ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

নিম্নবর্গের ইতিহাস চেতনায় বঙ্গবন্ধু

রঞ্জনা বিশ্বাস
🕐 ৭:১৫ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৩, ২০২০

ইতিহাসের নিম্নবর্গের চেতনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত সকল মানুষ নির্বিশেষে তাদের নেতার মধ্যে ধর্মীয় নেতার অধিষ্ঠান বা আবির্ভাবের বার্তা খুঁজে পায়। স্বরাজ আন্দোলনের নেতা গান্ধীকে নিয়েও কৃষকদের মধ্যে অনুরূপ মনোভাব লক্ষ করা যায়। তারা তার বক্তব্যের মধ্যে এমন সব উপাদান খুঁজে বের করে যার মাধ্যমে তাকে দেবতুল্য জ্ঞান করা যায়। তারা গান্ধীর নামে ভিক্ষা চায় তার নামে ভোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। তাদের কাছে গান্ধী এক বিশেষ ধারণা। এই ধারণা একাধারে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক প্রকৃতির। নিম্নবর্গের মধ্যকার জাগতিক ধারণা যে আকাক্সক্ষা দ্বারা চালিত হয় তা-ই তাকে সমাবেশের একজন হয়ে উঠতে সাহায্য করে। আর আধ্যাত্মিকতার ধারণা তাকে অসাধ্য সাধনের ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

ফলে ঔপনিবেশিক আমলের সকল আন্দোলনকে বা সমাবেশকে দেখি অসফল হতে। নেতার প্রতি আধ্যাত্মিকতার ধারণা তৈরি হয় রাষ্ট্রের প্রধান বা সরকারকে প্রভু জ্ঞান করার কারণে। রাষ্ট্রের যিনি সর্বেসর্বা সেই প্রভুশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিততে হলে মানুষের ক্ষমতা দ্বারা তা সম্ভব নয় তাই তাদের এই অসাধ্যতার ধারণা থেকেই তাদের মধ্যে নেতাদের প্রতি আধ্যাত্মিক শক্তির ধারণা কল্পিত হয়। ঐতিহাসিক গবেষকগণ নিম্নবর্গের ইতিহাস ও রাজনৈতিক চৈতন্যের মধ্যে এই বিশেষ লক্ষণ পরিস্ফুট হতে দেখেন। একে তারা বলেন ধর্মভাব। নিম্নবর্গের ইতিহাস রচয়িতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন- ‘ধর্মভাব বলতে আমি শুধু ধর্মীয় সংস্থার প্রতি আনুগত্য বোঝাচ্ছি না।

বোঝাচ্ছি চেতনার সেই ঐতরিক বা এলিয়েনেটেড অবস্থার কথা যার প্রভাবে জড়জগৎ বা জীবজগতের কোনও সত্তাকে, বাস্তবের বা ভাবনার অন্তর্গত কোনও বিষয়কে যথার্থভাবে ধারণার মধ্যে আনতে পারে না, এবং এক বিষয়ের ওপর আর এক বিষয়ের গুণ আরোপ করে। ফলে যা ঐহিক তাকে অলৌকিক বলে মনে হয়, যা একান্তই মানবিক তাকে দৈব বলে ভুল হয়।’ আর এই ভুল বারবার করেছেন নিম্নবর্গের মানুষ। তারা ঐতরিকতার আতিশয্যে নিজের সৃজন কর্মকে সঠিকভাবে চিনতে পারেন না, নিজের প্রতিভাজাত কর্মকে দেবতার কৃতিত্ব বলে চালিয়ে দিয়ে পরমানন্দ লাভ করেন। তাই মঙ্গল কাব্যের কোনও মহৎ কবির পক্ষে বলা সম্ভব যে তার রচনা তার নিজের নয়, আরাধ্যা দেবী তাকে দিয়ে লেখাচ্ছেন- কবি যন্ত্র, দেবী যন্ত্রী।

একইভাবে সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাসে বিদ্রোহের নেতা সিধু ও কানু নিজের লড়াইটাকে আখ্যা দিয়েছেন ঠাকুরের লড়াই হিসেবে। অর্থাৎ ইংরেজের সঙ্গে সাঁওতালদের লড়াই হচ্ছে ইংরেজদের সঙ্গে ঠাকুরের লড়াই। এর কারণÑ গবেষকরা বলেন, সাধারণ নিম্নবর্গের মানুষ নিজেদের ক্ষমতাকে চিনতে পারছে না তাই তারা একে ঐশ্বরিক বলে কল্পনা করছে। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘...সাধারণ মানুষের চোখে, বিশেষ করে রাজধানী ও শহর থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে গ্রাম ও মফস্বলে যারা থাকে তাদের চোখে রাষ্ট্রের সামগ্রিক চেহারাটা সহজে ধরা পড়ে না।

তারা রাষ্ট্রশক্তিকে দেখে তার স্থানীয় প্রতিনিধিদের ক্ষমতার গোষ্পদে। আর তাদের ধারণায় রাষ্ট্রের সামগ্রিক ও স্থানীয় রূপের মধ্যে যে ফাঁকা জায়গাটা থাকে তা তারা ভরে দেয় ক্ষমতার প্রকৃতি ও প্রয়োগ সম্পর্কে নানা রকম অলৌকিক বিশ্বাস দিয়ে। এজন্যই ক্ষমতার পিরামিডের তলায় যারা একেবারেই মাটির কাছাকাছি সেই নিম্নবর্গের কাছে পিরামিডের শীর্ষস্থ রাজশক্তিকে দেবশক্তি বলে মনে হয়।’ আর একারণে ভারতবর্ষের নিম্নবর্গের অনেক বিদ্রোহ বা বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে রাজশক্তির দোহাই দিয়ে তার অধীনস্থ ফৌজের বিরুদ্ধে বা স্থানীয় প্রতিনিধির বিরুদ্ধে। এরকমটা কেবল ভারতবর্ষেই ঘটেছে তা নয়।

এরকম রাশিয়াতেও দেখা গেছে। জারের কসাক বাহিনীর হামলার শিকার সাধারণ মানুষ জারের কাছেই সুবিচার প্রার্থনা করে। তারা জারের নাম নিয়েই বিদ্রোহ করে। আর এ কারণেই এই সকল বিদ্রোহের নায়করা তাদের স্বপ্নকে সফল করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কেননা তাদের আকাক্সক্ষার মধ্যে বাস্তব ভিত্তির অভাব ছিল যার ফলে ‘রাষ্ট্রশক্তি’ সম্পর্কে যুক্তিসিদ্ধ ও সুসংহত কোনও ধারণা তাদের মধ্যে গড়ে উঠতে দেখা যায় না। কিন্তু বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের পর্বের ইতিহাসে যে সকল নিম্নবর্গের মানুষের উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি তারা তাদের ক্ষমতা যোগ্যতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তা সত্ত্বেও ’৭১ পর্বে যে মুক্তির আন্দোলন সেখানেও নিম্নবর্গের চেতনায় তাদের নেতার মধ্যে দেবতার মাহাত্ম্য ও আদর্শ কল্পনা করার প্রবণতা আমরা লক্ষ করি। লোককবি ভবা পাগলা তার গানে জগৎকা-ারী ভগবানকে মুজিবের মধ্যে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তার গানে-

ভবা পাগলার অভিমান
আর কেন দেরি, শোন হে কা-ারী
মুজিবরে হও অধিষ্ঠান। সুসন্তান তোমার নিয়াছে এ ভার
(আজি) ধরিতে বাংলার হাল।
লোককবির এই চেতনা নিম্নবর্গের সাধারণ চেতনারই অংশ। আর এক লোককবি তোরাব আলী শাহ চূড়ান্তভাবে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রকে পৌরাণিক দেবতার মহিমায় উপস্থাপন করেছেন। তিনি সত্যযুগের সত্যদাতা, তিনি ভব নদী পার করতে জয় বাংলা নৌকা ভাসিয়েছেন। শুধু তাই নয়, শ্রীকৃষ্ণ যেমন মনমোহিনী হয়ে মথুরাবাসীর মন জয় করতে মথুরায় জন্ম নিয়েছেন তেমনিভাবে মুজিবুরও মনমোহিনী রূপে জগতের মন ভরিয়ে দিয়েছেন। দুনিয়াকে মুক্তি দিতে তিনি মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে বাংলায় জন্ম নিয়েছেন। তিনি হলেন বিধির বিধাতা আর তাই বাংলার ব্যথা তিনিই বুঝতে পেরেছেন। এই লোককবি তার গানে বলেন-
হায় শেখ মুজিবুর সত্যযুগের সত্যদাতা
প্রকাশ হইয়াছে চারযুগের শেষে।
ভব নদী পার করিতে জয় বংলা নৌকাতে
হায় মনমোহিনী শেখ মুজিবুর
জগতের মন ভরে দেছে
মুক্তিবাহিনী সঙ্গে নিয়ে
বাংলায় জন্ম নিয়েছে।
হায় কত রাজা এল গেল
সোনার বাংলার জন্য না কাঁদিল গো
বাংলায় এসে জন্ম নিল
সারা দুনিয়ার জন্যি কান্দে সে।
হায় এজগতের জয় সত্য কথা
শেখ মুজিবুর বিধির বিধেতা
তোরাব শাহ কই বাংলার ব্যথা
শেখ মুজিবুর জেনেছে।
আর এক লোককবি মোসলেম উদ্দিন বয়াতি। তিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখেন জিতেন্দ্রিয় পুরুষ হিসেবে, দেখেন নায়েবে রছুল হিসেবে। তিনি তাকে দেবতা ভীম ইন্দ্র চন্দ্র বরুণ হিসেবেও দেখেন। তাতেও তার মন ভরে না অবশেষে তিনি তাকে সাক্ষাৎ ভগবান বলে ঘোষণা করেন। তার গানে-
জিতেন্দ্রিয় পুরুষ তুমি নায়েবে রছুল
ভাঙিতে এসেছ তুমি বাঙালির ভুল
রুদ্র রূপে ভীম তুমি, শুদ্র রূপে কাম
জীবের মধ্যে সজীব তুমি, মুজিব তোমার নাম।
তুমি ইন্দ্র ও চন্দ্র, তুমি বরুণ সুরেন্দ্র
ধীরেন্দ্র কুমার তুমি বীরেন্দ্র সন্তান।
... ...
তুমি পিতা তুমি ভ্রাতা তুমি বন্ধুবর
সর্বরূপী তুমি দয়াল শেখ মুজিবর।
তুমি দিবা তুমি নিশি, তুমি কান্না ও হাসি
তুমি আকাশের শশী, তুমি সাক্ষাৎ ভগবান।
যুগ যুগ ধরে সারা বিশ্বে প্রভু শক্তির বিরুদ্ধে সংঘঠিত নিম্নবর্গের সমাবেশের মধ্যে গণ মানুষের চেতনার যে স্বরূপটি আমরা প্রকাশ হতে দেখি এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। স্বীয় নেতার মধ্যে দেবত্বের আরোপকে তারা অসাধ্য সাধনের প্রচেষ্টা বলেই মনে করে। তবে এর একটি সমাজ মনোস্তাত্ত্বিক কারণও রয়েছে। নিম্নবর্গের মানুষরা যুগ যুগ ধরে যে শোষণ নিষ্পেষণের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে সেখানে সে ন্যায়বিচার পায় না। সে তখন ঈশ্বরের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। সে মনে করে এমন একদিন নিশ্চয়ই আসবে যখন ভগবান দুষ্টের দমন করবেন। মনে মনে তার ভেতরে যে মুক্তির আকাক্সক্ষা কাজ করে তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে সে তার নেতাকে মুক্তিদাতা হিসেবে কল্পনা করে নেয়। আর একারণে তার পক্ষে স্বীয় নেতাকে বিধির বিধাতা, সাক্ষাৎ ভগবান, নায়েবে রছুল কোনো কিছুই বলতে বাঁধে না। একারণেই তথাকথিত ইতিহাসবিদরা নিম্নবর্গের মানুষের চেতনাকে স্বকীয়তাহীন বলে মনে করেন। ফলে আমাদের চর্চিত ইতিহাস বিদ্যায় তাদের ঠাঁই মেলে না। তবে একথা পরিষ্কার যে- পূর্ব বাংলার আন্দোলনে অংশ নেওয়া জনসাধারণের চেতনা ঔপনিবেশিক আমলের নিম্নবর্গের চেতনার অনুসারী নয়। আর একারণেই এদেশের সাধারণ মানুষ তাদের নেতাকে যতই অলৌকিক শক্তির আধারবলে মনে করুক না কেন তারা বাস্তবিকভাবেই ছিল রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অধিকারী। অসাধ্যকে সাধনের অলীক কল্পনা দ্বারা তারা তাড়িত হয়নি। যেখানে নিম্নবর্গের মানুষের আন্দোলন আইনসিদ্ধ পথে এগিয়ে প্রয়োজনে বেআইনি পথ ধরে হিংসাত্মক হয়ে ওঠে সেখানে পূর্ববঙ্গের গণ আন্দোলন আইনভঙ্গের মধ্যে লিপ্ত না হয়ে তাদের আকাক্সক্ষাকে তাৎপর্যপূর্ণ ও অধিক শক্তিশালী রূপে প্রকাশ করতে সমর্থ হয়। এ যাবতকালে সংঘটিত নিম্নবর্গের আন্দোলনের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়Ñ তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা, চৈতন্যের স্তর, ও রাজনৈতিক লক্ষ্যের মধ্যে বিস্তর অমিল ছিল, ছিল আদর্শের অমিল ও পারস্পারিক বিরোধ। কিন্তু ’৭১ পর্বের আন্দোলনে নিম্নবর্গের মানুষের চৈতন্যের স্তর, বাস্তব অভিজ্ঞতা আদর্শের চেহারা সবক্ষেত্রেই ছিল সমন্বয়ের চিত্র। শত্রুর প্রতি তাদের বিরোধিতা কখনও স্বীয় নেতার প্রতি আনুগত্যকে ছাড়িয়ে যায়নি। আর তাই মুক্তির আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা নিম্নবর্গের মানুষের রাজনীতির মৌলিকতার সঙ্গে ঔপনিবেশিক আন্দোলনে অংশ নেওয়া নিম্নবর্গের মানুষের রাজনীতির মৌলিকতার পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্য সূচিত হয়েছে এদেশের শিক্ষিত সমাজের কারণে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই পাক শোষকদের বিরুদ্ধে নিজেদের উদ্যোগ ও নেতৃত্বকে দেশের সাধারণ জণগণের আকাক্সক্ষার সূত্রে আন্তরিকভাবে একত্রিত করতে সমর্থ হয়েছিল। এর ফলে রাষ্ট্রশক্তি সম্পর্কে তাদের ধারণাও ছিল সুস্পষ্ট। তারা তাদের স্থানীয় প্রতিনিধি ও প্রভুশক্তি সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই জানতে পেরেছিল। তারা ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে পাকিস্তানিদের শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের ধরন ও নির্যাতক-শোষকের পরিচয় এতটাই পরিষ্কারভাবে জেনেছিল যে লোককবিদের বর্ণনার মধ্যে কোথাও কোনও শূন্যস্থান পূরণের জন্য দৈবশক্তির আশ্রয় নিতে হয়নি। তারা তাদের রচনাকে যেমন নিজের নামেই উপস্থাপন করেছেন, জেল খেটেছেন তেমনি পাকিস্তান রাষ্ট্র সম্পর্কে কোনও রকম চিন্তার দোটানার মধ্যেও তারা পড়েননি। ’৪৭ পূর্ব ইতিহাসের নিম্নবর্গের মানুষরা যেখানে নিজেদের সামগ্রিক ক্ষমতাকে বুঝতে অক্ষম ছিল সেখানে বাংলার নিম্নবর্গের মানুষ তাদের নেতার ক্ষমতা, তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দায়িত্ববোধের বিষয়ে ছিলেন সচেতন। তাই তারা মুক্তিবাহিনীর লড়াইকে ঠাকুর, ঈশ্বর বা ভগবানের লড়াই মনে করেননি। মনে করেছেন তাদের নিজেদের লড়াই, বাঙালির লড়াই। কারণ তাদের নেতা তাদের মধ্যে জাগ্রত করেছিলেন রাজনৈতিক অধিকার বোধ। তিনি একা ‘ছয়দফা’র মর্মার্থ জনগণকে বোঝাতে ছুটে বেড়িয়েছেন নগর থেকে বন্দরে, শহর থেকে গ্রামে। পূর্ব বাংলার প্রত্যেকটি অঞ্চলে তার পায়ের ছাপ পড়েছে ছয়দফা দাবির গুরুত্ব জনগণকে বোঝাতে গিয়ে, ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। আর তার সঙ্গে পা মিলিয়ে, তার চৈতন্যের সঙ্গে নিজেদের চিন্তাকে মিলিয়ে বাংলার নিম্নবর্গের মানুষ হয়ে উঠেছে যথার্থরূপে মুজিবের অনুসারী, অধিকার সচেতন ‘গণমানুষ’। তাই তাদের কল্পনায় কোনও অলীক রাষ্ট্রের ধারণা কাজ করেনি কিংবা ধর্মভাব দিয়েও তাদের চেতনা আচ্ছন্ন হয়নি। তাই লোককবি অকপটে বলতে পারেন-
কেবা হিন্দু কেবা মুসলিম এই কথা যাও ভুলি
জন্মগত হিন্দু মুসলিম জাতে হই বাঙালি
বিভেদ চলবে না চলবে না
মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম ছাড়ব না।
ঔপনিবেশিক আমল থেকে ভারতবর্ষে যত আন্দোলন, বিদ্রোহ, বিপ্লব সংঘঠিত হয়েছে তার মধ্যে এই একটি আন্দোলনই সফল ও সার্থক হয়েছে। কারণ অন্য সব আন্দোলনের নেতা তাদের কর্মীদের, জনসাধারণকে অজ্ঞতার মধ্যে রেখে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তাদের যথার্থ রাজনৈতিক অধিকারসচেতন করে তুলতে পারেননি আর তাই তাদের চেতনার একটি বড় অংশ অলীক কল্পনা দ্বারা আচ্ছন্ন হয়েছিল যার কারণে তারা তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে দ্বন্দ্বে ভুগেছে। দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণেই তাদের বিদ্রোহ বা আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। বাঙালির এটা সৌভাগ্য, নিজেদের জন্য এমন এক নেতা পেয়েছিল যিনি জনগণকে তাদের নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কে অবহিত করেন। ক্ষমতার আকাক্সক্ষা নয় বরং বাঙালির জীবনে সৃষ্ট সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে তা সমূলে বিনষ্ট করার আকাক্সক্ষাকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন তিনি। এ কারণেই প্রথাগতভাবে নিম্নবর্গের যে ইতিহাস চেতনা যে রাজনৈতিক চেতনা তা থেকে বাঙালির গণমানুষের ইতিহাস চেতনা ও রাজনৈতিক চেতনা একেবারেই আলাদা। বাংলার সাধারণ মানুষ এতটাই রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন যে লোককবি মফিজউদ্দিন ‘দর্জালের সিংহাসন’ নামক কবিতা লিখে জেল পর্যন্ত খেটেছেন। তার এই কবিতায় রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় যেমন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তেমনি কোনও রকম অলীক ও পরস্পরবিরোধী অর্থের দ্বন্দ্ব এখানে নেই। তিনি রাষ্ট্রের মালিককে বলেছেনÑ
এখন যারা গদির মালিক তাদের কাছে নিবেদন/ বোকা পেয়ে দেশবাসীরে কর না আর জ্বালাতন।/ লীগ আমলের জুলুমবাজি দর্জাল বাবার সিংহাসন,/ অকাতরে সহ্য করল দেশের যত জনগণ।
... ... ...
একুশ দফার যত কথা দাবি যাহা দেশবাসীর
পূরণ যাতে হতে পারে করতে হবে সেই ফিকির।
এভাবে লোককবিরা তাদের এই রাজনৈতিক চেতনাকে গানের আসরে, কবিতার আসরে দর্শক ও শ্রোতার চেতনার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের তৈরি করেছেন রাজনৈতিকভাবে অধিকার সচেতন করে। আর এক লোককবি ইদ্রিছ আলী মিয়া। তার রচিত ‘জয় বাংলা’ কবিতা পাঠ করলেও কবির রাজনৈতিক অধিকার সচেতনতা ধরা পড়ে। এখানে যেমন সেনাপ্রধান হামিদ খান, টিক্কা খান, এহিয়া, নূরুল আমিন গংদের ভূমিকা যেমন উঠে এসেছে তেমনিভাবে বঙ্গবন্ধু, ইন্দিরা গান্ধী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকাও সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের ‘পাঞ্জাইব্যা শুয়োর’ পাঞ্জাইব্যা শয়তান’ বলে চিহ্নিত করে তাদের শাসন শোষণের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দেন। কবিতায় দেখা যায় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেও তারা নিজেদের ইচ্ছায় যুদ্ধে যায়নি। তারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই যুদ্ধে যায়। লোককবি বলেনÑ
মুজিবুরের ডাকে সারা দিয়া বাঙালির সন্তান
মুক্তিফৌজ হইল গিয়া হিন্দুস্তান।
বাঙালির এই ইতিহাস পর্বে মুক্তিযোদ্ধারা নিম্নবর্গের মানুষ হলেও ইতিহাসের অন্যান্য নিম্নবর্গের মানুষের মতো তারা রাজার দোহাই দিয়ে যুদ্ধে নামেনি। তারা তাদের নেতা বঙ্গবন্ধুর দোহাই দেয়, দোহাই দেয় তাদের মাতৃভূমির। লোককবি দারোগ আলীর বয়ানেÑ
জয়ধ্বনি করো সবে যত লোকজন
জয় বাংলা জয় বাংলা বলে কাঁপাবে গগন।
স্বাধীন বাংলা বলে মুজিব করিলো ঘোষণা
আল্লাতালা পুরাইবে মনের বাসনা।
বঙ্গবাসী এক তালেতে চালাইল সংগ্রাম
শহর বন্দর বাজার বস্তি গেরাম।
’৪৭ পূর্ব ইতিহাসে কথিত নিম্নবর্গের মানুষের কাছে যখন রাষ্ট্রের প্রধান হচ্ছেন ঐশ্বরিক ক্ষমতার আধার তখন পূর্ববাংলার জনগণের কাছে রাষ্ট্রপ্রধান চিহ্নিত হয়েছে বেইমান, দর্জাল, শুয়োর ইত্যাদি নামে। নিম্নবর্গের মানুষ যখন মনে করেছে তাকে তার ইচ্ছে শক্তি নয় তাকে চালায় দৈবশক্তি তখন এদেশের সাধারণ জনগণ তাদের নাগরিক অধিকার ও ক্ষমতা সম্পর্কে শতভাগ সচেতন। সে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে নিজের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার দ্বারা কোনও দৈবশক্তি দ্বারা নয়। সে তার সাংবিধানিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করে যাকে নিজের নেতা করেছে, যার হাতে সে নিজের দায়িত্ব সঁপে দিয়ে স্বস্তি পেতে চেয়েছে সেই নেতাকেই তার নায়েবে রাসুল জ্ঞান করে স্লোগান দিয়েছে- ‘জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব’।
এই স্লোগানের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন করার মন্ত্রও উচ্চারিত হয়ে যায়। কেননা জনগণ জানত পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুজিবকে মুক্ত করা মানেই হল দেশ স্বাধীন হওয়া। এ কারণেই সেই সময় ‘জয় বাংলা’ ও ‘শেখ মুজিব’ হয়ে উঠেছিলেন মুক্তির প্রতীক, গণজাগরণের প্রতীক।
বাংলাদেশের গণমানুষের পক্ষে কেউ ইতিহাস রচনা না করলেও, কলম না ধরলেও সাধারণ জনগণ নিজেদের মতো করেই কবিতা, গানে ছড়ায় নিজেদের ইতিহাস রচনা করে নিয়েছেন। আর সেই ইতিহাস চেতনার মধ্যে আকাক্সক্ষা ও অসাধ্যতার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। একারণে মোহম্মদ শাহ বাঙালি গাইতে পারেনÑ
আমরা ছাড়ব না ছাড়ব না মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম ছাড়ব না।
সাত কোটি ঐ নর-নারী হইয়াছে তৈয়ার
দুঃখের সিন্ধু বঙ্গবন্ধু কইরা দেবে পার।
কীসের ভাবনা, মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম ছাড়ব না।
বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়াছে চলো মুক্তিযুদ্ধে
গোলাম হয়ে বাঁচার চাইতে মৃত্যু অনেক ঊর্ধ্বে।
বসে থাকব না থাকব না, মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম ছাড়ব না।
শাহ আলীর গানটি থেকেও এটা পরিষ্কার হয় যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের জনগণের চেতনা রণজিৎ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায় গৌতম ভদ্র প্রমুখের নিম্নবর্গের মানুষের চেতনা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অন্য সব বিদ্রোহী বা সংগ্রামী গোষ্ঠীর চেয়ে বাঙালির জাতীয়তাবাদী ঐক্যের বোধ একাত্তর পর্বে এসে পরিণত হয়েছিল জাতীয় ঐক্যে আর আপামর জনগণও বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব বাংলার জাতীয় ঐক্যের প্রতীক বলে মেনে নিয়েছিলেন। আর তাই বলা যায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেবল রণক্ষেত্র নয় বরং বাঙালির জাতীয়বাদী চেতনার ঐক্যভূমি।

রঞ্জনা বিশ্বাস : লেখক ও গবেষক

 
Electronic Paper