নারীর শৃঙ্খলমুক্তিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
ড. শাহনাজ পারভীন
🕐 ১১:৪২ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২০
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১ খ্রি.) উনবিংশ শতাব্দীর এক বিচক্ষণ পণ্ডিত ও মহান সমাজ-সংস্কারক। তিনি ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৮২০ খ্রি. ব্রিটিশ ভারতের হুগলি জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। একাধারে একজন লেখক, দার্শনিক, পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, অনুবাদক, প্রকাশক এবং সমাজ সংস্কারক ছিলেন। উনিশ শতকের সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের ক্ষয়িষ্ণুতার বিরুদ্ধে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের প্রয়োজন অত্যাবশকীয় হয়ে উঠেছিল। রেনেসাঁর মানবকল্যাণমুখী জাগরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নারী জাগরণ। নারীরা এতটাই দুর্বল, অধিকারহীন ও অক্ষম ছিল যে, নিপীড়িত হয়েও তারা নিজেদের মুক্তির কথা ভাবতেও পারেনি। এই সময়ে সমাজের সার্বিক প্রগতির জন্য যারা এগিয়ে আসেন, তাদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রি.), ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১ খ্রি.), মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭- ১৯০৫ খ্রি.) প্রমুখ।
সামগ্রিকভাবে সমাজ পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন তারা। ওই সময়ে বাংলার হিন্দু নারীরা যেমন বাঁচার অধিকার পেয়েছিল রাজা রামমোহন রায়ের কাছ থেকে, তেমনি শিক্ষা, সম্মানও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার পথ খুঁজে পেল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চেষ্টায়। তিনি ছিলেন বিত্তহীন কিন্তু সামাজিক মানমর্যাদাসম্পন্ন পণ্ডিত পরিবারের সন্তান। তার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাতে নানামুখী বাধার সম্মুখীন হন। কিন্তু তিনি কোনো অবস্থাতেই থেমে যাননি। তার পথ থেকে সরে আসেননি। তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে ন্যায়শাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র, বেদান্ত-সংস্কৃত বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। একান্ত চেষ্টা, একাগ্রতা, তার মানবতাধর্মী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি দরিদ্র বাবার দরিদ্র ছেলে হয়েও ‘দয়ার সাগর’ নামে বাংলার মানুষের মনে চিরদিনের জন্য স্থান করে নিয়েছেন। নারীশিক্ষায় বিদ্যাসাগরের অবদান ছিল অসামান্য।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘বিধাতা বিদ্যাসাগরের প্রতি বঙ্গভূমিকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন’। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘রামকৃষ্ণের পর, আমি বিদ্যাসাগরকে অনুসরণ করি।’ তিনিই ছিলেন বাংলার নবজাগরণের এক উজ্জ্বল পথিকৃৎ। তিনি বাল্যবিয়ের দোষ ও বিধবার পুনঃবিবাহ বিষয়ে বহু লেখালেখি, তর্ক উত্থাপন ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আইন প্রণয়নের চেষ্টা করে সফল হয়েছেন। এর শুরু তার মায়ের প্রেরণায়। যার একটি নিপুণ ইতিহাস আছে। যার বর্ণনা এই ছোট্ট লেখায় সম্ভব নয়। আমার নারী অধিকার ও অবস্থান শীর্ষক অভিসন্দর্ভে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয়, আখ্যানমঞ্জরী, ব্যাকরণ কৌমুদী, বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব দ্বিতীয় খণ্ডে, বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব দ্বিতীয় খণ্ডে, অতি অল্প হইল ১৮৭৩ খ্রি., আবার অতি অল্প হইল ১৮৭৩ খ্রি., ব্রজবিলাশ ১৮৮৪ খ্রি. উল্লেখযোগ্য।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজ-সংস্কারের সঙ্গে ধর্মকে সংযুক্ত না করে মানবতাবাদের ওপর ভিত্তি করে একান্ত নিজস্ব উদ্যোগে সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে ব্রতী হন। বিদ্যাসাগর ছিলেন একক সংগ্রামী। তিনি কোনো গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে প্রয়াসী হননি। রাজা রামমোহনের মতো ব্রাহ্মসমাজ অথবা ডিরোজিও’র নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর মতো কোনো প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তোলেননি। তিনি বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। তিনি ছিলেন নারীশিক্ষার বিস্তারের পথিকৃৎ।
তিনি উপলব্ধি করেন, নারীজাতির উন্নতি না ঘটলে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ড্রিংকওয়াটার বিটন উদ্যোগী হয়ে কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ভারতের প্রথম ভারতীয় বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যাসাগর ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক। এটি বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলায় মেয়েদের জন্য তিনি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায় স্ত্রীশিক্ষা বিধায়নী সম্মেলনী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে মে মাসের মধ্যে নদিয়া, বর্ধমান, হুগলী ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ১৩০০ ছাত্রী এ স্কুলগুলোতে পড়াশোনা করত। পরবর্তীকালে তিনি সরকারের কাছে ধারাবাহিক তদবির করে সরকার স্কুলগুলোর কিছু আর্থিক ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হয়।
১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮টি। এরপর কলকাতায় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত) এবং নিজের মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিজ গ্রাম বীরসিংহে ভগবতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলার সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এই সংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ। তার পরিচালিত সংস্কার আন্দোলনে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী চেতনার প্রতিফলন পড়েছিল। প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামির অপসারণ করে তিনি সমাজ জীবনকে কলুষমুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কারের প্রধান দিকটি ছিল নারী জাতির কল্যাণসাধন। সারাজীবন ধরে তিনি সমাজ-সংস্কারে ব্রতী থাকেন। বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন, নারী জাতি অনগ্রসর ও কুসংস্কারচ্ছন্ন হয়ে থাকলে সমাজ পিছিয়ে থাকবে। বিদ্যাসাগর নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবল সমর্থক ছিলেন। হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহের স্বপক্ষে জোর বক্তব্য রাখেন। বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ প্রভৃতি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি প্রবল জনমত গড়ে তোলেন। শেষপর্যন্ত তার আন্দোলন সফল হয় এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবা-বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে জোর প্রচার শুরু করেন এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত এক আবেদনপত্র সরকারের কাছে পেশ করেন। প্রধানত বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সরকারি আইন প্রণয়ন করে কন্যার বিবাহের বয়স সর্বনিম্ন দশ বছর নির্ধারণ করা হয়।
নারীশিক্ষা বিস্তারের ব্যাপারেও তার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদে থাকার সুযোগে তিনি ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হলো ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেবের সহযোগিতায় ‘হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়’ (বর্তমান বেথুন স্কুল) স্থাপন, মানবহিতৈষী, নারীমুক্তি আন্দোলন ও সাহিত্য আন্দোলনে বাংলার নবজাগরণ উল্লেখযোগ্য। অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ২৯ জুলাই ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে ৭০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ড. শাহনাজ পারভীন : সাহিত্যিক; উপাধ্যক্ষ, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর
[email protected]