নির্যাতিত পুরুষের কথাও ভাবুন
শেখ আবুল খায়ের আনছারী
🕐 ১১:২৬ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২০
স্ত্রীকে বলা হয় অর্ধাঙ্গিনী। অর্থাৎ স্বামী এবং স্ত্রী দুজন মিলে তবেই সংসার পরিপূর্ণ ও সুখময় হয়। সংসারকে শান্তিপ্রিয় ও পরিপূর্ণ করতে দুজনের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। স্ত্রীর কিছু বিশেষ গুণ থাকলে স্বামী হতে পারে সৌভাগ্যবান। একটি আদর্শ পরিবার থেকে একটি আদর্শ জাতি গঠনে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। এজন্যই হয়ত কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। কিন্তু নারী প্রতিনিয়তই নিগৃহীত হচ্ছে পুরুষের হাতে। প্রায়ই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নারী নির্যাতনের খবর জানতে পারি। বর্তমানে পুরুষশাসিত সমাজে এটি একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। গ্রামে-শহরে, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নিচু থেকে উঁচু শ্রেণির প্রায় সব সমাজে নারী নির্যাতন চলছেই। নারী নির্যাতনের খবরগুলো ফলাও করে সংবাদমাধ্যমে প্রচার হয়ে থাকে। নারী নির্যাতন রোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সংগঠন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ কাজ করে যাচ্ছে। তবুও নারী নির্যাতন বন্ধ করা যাচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হতে পারে ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব এবং সামাজিক অনৈতিকতা।
সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে। আবার নারীর কারণে অসুখের ঠিকানাও হতে পারে। একজন নারী শুধু মা-ই নন, একজন অভিভাবক এবং রক্ষকও বটে। আমাদের সংসার জীবনে নারীরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর নারীরা আজ আমাদের দেশে জাতীয় পর্যায়ে অনন্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। তারপরও নারীরা বিভিন্নভাবে কখনো স্বামীর হাতে কিংবা স্বামী পরিবারের অন্য কারও হাতে নির্যাতিত নিপীড়িত হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রেও ভিন্ন পুরুষের হাতে নারী নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়। ধর্মীয় অনুশাসন না মানার কারণেই এমনটি হচ্ছে। ইসলাম নারী জাতিকে মায়ের আসনে অধিষ্ঠিত করে তাকে সম্মানিত করেছে। ইসলামপূর্ব যুগে নারীকে ভোগের পাত্র হিসেবে বিবেচনা করা হত। কিন্তু ইসলাম তাকে দিয়েছে মায়ের সম্মান। মনে রাখতে হবে, নারীর পূর্ণাঙ্গ অধিকার একমাত্র ইসলামই দিয়েছে।
পুরুষশাসিত এ সমাজে সবসময়ই আলোচনায় আসে নারী নির্যাতনের খবর। তবে জগৎ সংসারে শুধু পুরুষ দ্বারা নারীই নির্যাতিত হচ্ছে না বরং নারীর দ্বারাও পুরুষ নির্যাতিত হচ্ছে। কিন্তু সে খবর আলোচনায় আসছে না। সমাজের অনেক পুরুষ তার নিজ ঘরেই প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে। নারী নির্যাতনের কথা সবাই জানলেও পুরুষ নির্যাতনের কথা অজানাই থেকে যায়। বনের আগুন দেখে সবাই মনের আগুন অন্তরায় অনেকটা এই প্রবাদের মতোই। চক্ষুলজ্জা আর পরিবারের কথা চিন্তা করে দিনের পর দিন যে পুরুষ নীরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলছে তার খবর প্রচারমাধ্যমে আসছে না। পুরুষ অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, সমাজে অনেক পুরুষই কাঁদেন কিন্তু তাদের চোখের জল কেউ দেখে না। তাদের সঙ্গী হয় রাতের তারা। সন্তানের নিরাপত্তা আর সামাজিক নানা কটুকথার ভয়ে অনেকেই সহ্য করে চলেছেন স্ত্রীর নির্যাতন। এ ক্ষেত্রে অনেকেই শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হন এবং আর্থিকভাবে হয়ে থাকেন ক্ষতিগ্রস্ত।
নারী অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিয়ে অনেক মহলই সোচ্চার। কিন্তু আমাদের চিন্তা করতে হবে নারীর ক্ষমতায়ন সমাজে কী প্রভাব ফেলছে। ক্ষমতায়ন মানে এই নয় যে, পুরুষ তুমি আমার কথায় চলবে, আমি তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তুমি আমার দাসত্ব করবে। কিছু বিষয় পর্যালোচনা করলে সেটা আমরা বুঝতে পারব, পুরুষশাসিত সমাজেও নারী দ্বারা পুরুষ কতটা নির্যাতিত হয় এবং কীভাবে হয়। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে সমাজ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। বদলে যাওয়া সমাজের একটি রূপ হচ্ছে পুরুষ নির্যাতন। বর্তমান সমাজের বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসার বন্ধন আগের তুলনায় অনেকটাই হালকা।
এ ছাড়াও রয়েছে সামাজিক মূল্যবোধের অভাব, সামাজিক নৈতিক অবক্ষয়, লোভ-লালসা, উচ্চাভিলাস, পরকীয়া, মাদকাসক্তি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বিশ^ায়নের প্রভাবে ভিনদেশি কালচার অনুসরণ করে নারী হচ্ছে বেপরোয়া। এতে করে পরিবারে সম্পর্কের দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে এবং পরিবারে সমাজে বাড়ছে অশান্তি। নারী অধিকার, নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়নে যে সকল আইন আছে বর্তমানে নারীরা তার অপপ্রয়োগ করছে। সংসারে স্বামীর সঙ্গে সামান্যতম মনোমালিন্য হলেই নারীরা বিভিন্ন মামলা দিয়ে সহজেই পুরুষদের হয়রানি করছে। এর বিপরীতে পুরুষের জন্য এমন কোনো আইন না থাকায় পুরুষ বাধ্য হয়েই নারীর নির্যাতন মেনে নিচ্ছে। এভাবে ধীরে ধীরে আমাদের সমাজে নারী কর্তৃক পুরুষ নির্যাতন বাড়ছে।
সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদে নারীর অধিকারের কথা বলা হয়েছে। নারীর অধিকার ও সুরক্ষার জন্য দেশে একাধিক আইন রয়েছে। এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০, এসিড নিরোধ আইন ২০০২, পারিবারিক সহিংসতা ও দমন আইন ২০১০, যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীর সুরক্ষার জন্য আইনগুলো প্রণীত হলেও বর্তমানে এ আইনগুলোকে কিছু নারী পুরুষ দমনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। সামান্য কিছু হলেই স্বার্থান্বেষী নারী স্বামীকে নাজেহাল করতে এসব আইনের অপপ্রয়োগ করছে। অন্যদিকে দেশে পুরুষ নির্যাতন রোধে এখন পর্যন্ত কোনো আইন প্রণয়ন হয়নি। ফলে নির্যাতিত পুরুষরা আইনি সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন এবং এভাবেই পুরুষ নির্যাতিত হচ্ছে আর নিরুপায় হয়ে নীরবে সবকিছু সহ্য করে চলছে।
নারী অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, নারী নির্যাতন রোধে বিভিন্ন সংগঠন কাজ করে বলে তাদের পরিসংখ্যান পাওয়া যায় কিন্তু পুরুষ নির্যাতন নিয়ে সক্রিয় সংগঠনের কাছে তেমন কোনো পরিসংখ্যান নেই বলে তাদের খবর মিডিয়াতে আসে না। তবে সমাজবিজ্ঞানীদের মতে সমাজে পুরুষ নির্যাতনের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। লোকলজ্জার ভয়ে অনেকেই কারো কাছে কিছু না বললেও নীরবে অশ্রুপাত করেন ঠিকই। অনেকে আছেন, মনের দুঃখ প্রকাশ না করে আত্মহননের মতো সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেন। তাই পুরুষ নির্যাতন রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের দাবি। নারী কিংবা পুরুষ নয়, আমাদের মানুষ পরিচয়কেই বড় করে তুলতে হবে। নারী নির্যাতন, পুরুষ নির্যাতন কোনোটাই কাম্য নয়। পৃথিবীতে মানুষ ক’দিন বাঁচে! এই অল্প ক’টা দিন সবারই শান্তি ও স্বস্তির মধ্যে অতিবাহিত করা উচিত। জীবনসায়াহ্নে কাউকে যেন হাপিত্যেস করতে না হয়। বলতে না হয়, অহেতুকই আমি নির্যাতন করেছি কিংবা নির্যাতনের শিকার হয়েছি!
শেখ আবুল খায়ের আনছারী : কলাম লেখক
[email protected]