ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে

শাহীন চৌধুরী ডলি
🕐 ১০:৫৭ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২০

পেঁয়াজের কুশীলবরা গতবছর যা করেছে সেটা মনে রেখে আমরা কতটা সতর্ক হয়েছি? গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে পেঁয়াজকা-ের শুরু। ভারত গত বছরের সেপ্টেম্বরে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেছিল এবং চলতি বছরের মার্চে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তখন পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীলতা হারায়। দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধিতে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম তিনশত টাকার মাইলফলক ছুঁয়েছিল। ঠিক এক বছরের মাথায় এই বছর আবার ১৪ সেপ্টেম্বর সোমবার ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। অনেকে গতবারের জুজুর ভয়ে মানুষ পেঁয়াজ কিনে মজুদ রাখতে বাজারে ছুটছেন। এই মূল্যবৃদ্ধির লাগাম এখনই শক্ত হাতে টেনে ধরতে হবে। গতবছর মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তরা রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহার কমাতে কমাতে অনেক রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার বন্ধই করে দিয়েছিল।

পরিবারগুলোতে পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার চর্চা শুরু হয়েছিল। খেটেখাওয়া মানুষদের পান্তা ভাতে পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচ বিলাসিতা হয়ে উঠেছিল। বর্তমানে পুনরায় একই অবস্থায় পড়তে হচ্ছে। ৬০ টাকার কাঁচামরিচ ২০০-২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে প্রতিটি জিনিসের চড়া মূল্যে নাভিশ্বাস অবস্থা। সবজির দামও নাগালের বাইরে প্রায়। চাল, ভোজ্য তেল, আলু, ডিম, আদা, মাংস ইত্যাদির দাম বেড়েছে। এই অবস্থায় পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি সীমিত আয়ের পরিবারে নতুন করে চাপ বাড়িয়েছে। গত বছর পেঁয়াজ ব্যবসায়ীরা চাপ সামলাতে ভারতের বাইরের কয়েকটি দেশ থেকেও আমদানি করেছিল। আকাশপথেও দেশে পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছিল। এবছরও ট্যারিফ কমিশন কর্মকর্তারা ভারতের বাইরে অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির সুপারিশ করেছেন। বাংলাদেশের জন্য ভারতের বিকল্প উৎস হয়ে উঠতে পারে চীন, পাকিস্তান, মিয়ানমার, মিশর, তুরস্ক, আফগানিস্তান, মালয়েশিয়া এবং নেদারল্যান্ড। 

কোনো প্রকার ঘোষণা ছাড়াই ভারত হঠাৎ করে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিল। ভারত প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে পেঁয়াজ রপ্তানিতে বাধা দেবে, এখন থেকে এই সত্যটা মনে রেখে আমাদের বিকল্প উপায়ে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ কয়েক বছর ইলিশ রপ্তানি বন্ধ রেখেছিল। সরকার গতবছর এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। উপহার হিসেবে গত বছরের পুজোতে ভারতে ৫০০ টন ইলিশ পাঠানো হয়েছিল। এই বছর পুজো উপলক্ষে পাঠানো হলো প্রায় দেড় হাজার টন ইলিশ। যেদিন বাংলাদেশ ইলিশ পাঠাল একই দিনে ভারত সরকার বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। কয়েকদিনের সময় দিয়ে বাংলাদেশকে অবহিত করতে পারত। অথবা নতুনভাবে মূল্যবৃদ্ধি করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানি করতে পারত। গতবছর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অক্টোবরে ভারত সফরে গিয়ে পেঁয়াজ প্রসঙ্গে কথা বলেছিলেন।

৪ অক্টোবর বাংলাদেশ-ভারত বিজনেস ফোরামের সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘ভারত হুট করে রপ্তানি বন্ধ করে দিল। আমরা পড়ে গেলাম বেজায় অসুবিধায়। একটু বলে-কয়ে সিদ্ধান্ত নিলে আমরা বিকল্প খোঁজার সময় পেতাম।’

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভারত ভালো চোখে দেখছে না। বর্তমানে তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর যুগোপযোগী অগ্রগতিতেও ভারত খুশি নয়। তবে কি পেঁয়াজকা-ের সঙ্গে রাজনীতির যোগসূত্র আছে? বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা সব দেশের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রেখে দেশকে এগিয়ে নিতে চাই। কিছুটা অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করছি, বলতে পারেন ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি। তিস্তার পানি আমাদের ন্যায্য অধিকার, ভাটির দেশ বাংলাদেশের উজান থেকে নেমে আসা নদ-নদীর পানিতে ন্যায্য হিস্যা আছে। সেই হিস্যা ভারত আমাদের অদ্যবধি দেয়নি।

নানা অজুহাতে তারা শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রাখছে। বর্ষায় বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে বন্যায় ভাসাচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে তারা পাখির মতন গুলি করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে মারছে। লোক দেখানো হালকা প্রতিবাদে এর সমাধান হবে বলে মনে করি না। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে এর দ্রুত সমাধান খুব প্রয়োজন। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমরা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতকে যেভাবে পাশে পাব বলে আশা করেছিলাম, বাস্তবতা তার একেবারেই উল্টো। মুখে বন্ধুত্বের কথা বলে কাজে তা প্রমাণ করতে না পারলে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত পাশে ছিল। আমরা সেটা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করি। তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ের সম্পর্কে টানাপোড়েন নেই বলেই বিশ্বাস করি। ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী বন্ধুপ্রতিম দেশ। স্বাধীনতার অর্ধশত বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে সুন্দর এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী দেশের সংখ্যা সময়ের সঙ্গে বাড়ছে। আমাদের আছে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক দিকসহ অন্যান্য দিকে খুব সাদৃশ্য আছে।

আমাদের দুই প্রতিবেশী দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব নেই। নিয়মিত সংস্কৃতির বিনিময় হচ্ছে যাতে দুই দেশের কবি-সাহিত্যিকরা অংশগ্রহণে। এমন অনেক ভারতীয় সাহিত্যিক আছেন যাদের সঙ্গে আমি অন্তর থেকে বড় বেশি হৃদ্যতা অনুভব করি। তাদের কাছ থেকেও অনুরূপ হার্দিক ব্যবহার পাই। ভারতের রেমিট্যান্স অর্জনে শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। পর্যটন, চিকিৎসা, ব্যবসা, শিক্ষা প্রতিটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
ভারত তাদের নিজেদের প্রয়োজনটা আগে দেখবে এটাই স্বাভাবিক। তবে নোটিস দিয়ে কাজ করলে আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকে। এটাই আমরা বন্ধুপ্রতিম দেশের কাছ থেকে পাচ্ছি না। অবস্থাদৃষ্টে বুঝতে পারছি, কিছু কিছু পণ্যের জন্য একমাত্র ভারতের ওপর নির্ভরশীল থাকলে চলবে না। যার মধ্যে পেঁয়াজের কথা মাথায় রাখতে হবে। ভারতের নিজেদের প্রয়োজনে বা রাজনৈতিক কারণে তাদের কাছ থেকে আমদানিকৃত যেকোনো পণ্যে তারা নিষেধাজ্ঞা দিতেই পারে। আমাদের উচিত হবে যতটা সম্ভব নিজ দেশে উৎপাদন বাড়ানো।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। আমাদের দেশের কিছু অঞ্চলের মাটি পেঁয়াজ চাষের উপযুক্ত। আমাদের দেশের কৃষকরা পেঁয়াজ ফলায়। দেশের চাহিদার ৬০ ভাগ দেশেই উৎপাদিত হয়, বাকি ৪০ ভাগ পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আমদানির ৯৫ ভাগ আসে ভারত থেকে। বাকি পেঁয়াজ আসে মিয়ানমার, মিশর ও তুরস্ক থেকে। চট্টগ্রামের পেঁয়াজ আমদানিকারকদের সঙ্গে আলাপে জানা যায় দূরত্বের কারণে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে খরচ কম পড়ে। অল্প মূল্যে ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারজাত করা যায়। ভারতের বাইরে অন্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে কেজি প্রতি ৫০-৫৭ টাকা খরচ পড়ে, এতে বিক্রয়মূল্য বেড়ে যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা অন্যান্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির চেষ্টা করছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভ্যন্তরীণভাবে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ উৎপাদন করতে না পারলে যেকোনো সময় এমন সংকট আবার দেখা দিতে পারে। চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষক যতটা আগ্রহী, পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ততটা নয়। কারণ চাল উৎপাদন অপেক্ষাকৃত লাভজনক। পেঁয়াজ উৎপাদনে কিছু অন্তরায় আছে। বাংলাদেশে সাধারণত শীতকালে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। গ্রীষ্মে পেঁয়াজ উৎপাদন করা গেলেও সেগুলো বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না। গ্রীষ্মকালে জমিতে পানি জমে পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত কোল্ড স্টোরেজের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সব ধরনের কোল্ড স্টোরেজে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায় না। সব ধরনের জমিতে পেঁয়াজের ভালো ফলনও হয় না। বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিম জেলাগুলোতে পেঁয়াজের ভালো ফলন হয়। কৃষকদের ভাষ্যমতে পেঁয়াজে লাভ কম। চালে লাভ বেশি। পেঁয়াজ দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। একটু বৃষ্টি হলে জমিতে পানি ওঠে পেঁয়াজ পচে যাওয়ায় অনেক লোকসান হয়।

আমাদের আছে কর্মক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠী। তাদের সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কৃষিকাজে শিক্ষিত বেকার যুবকদের উৎসাহিত করতে তাদের নানান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হোক। সবসময় প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য বিকল্প কয়েকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হবে যাতে প্রয়োজনে সাধারণ মানুষকে বেশি দামে পণ্য কেনার কষ্টে নিপতিত হতে না হয়। এমনিতেই করোনায় সাধারণ মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে আছে। পেঁয়াজের মূল্য গতবছরের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে দেওয়ার ভুল এ বছর করা যাবে না। যারা সিন্ডিকেট কারসাজিতে মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় তাদের প্রতি প্রশাসনের কড়া নজরদারি বাড়াতে হবে।

খাদ্য মজুদ করে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। মজুদদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা আবশ্যক বলে মনে করি। ইতোমধ্যে বিভাগীয় শহরসহ বিভিন্ন জেলা শহরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হচ্ছে। জরিমানার ভয়ে অনেক দোকানি দোকান থেকে পেঁয়াজ সরিয়ে ফেলছে। অনেকে গা-ঢাকা দিচ্ছে। অনেক ক্রেতারাও দাম আরও বাড়বে শঙ্কায় পেঁয়াজ মজুদ করছে। পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধিতে সরকার শক্ত হাতে লাগাম টেনে ধরলে করোনায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কিছুটা কমবে বলে আশা করি। টিসিবি দেশের বিভাগীয় শহর ও জেলার ২৭৬টি জায়গায় কেজিপ্রতি ৩০ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। বাজারে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্রেতা সামলানোর চাপে টিসিবির বিক্রেতাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। কম দামে এক কেজি পেঁয়াজের জন্য অনেক ক্রেতা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে।

রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহার কমিয়ে দিলেও চাপ সামাল দেওয়া অনেকটা সহজ হবে। বাজার ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য বজায় রাখতে সরকারের উপযুক্ত মনিটরিং অব্যাহত রাখা উচিত। ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা করার মানসিকতা থেকে সরে আসতে হবে। বেশি বেশি পেঁয়াজ চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করতে সরকারিভাবে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো জরুরি। পেঁয়াজ সংরক্ষণের উপযুক্ত কোন্ড স্টোরেজ নির্মাণের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী কাজ করা গেলে এবং সঠিকভাবে বাজারজাত করা গেলে আমদানি নির্ভরশীলতা অনেকাংশে কমবে। আমদানিতে অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমানো গেলে ভবিষ্যতে সংকটে পড়তে হবে না।

শাহীন চৌধুরী ডলি : সাহিত্যিক ও কলাম লেখক
[email protected]

 
Electronic Paper