কীভাবে তৈরি হয় ভ্যাকসিন
শেখ আনোয়ার
🕐 ১:৩২ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২০
ভ্যাকসিন, ভ্যাকসিন, ভ্যাকসিন! বিগত কয়েক মাস ভ্যাকসিন নিয়ে বাজার বেশ গরম। বেশিরভাগটাই যে যার মতো করে একটা গল্প-কাহিনিতে ঢেকে পরিবেশন করছেন। এর পেছনে যে প্রতিষেধক কোষের গভীর এবং জটিল প্রক্রিয়া কাজ করছে এবং একটা কার্যকরী ভ্যাকসিনকে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ পথ পেরোতে হয় সে কথাটা অনেক রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, কেউই বুঝতে চাইছেন না। কেউ বলছেন ভ্যাকসিন রেডি, কেউ বলছেন এই বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে পেয়ে যাবেন ভ্যাকসিন। আবার কেউবা বলছেন আগামী বছরের শুরুতে মিলবে ভ্যাকসিনের দেখা। একটা কথা জেনে রাখতে হবে, ভ্যাকসিন তৈরি সোয়ারিঘাটে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ কেনা নয়। নেতাদের কথা অনুযায়ী ভ্যাকসিন ট্রায়াল চলে না। তাই আসুন, জেনে নিই। কীভাবে তৈরি হয় এক জটিল অসুখের, এক অজানা ভাইরাসের ভ্যাকসিন? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী এ মুহূর্তে সাত রকম ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু হয়েছে। আরও অনেক ট্রায়ালের অপেক্ষায়। এ মুহূর্তে যেসব ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বেশ খানিকটা এগিয়েছে, সেসব বিশ্ব সেরা ক’টা ভ্যাকসিন নিয়ে আলোকপাত করা যাক।
অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন
অক্সফোর্ড ও এস্ট্রাজেনেকার তৈরি ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা চলছে। যাতে ৩০ হাজার স্বেচ্ছাসেবী যুক্ত করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি ব্রাজিলে পাঁচ হাজার স্বেচ্ছাসেবী এ ভ্যাকসিনের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। দুটো ধাপ সফল হওয়ার পর এই ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলছে মানবদেহে। ক’দিন আগে, এই ভ্যাকসিনের প্রতিক্রিয়ায় যে ত্রুটি ধরা পড়ে তা সংশোধন করে আবারও ট্রায়ালে নামানো হয়েছে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন। বলা হচ্ছে, এই ভ্যাকসিন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে এক বছরের জন্য সুরক্ষা দেবে। অক্সফোর্ড তাদের এই ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের ফলাফলের অপেক্ষার পাশাপাশি ভ্যাকসিন উৎপাদনও চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ২০০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন তৈরির ফরমায়েশ পেয়েছে অক্সফোর্ড। বিশ্বের এক ডজন সংস্থার সঙ্গে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করার চুক্তিও সই হয়েছে।
অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন আসলে কী
মানুষের মতো কাছাকাছি প্রাণী শিম্পাঞ্জিরও সর্দি কাশি হয়। এই শিম্পাঞ্জিকে এমন একটা ভাইরাসের (এডিনো ভাইরাস) মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যা করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের জিনসংকেত। শিম্পাঞ্জির এই ভাইরাস একটা দুর্বল সংস্করণ। এটা মানুষের শরীরের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলেও রোগ সৃষ্টি করতে পারে না। তাই মানুষের দেহের মধ্যে ভ্যাকসিন আকারে ঢুকে গিয়ে স্পাইক প্রোটিনের জিন সংকেতকে করোনাভাইরাস ব্যবহার করে বানিয়ে ফেলে নতুন স্পাইক প্রোটিন। এই প্রোটিনকে দেখেই বি সেল, টি সেল আর প্লাজমা সেলের সংঘবদ্ধ জোট বানিয়ে ফেলে স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে দেহের অ্যান্টিবডি কার্যকর হয়।
এরপর যখন সত্যি সত্যি করোনা সংক্রমণ হয়, তখন আগের থেকে রয়ে যাওয়া অ্যান্টিবডি এবং ই সেলের স্মৃতি থেকে বা মেমোরি বি সেল নতুন বানানো অ্যান্টিবডি আসল করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে আটকে গিয়ে তাকে অকেজো করে দেয় এবং কোষ বিধ্বংসী টি সেল অ্যান্টিবডির লেগে থাকাটাকে টার্গেট হিসেবে দেখে সংক্রমিত কোষকে ধ্বংস করে মানবদেহকে ভাইরাস মুক্ত করে। এখানে সরাসরি মানবদেহে ঢোকানো হচ্ছে স্পাইক প্রোটিনের জিন সংকেত বা এমআরএনএ। এটা লিপিড ন্যানো পার্টিকলে মোড়া এমআরএনএ। যা সরাসরি ঢুকে পড়ে দেহকোষে। দেহকোষের প্রোটিন বানানোর যন্ত্র রাইবোসোম বানিয়ে ফেলবে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন।
মডার্নার ভ্যাকসিন
অক্সফোর্ডের মতোই ভ্যাকসিন উৎপাদনে প্রথম সারিতে রয়েছে ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা মডার্না। চূড়ান্ত ধাপে মডার্নার ভ্যাকসিনের ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু হয়ে গেছে।
এর অ্যান্টিবডি তৈরির কার্য প্রণালিটা আগের বর্ণনার মতোই। এই পদ্ধতি কিন্তু কোনো অপরীক্ষিত পদ্ধতি নয়। বেশ ক’বছর আগেই মডার্নার বিজ্ঞানীরা এ পদ্ধতি বানরের ওপর সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করে সফল হয়েছেন। সেই গবেষণা ফলাফল প্রকাশিত হয়েছিল মলিকিউলার থেরাপি নামে এক গবেষণা জার্নালে। ইতোমধ্যে এ সংস্থা উৎপাদনের চুক্তিও করে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্রেরই ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা ক্যাটালেন্টের সঙ্গে। প্রথম ব্যাচেই ক্যাটালেন্ট ১০ কোটি ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। সম্প্রতি মডার্নার সিইও স্টিফেন বানসেল জানান, ‘মডার্নার ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ফল আগামী নভেম্বরের মধ্যে পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’
রাশিয়ার ভ্যাকসিন
অবশেষে চিন্তা কাটিয়ে বিশ্বকে প্রথম করোনা ভ্যাকসিন দিল রাশিয়া। অপেক্ষার আট মাস পর অবশেষে জনসাধারণের জন্য ভøাদিমির পুতিনের দেশই বিশ্বে প্রথম, যারা মানবদেহে এই ভ্যাকসিন ব্যবহারের জন্য অনুমতি দিল। অন্য কারও ওপর পরীক্ষা নয়। স্বয়ং পুতিনের মেয়েকে এই ভ্যাকসিন দেওয়ায় সেরে গেছে করোনা। এ ভ্যাকসিন তৈরি করেছে রাশিয়ার গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি। বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে প্রথম সারির প্রথমে উঠে এসেছে রাশিয়ার ভ্যাকসিন। এই ভ্যাকসিনে মানবদেহে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এখনো দেখা যায়নি। বরং দাবি করা হচ্ছে যে, মানবদেহে অত্যন্ত সফলভাবে এ ভ্যাকসিন প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করছে। ট্রায়ালের ফলাফল অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম রাশিয়ার এ ভ্যাকসিন।
কীভাবে কাজ করে রাশিয়ার ভ্যাকসিন
রাশিয়ার এই ভ্যাকসিন মূলত সারস-কোভ-২ অ্যাডেনোভাইরাস ডিএনএ-এ নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এটা করোনাভাইরাসকে ল্যাবেই দুর্বল করে বিশেষভাবে তৈরি করা এক ভ্যাকসিন। যাতে এই ভ্যাকসিন মানবদেহে ঢুকে নিউট্রোফিল, ইউসোনোফিল, বেসোফিলকে কাজে লাগিয়ে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম হয়। ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক গামালেয়া ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর আলেকজান্ডার গিন্টসবার্গ নিশ্চিত করে জানান, ‘এমনভাবে ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে যাতে ভাইরাসের ডিএনএ শরীরে ঢুকে কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’
ভ্যাকসিনের ক্লিনিকাল ট্রায়াল কীভাবে হয়
এবার জানা যাক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল কি? যে ভ্যাকসিনগুলোর কথা বলা হলো, সেসব ভ্যাকসিনের সবগুলোই প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লিনিকাল ট্রায়াল শেষ করেছে। মডার্নার ভ্যাকসিন দু’মাস আগে, আর অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের শুরু হয় সম্প্রতি। দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখা হচ্ছে, এই ভ্যাকসিন মানবদেহে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে কিনা এবং কিছু সময় অন্তর অন্তর টেস্ট করে দেখা হচ্ছে, সত্যিই এ স্পাইক প্রোটিন অ্যান্টিবডি তৈরি করছে কিনা? বা করলেও তার স্থায়িত্ব কতটা? ভ্যাকসিন দেওয়ার পর ই সেল, টি সেলকেও সেল সর্টিং মেশিনে যাচাই করে দেখা হচ্ছে। তারপর শুরু হবে পরবর্তী পর্যায়। এখানে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে দেওয়া হবে ভ্যাকসিন। একদলকে ভ্যাকসিনের বদলে দেওয়া হবে অন্য কিছু (হয়তো শুধুই স্যালাইন)। কিন্তু কেউ জানবে না, কে আসল ভ্যাকসিন পেল, আর কে পেল না। এটাকে বলে ব্লাইন্ড রেন্ডম স্যাম্পল। এ মানুষগুলো মহামারীর সময় জনজীবনেই মুক্ত অবস্থায় থাকবে। এবার দেখা হবে এই দু’দলের মধ্যে কারা কারা সংক্রমিত হলো আর কে কে হলো না। যদি দেখা যায়, যারা সত্যি ভ্যাকসিন পেয়েছে তাদের মধ্যে সংক্রমণ হয়নি এবং যারা সত্যি ভ্যাকসিন পায়নি তাদের মধ্যে সংক্রমণ বেশি। তাহলেই বোঝা যাবে দ্বিতীয় পর্যায়ে সাফল্য এসেছে। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বুঝতে গেলে, এরকম ব্লাইন্ড রেন্ডম স্টাডি অত্যন্ত প্রয়োজন। তারপর আরও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ওপর ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হবে। আর হ্যাঁ মনে রাখতে হবে, ভ্যাকসিনের ক্লিনিকাল ট্রায়াল চালাতে গেলে মহামারীর থাকাটাও দরকার। মানে যখন প্রচুর লোক সংক্রমিত হচ্ছেন। কথাটা শুনতে একটু খারাপ লাগলেও এমনটাই বিজ্ঞানে দস্তুর। সেটা না থাকলে বোঝা যাবে না ভ্যাকসিন নিয়ে যারা সংক্রমণ থেকে বেঁচে গেল তারা সত্যি কি ভ্যাকসিনের জন্য বাঁচল? নাকি মহামারীর প্রকোপ কমে গেলো বলেই বাঁচল?
বাংলাদেশে করোনা ভ্যাকসিন
ইতোমধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ভ্যাকসিন গ্রহণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। পাশাপাশি চীনের সিনোভ্যাকের সঙ্গে বাংলাদেশের আইসিডিডিআরবি ভ্যাকসিন ট্রায়াল শুরু করতে যাচ্ছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান গেল বায়োটেক করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের ঘোষণা দিয়েছে এবং দাবি করেছে তাদের প্রথম প্রাথমিক পরীক্ষা সফল হয়েছে। এতে দেশের মানুষ আনন্দিত ও আশান্বিত হয়েছেন। পাশাপাশি বাইরের একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারি ভিত্তিতে বাংলাদেশেও ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে কমপক্ষে দুটো দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকসিন ইউনিট। এর একটা ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস, আরেকটা হচ্ছে পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস।
বিশ্বের ভ্যাকসিন হিরো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক সফলতায় বাংলাদেশ ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। সংসদে সম্প্রতি রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা করোনা ভ্যাকসিনের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।
দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ‘বিশ্বের যেখানেই করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উদ্ভাবন সফল হবে, সেখান থেকেই তা বাংলাদেশের মানুষের জন্য সংগ্রহ করা হবে। সরকার ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য অর্থও বরাদ্দ রেখেছে। দেশের মানুষকে করোনা থেকে মুক্ত করার জন্য যা যা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা নেওয়া হয়েছে। রাশিয়া সরকারের কাছেও ভ্যাকসিন আমদানির ব্যাপারে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। যারাই প্রথম বাজারজাত করুক না কেন, বাংলাদেশ প্রথম ধাপেই পেয়ে যাবে ভ্যাকসিন।’ অতএব ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিয়ে দেশবাসীর কোনো উদ্বিগ্নতা নেই। প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণে ভ্যাকসিনের প্রথম সুযোগটাই হয়তো পাবে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে একটা বিরাট কর্মযজ্ঞ চলছে তার থেকে একটা সূর্যোদয় হবেই। এ আঁধার কাটবেই। তখন যেন আমরা ভুলে না যাই এ পর্দার আড়ালে থাকা বিজ্ঞানীদের কথা।
শেখ আনোয়ার : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]