ্ন এলাকাকে যদি পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তবে পর্যটনকে একটি লাভজনক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে। এর ফলে দর্শনার্থীদের আগমনে সে অঞ্চল যেমন দ্রুত উন্নত হবে, তেমনিভাবে স্থানীয়ভাবে ব্যাপক কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে; দেশের বেকারত্ব সমস্যার সমাধানে যেটি সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারবে। অপরদিকে পর্যটন খাতকে প্রাধান্য দিয়ে অবকাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হলে, দেশের জাতীয় আয়ও সমানভাবে বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে দর্শনীয় স্থানগুলোর সংখ্যাধিক্য, সমভাবাপন্ন জলবায়ু ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে পর্যটনশিল্পের ব্যাপক প্রসার ও বিকাশ ঘটানো তুলনামূলক সহজসাধ্য। তবে তা অবশ্যই পরিকল্পনামাফিক হতে হবে।

পর্যটন খাতে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পর্যটনশিল্প এখনো সন্তোষজনক উন্নতি লাভ করতে পারেনি। তবে আশার কথা হলো, প্রতি বছর দেশে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা এবং পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমেই এটি সম্ভব হয়েছে। তবে এরপরেও পর্যটন খাত নানা সমস্যায় জর্জরিত। বাংলাদেশে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান থাকলেও উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্থান ব্যতীত রাজধানী শহর ঢাকা থেকে অন্যান্য স্থানগুলোর যাতায়াত ব্যবস্থা খুব একটা সহজ নয়। এর ফলে বহু পর্যটককে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। আবার, অনেক সময় প্রত্যন্ত কিংবা পাহাড়ি এলাকাগুলোতে চুরি, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। এর পাশাপাশি মানুষের অসচেতনতাও কোনো কোনো সময় দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট ও পর্যটন শিল্পের ক্ষতি সাধন করে থাকে। যেমন, দর্শনীয় স্থানগুলোতে যত্রতত্র ময়লা, আবর্জনা ফেলা, ঐতিহাসিক স্থাপনায় পোস্টারিং, দেয়াল লিখন, প্রয়োজনীয়

রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলা মানুষের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের অভিজ্ঞতা পর্যটকদের সে স্থান ভ্রমণে অনীহা সৃষ্টি করে।
পর্যটনকে লাভজনক শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এসব সমস্যার দ্রুত ও কার্যকর সমাধানের ব্যবস্থা করা দরকার। সারা বিশ্বের পর্যটকদের নিকট বাংলাদেশকে সঠিকভাবে ইতিবাচক উপায়ে উপস্থাপন করতে হবে। দেশের সকল দর্শনীয় স্থানের তালিকা, ভৌগোলিক অবস্থান, যাতায়াতের মাধ্যম, থাকার ব্যবস্থা, আবহাওয়া ইত্যাদি তথ্য অনলাইন পোর্টালে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই সন্নিবেশ করতে হবে এবং নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে। কোনো এলাকাকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে, সর্বপ্রথম সে স্থানের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো প্রয়োজন। এজন্য যে সকল দর্শনীয় স্থানে পর্যটকদের বেশি ভিড় করতে দেখা যায়, সেখানের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাস্তাঘাট সংস্কার ও পুনর্র্নিমাণ করতে হবে। সকল পর্যটন স্থানকে নিয়মিত পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে; প্রয়োজনবোধে লোকবল নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি পর্যটকদের জন্য ইন্টারনেট ও নেটওয়ার্কের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা জরুরি। এছাড়াও পর্যটকদের থাকার জন্য উন্নত আবাসিক হোটেল, মোটেল, যানবাহনের সহজপ্রাপ্যতা, নিরাপত্তা ও সার্বিক তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা করতে হবে। যদি এসকল সুবিধা সুষ্ঠুভাবে নিশ্চিত করা যায়, তবে অসংখ্য পর্যটক বাংলাদেশ ভ্রমণে আকৃষ্ট হবে এবং তারা নিজেরাই বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ব্র?্যান্ডিং করবে। এভাবেই পর্যটনশিল্পে উন্নত হয়ে উঠবে বাংলাদেশ। পর্যটকদের জন্য এসব সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টিও সম্ভব হবে। এর ফলে দেশ দু’ভাবেই উপকৃত হবে।

প্রতি বছর ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস পালিত হয়। পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা, সমস্যা ও সমাধান নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয় দিবসটিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এর কিছুকাল পরেই সে আলোচনায় ভাটার সৃষ্টি হয়। এ বছর সবকিছুর মতো পর্যটন খাতেও করোনার ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। ইতোমধ্যেই কয়েক হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। তবে অর্থনীতির অন্যান্য শাখার মতো পর্যটনখাতও ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিদ্যমান সমস্যাগুলোর যদি দ্রুত সমাধান করা যায় এবং পর্যটকদের যাবতীয় সুবিধা প্রদান করা সম্ভব হয়, তবে খুব শীঘ্রই পর্যটনখাতে বিশ্বের বুকে প্রথম সারির একটি দেশ হবে বাংলাদেশ। বিশ্ব পর্যটন দিবসে আমরা সে স্বপ্নই দেখি।

ফারহান ইশরাক : শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স
বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 
Electronic Paper