ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

গরিব মানুষ বাঁচবে কীভাবে

আরাফাত শাহীন
🕐 ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২০

কিছুদিন পূর্বে জেলা শহর মাগুরা থেকে বাড়িতে ফিরছিলাম। শহর থেকে আমার বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে। এই পথ অতিক্রম করার জন্য বাস কিংবা অটোরিকশা ব্যবহার করা যায়। সঙ্গে অসুস্থ বাবা ছিলেন বলে বাসের পরিবর্তে অটোরিকশায় আসার সিদ্ধান্ত নিই। আমরা অটোরিকশায় বসার পর অনেক সময় পেরিয়ে যায়, কিন্তু চালকের কোনো ভাবান্তর নেই। বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও তিনি তেমন কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না। একপর্যায়ে রেগে গিয়ে অটোরিকশা থেকে নেমে যাওয়ার হুমকি দিলাম। তিনি এবার বেশ নরম গলায় বললেন, ‘ভাই, এখানে গাড়ি দাঁড় করানোর জন্য আমাকে ৫০ টাকা দিতে হবে। এখন আমি যদি যাত্রী ভর্তি না করে রওনা দিই তাহলে আমার লোকসান হয়ে যাবে।’

চালকের এমন কথা শুনে খানিকটা ধাক্কা খেলাম। এখানে টাকা জমা দিতে হবে কেন! সে সময় তাকে বেশি ঘাটালাম না। অটোরিকশা চলা শুরু হলে তারপর জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে টাকা দিতে হবে কেন?’

‘স্থানীয় কিছু ছেলেপেলে এসে টাকা নিয়ে যায়। কিছু বলার উপায় নেই। প্রতি ট্রিপে আমাদের ৫০ টাকা করে জমা দিতে হয়।’

বিষয়টা গুরুতর বলে মনে হল আমার। একজন অটোরিকশা চালক দিনে কত টাকাই বা আয় করে! সেই টাকা থেকে যদি এভাবে চাঁদা দিতে হয় তাহলে তো তার বেঁচে থাকা কষ্টকর। অনেকে ভাড়ায় গাড়ি চালায়। তাদের অবস্থা তো তাহলে আরও করুণ।

একবার মাগুরা থেকে বাসে করে রাজশাহীতে যাচ্ছিলাম। ঝিনাইদহের একটা জায়গায় রাস্তার পাশে কিছু লোক চেয়ার নিয়ে বসা। বাস থামিয়ে তাদের চাঁদা দিয়ে তারপর যেতে হল। কী করুণ অবস্থা চিন্তা করে দেখুন। স্বাভাবিক সময়ে যেমন-তেমন, ঈদের সময়ে যে পরিমাণ চাঁদাবাজি হয় মহাসড়কে সেটা চিন্তারও বাইরে। পরিবহন সেক্টরে এত অনিয়ম কেন? বছরের পর বছর চেষ্টা করেও এর সমাধান আজও করা সম্ভব হয়নি কেন? পরিবহন শ্রমিকরা মূলত গোলকধাঁধায় নিপতিত। তারা যে টাকা রোজগার করে তার একটা বড় অংশ চলে যায় তথাকথিত নেতাদের পকেটে। তাদের খুশি করতে না পারলে রাস্তায় গাড়ি চালানো সম্ভব হয় না। ফলে নিজেদের টিকিয়ে রাখার তাগিদেই যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায়সহ বেপরোয়া চলাচল করে চালকরা। চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্য থামাতে না পারলে পরিবহন খাতে উন্নতি করার কোনো সুযোগ নেই।

নিম্নআয়ের এই পরিবহন শ্রমিকদের নিশ্চয়ই সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। সঙ্গত কারণেই এদেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে কৃষি উৎপাদন পূর্বের চেয়ে বহুগুণে বেড়েছে। ফলে একটা সময়ে আমরা কৃষিপণ্যের ওপর যেভাবে আমদানিনির্ভর ছিলাম, ধীরে ধীরে সেটা অনেকাংশে কমে আসছে। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার দিকে অনেকটাই এগিয়েছে। প্রতিনিয়ত নগরায়ণ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে চাষের জমি ভয়ানকভাবে কমে আসছে। ফলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার নানাভাবে কৃষকদের সহযোগিতা করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের কারও অজানা নয়। কিন্তু দেখেছি, সরকারের দেওয়া সকল সুবিধা কিন্তু কৃষকরা সময়মতো পায় না। আবার মাঝেমধ্যেই কৃষিপণ্যের দাম হুট করে কমে যেতে দেখেছি।

বেশিরভাগ সময় কৃষকরা উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পায় না। প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম সারা বছরই বেশি থাকে। তাহলে কৃষক কেন তার ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়? এর কারণ হল, এক শ্রেণির মজুদদার। এরা ফসলের মৌসুমে কম দামে কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনে মজুদ করে রাখে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কিছুদিন পর পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কিন্তু সেই দামটা পায় মধ্যস্বত্বভোগী। দরিদ্র কৃষকের বেঁচে থাকাটাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। মহামারী করোনা ভয়ানক থাবা বিস্তার করার মাধ্যমে পৃথিবীকে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। বহু মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এই সময়ে অনেক চাকরিজীবী চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। যারা সরকারি চাকরি করেন তারা তেমন কোনো আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন না হলেও বেসরকারি চাকরিজীবীরা নানান সংকটে পতিত হয়েছেন। কিছু মানুষ তাদের স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেলেও যারা যেতে পারেননি তাদের ভোগান্তি একেবারে সামান্য নয়।

একদিকে মানুষ আর্থিক সংকট, অপরদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল জিনিসের দামই প্রতিনিয়ত হু হু করে বাড়ছে। ট্যাক্সের পরিমাণও পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। কোনো একটা দেশে যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায় তখন সেটা দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষের কাঁধে গিয়েই পড়ে। ফলে তাদের বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়ে। মহামারী আমাদের বহুমুখী সংকটে নিমজ্জিত করেছে। হয়তো সব বিষয় বর্ণনা করেও শেষ করতে পারব না। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত গ্রামের খেটেখাওয়া মানুষের সন্তানরাই অধিক পরিমাণে পড়াশোনা করে। ধনীদের জন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার অবারিত হলেও সেখানে দরিদ্র মানুষের সন্তানদের একপ্রকার প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে।

ফলে দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের সর্বাগ্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার চেষ্টা করতে হয়। সেই সুযোগটাও যারা পায় না, তাদের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজগুলো রয়েছে। সরকারি এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে সমস্ত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে তাদের অধিকাংশই টিউশনি কিংবা অন্য উপায়ে পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি কেউ কেউ পরিবারকেও সহযোগিতা করে থাকে। কিন্তু বর্তমান সময়ে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা সেই সুযোগটা পাচ্ছে না। একটা দীর্ঘ সময় বাড়িতে বসে থেকে পরিবারের বোঝা হয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকছে না। এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও কেউ কেউ উদ্যোক্তা হয়ে নিজ পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমার পরিচিত অনেক বন্ধুবান্ধবই এই কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। কেউ কেউ সফলতাও লাভ করছে। কিন্তু এই বিরূপ পরিবেশে সবার পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না।

পৃথিবীতে খেটেখাওয়া মানুষগুলো এ মুহূর্তে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে দিন অতিবাহিত করছে। মানুষের হাতে টাকাপয়সার টানাটানি। ফলে একেবারে প্রয়োজনের বাইরে কেউ খুব একটা খরচ করতে ইচ্ছুক নয়। পৃথিবী আজ স্পষ্ট দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একভাগে রয়েছে শাসক, ধনী এবং ক্ষমতাবান শ্রেণি; অপর ভাগে রয়েছে শাসিত, নিপীড়িত এবং দরিদ্র শ্রেণি। যার হাতে অর্থ রয়েছে সেই আজ শাসন করছে। একটা সময় অস্ত্রের বলে জমি দখল করে জনগণকে শাসন করা হত। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। পৃথিবীজুড়ে চলছে অর্থনৈতিক শাসন ও শোষণ। আগে একটা রাষ্ট্রকে দুর্বল করার জন্য সামরিক বাহিনী দিয়ে অবরোধ করা হত। আর এখন অবরোধ করা হয় অর্থনৈতিকভাবে। অবাক হয়ে দেখি, পৃথিবীর মোট সম্পদের বেশিরভাগই মাত্র কয়েকটা পরিবারের হাতে কুক্ষিগত। তারা অর্থনীতির লাগাম হাতে রেখে পুরো পৃথিবীর মানুষের মাঝে আধিপত্য বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছে।

এতে করে দিনদিন তারা যেমন আরও ফুলে-ফেঁপে উঠছে, তেমনি দরিদ্র মানুষ সকল সীমা অতিক্রম করে আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। গরিবের রক্তের ওপর পা দিয়ে যে মানুষগুলো আজ মহাসুখে মত্ত, তারা কিন্তু একবারও এসব মানুষের কথা ভেবে সময় নষ্ট করে না। এজন্যই তো আমরা দেখি, যে ব্যবসা ছিল পবিত্র পেশা সেটা কেমন জোচ্চুরি আর বাটপাড়িতে পরিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে তাতে সমাজের দরিদ্র মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যাদের রক্ত আর ঘামের ওপর ভর করে গড়ে উঠেছে আজকের সভ্যতা তাদের কেমন শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলার সমস্ত আয়োজন আমরা সম্পন্ন করে রেখেছি। অথচ আমরা ভেবে দেখি না এ মানুষগুলো টিকে থাকতে না পারলে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে পড়বে। ধনীদের নিজেদের টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে হলেও সমাজের দরিদ্র মানুষের দিকে মমতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। শুধু মুখে ফাঁকা বুলি আওড়ানো নয়, কাজেও প্রমাণ করে দেখাতে হবে।

আরাফাত শাহীন : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 
Electronic Paper